আমরা কি সেলফিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি? অ্যানালগ ক্যামেরার বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন
ক্যামেরা। ছবি তোলার এ যন্ত্রটির সাথে সবাই মোটামুটি পরিচিত। একটা সময় ক্যামেরা ছিল ফিল্মনির্ভর। তখন ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তা দেখা যেত না। এজন্য বেশ সময় অপেক্ষা করতে হতো। দিন বদলেছে, প্রযুক্তির কল্যাণে এসেছে আধুনিক বা ডিজিটাল ক্যামেরা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের টুলস, যেগুলোর ব্যবহারে একটি ছবিকে ইচ্ছামতো এডিট (সম্পাদনা) করা যায়। অন্যদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যেন হারিয়েই গেছে সেসব অ্যানালগ ক্যামেরা।
আধুনিক এসব তথ্যপ্রযুক্তিতে অভ্যস্ত একটি প্রজন্ম এখন আগের সেই অ্যানালগ ক্যামেরা ফিরিয়ে আনতে চাইছে। অর্থাৎ পুরনো দিনের ফিল্মনির্ভর সেই ক্যামেরাগুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, বিশেষ করে এ আগ্রহটা তাদের ক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্যণীয় যাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো সেই ক্যামেরার ফিল্মগুলোতে বন্দি।
স্পেনের মাদ্রিদের সেলস দে প্লাতা স্টোরের পরিচালক ক্রিস্তোবাল বেনেভেন্ত ও মার্তা আর্কেরো বলেন, 'আমরা অনেক ছবি তুলি। কিন্তু সেগুলোর স্থায়িত্ব কেবল ফোনটি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্তই। ফোন পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সেসব ছবিও হারিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ছোটবেলার বেশিরভাগই ছবিই অ্যালবামে রাখা। এগুলো আমাদের জীবনের পুরনো স্মৃতিগুলোতে ফিরে আসার এবং সেসব স্মৃতি রোমন্থন করার একটি জায়গা।'
এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখন সেই অ্যানালগ ক্যামেরার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এসব ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখার জন্য বেশ তর সইতে হয়। আগে ফিল্ম শেষ হবে, তারপর সেটি স্টুডিওতে বা ল্যাবে যাবে, তারপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে হাতে আসবে ছবি। আর এসব ছবি তখন মানুষের কাছে হয়ে ওঠে অমূল্য এক বস্তু।
ফিল্ম ফটোগ্রাফিকে বলা চলে সৌন্দর্য, বিষণ্ণতা ও স্মৃতির সমার্থক। এসব ক্যামেরায় ব্যবহৃত ফিল্মগুলোর রোলের সংখ্যা সীমিত। ক্যামেরার শাটারের প্রতিটি ক্লিকই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক্ষেত্রে আলোকচিত্রীদের ছবি তোলার মুহূর্তগুলো নিখুঁতভাবে বেছে নিতে হয়। যাতে করে একটি রোলও নষ্ট না হয়। কিন্তু স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। এগুলোতে রয়েছে ইচ্ছামতো ছবি তোলার সুযোগ। কোনো ফিল্ম বা রোলের ঝক্কি-ঝামেলা নেই। কেবল ফোনের ক্যামেরা চালু করে সামনে ধরা আর স্ক্রিনে টাচ করা। ব্যস, হয়ে গেল ছবি।
সাধারণত একটি সেলফি তোলার পর বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার জন্য তোলা ছবিতে একজন মানুষ তার মুখ ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির বিষয়ে সতর্ক থাকে। কিছু ক্ষেত্রে তো ছবিগুলো এমনভাবে এডিট ও ফিল্টার করা হয় যেখানে ছবির মানুষগুলোকীএ চেনাই কঠিন হয়ে পড়ে।
এমন অনেকে আছেন যারা এসব ফিল্টার ব্যবহারের পর তাদের যেমন দেখতে লাগে, বাস্তবে চেহারায় ঠিক সেই লুক আনার জন্য প্লাস্টিক সার্জারি পর্যন্ত করান। বোস্টন মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষকরা এই প্রসঙ্গ টেনে 'সেলফি ডিসমরফিয়া'র বিষয়টি তুলে ধরেন।
তবে বিকল্প সামাজিক নেটওয়ার্ক যেমন- 'বি রিয়াল' অ্যাপে আর্টিফিশিয়াল অপশনগুলো তুলনামূলক কম। বাস্তবতার ঘাটতি এবং ইনস্টাগ্রাম ও অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন থেকে উদ্ভূত এসব জটিলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ২০২০ সালে অ্যাপটি চালু করা হয়।
'জেনারেশন জেড' এর সদস্যরা এই কৃত্রিমতা নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অ্যানালগ ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো নিখুঁত নাও হতে পারে এবং প্রত্যেককে আকর্ষণীয় নাও দেখাতে পারে, কিন্তু এসব ছবি একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের স্মৃতি এবং ছবিটি তোলার সময় অনুভূতিগুলো কেমন ছিল তা বন্দি করে রাখে।
অ্যানালগ ক্যামেরার সাথে মূলত মিলেনিয়ালরা (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ এর মধ্যে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিরা) পরিচিত, এখন জেনারেশন জেডের তরুণরাও সে মুহূর্তগুলোর অভিজ্ঞতা পেতে চায়।
অ্যানালগ ক্যামেরার ক্ষেত্রে রোল তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ছবিটা কী হবে বা কেমন হবে তা জানার জন্য একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এটি অনেক তরুণের কাছে সম্পূর্ণভাবে নতুন এক অভিজ্ঞতা।
অ্যানালগ ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে বয়স অনুযায়ী দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় পার্থক্য রয়েছে: কেউ এটিকে সম্ভাবনায় পূর্ণ একটি সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে দেখেন আবার কেউ ২০০০ এর দশকের শুরুর দিকে এটির ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন।
ফিল্টার ব্যবহার না করা সেই ছবিগুলোর অতীতবিধুরতা
ছবি এডিট করার জন্য অগণিত টুলস রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে ছবিতে সেই পুরনো দিনের শৈলী ফুটিয়ে তোলা যায়। কিন্তু এগুলো ক্ষণস্থায়ী।
বেনেভেন্তে ও আর্কেরো বলেন, 'অতীতে ফিরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় ফিরে আসা, পরিচিতের কাছে ফিরে আসা, সেই জায়গায় ফিরে আসা যেখানে একজন নিরাপদ বোধ করে। সম্ভবত এ কারণেই এখন অল্পবয়সী বাচ্চারা তাদের সেল ফোন দিয়ে ট্র্যাপ কনসার্টে ছবি তুলছে এবং সেগুলো সংরক্ষণের জন্য ফোন থেকে কম্পিউটারে নিয়ে রাখছে। অথবা মানুষ মিনিডিভি ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও ক্লিপ শুট করছে। এটি সেই একই ধরনের অতীতবিধুরতা যা উইম ওয়েন্ডারস 'প্যারিস, টেক্সাস' সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। সুপার এইট ফিল্মে তোলা সেসব দৃশ্য হারানো অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়।'
#ফিল্মফটোগ্রাফির মতো হ্যাশট্যাগুলোর ইনস্টাগ্রামে চার কোটি সাত লাখ ৬৪ হাজার ১৫৩ জন ফলোয়ার রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পোস্ট করা ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, দম্পতি বা যুগলরা তাদের অভিভাবকদের সেসব ছবির অনুকরণ করছে যখন অভিভাবকরা তাদের বয়সী ছিল।
আধুনিকতার আবির্ভাবের সাথে সাথে অ্যানালগ ক্যামেরা শিল্প হারিয়ে যেতে থাকে। ২০১২ সালে সাংবাদিক রামোন পেসো এই সংবাদপত্রে (এল পাইস) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন যে অ্যানালগ ফটোগ্রাফি টিকে থাকবে কিনা।
ওই সময় তিনি নিবন্ধটির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'এটি একটি রোমাঞ্চকর স্টেটমেন্টের মতো মনে হতে পারে এবং এটি সম্ভবত তাই-ই। তবে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ফটোগ্রাফি ব্যবসা অনেক স্বপ্নের ইন্ধন জোগায়। কারো কারো জন্য সেই স্বপ্নগুলো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বন্দি করা যায় না।'
শার্লট ওয়েলস 'আফটারসান' ছবিতে সোফির বাড়ির ভিডিওগুলোর সাথে বিষণ্ণতাগুলো ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তুরস্কে বাবার সাথে সোফির শেষ রাতের স্মৃতিটি পোলারয়েড (এক ধরনের অ্যানালগ ক্যামেরা) দিয়ে তোলা, ছবিটা তাদের ওইদিনের মুহূর্তের প্রতিনিধিত্ব করে, যা হয়তো সোফির স্মৃতিতেও আর নেই।
পোলারয়েড এখন শুধু একটি ছবি নয় বরং এটি এখন অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। ছবি এমন কিছু যা অন্য সবকিছু চলে গেলেও স্পর্শ করা যায়, অর্থাৎ সেই অতীতকে অনুভব করা যায়।
একই ধারায় আবারও ফিরে এসেছে ওয়াই টু কে (অ্যানালগ ক্যামেরার একটি মডেল)। মার্কিন গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব প্যারিস হিলটনের মতো খ্যাতিমানদের হাতে এক সময় দেখা যেত এসব ক্যামেরা। বর্তমানে ফটোগ্রাফার থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা সেই ক্যামেরাগুলো আবার ব্যবহার শুরু করেছে।