যে সময় স্পন্দনের, সে সময় উচ্চারণের
কাজী হাবলু তখনো ঢাকায় আসেননি। শিশু বয়সে তার তবলায় হাতেখড়ি হয়েছিল আর দিনে দিনে তুখোড় হয়ে উঠেছিলেন। উনসত্তর সালে হাবলু বড় বোনের সঙ্গে থাকতেন খুলনায়। সত্তর সালে হাফ প্যান্ট ছেড়ে খুলনা বেতারে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বাজাতে শুরু করেন। ধ্যান-জ্ঞান সবই তার তবলায়। টিভিতে টারজানের মিউজিক শুনে ভাবতেন, কীভাবে এমন শব্দ তৈরি করা যায়?
কঙ্গোর সঙ্গে পরিচয় তার ছিল না, বঙ্গবন্ধু শব্দটি শুনেছিলেন দু-চারবার। নিয়মিত যান বেতারে, তবলা বাজান আর বাজনা নিয়ে ভাবেন। এই ছিল জীবন। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। বেতারের অফিস ছিল গল্লামারিতে। শহর ও গল্লামারির মাঝখানে ছিল একটি কচ্ছপপিঠি সেতু; যেটি পেরুলে রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত, আশপাশে লোকালয় ছিল না, বেতার অফিসটি দাঁড়িয়ে থাকত একলা একা। একদিন অফিসে গিয়ে এক সুদর্শন পুরুষ দেখলেন, আগে কখনো দেখেননি, মানুষটি তার বাজনা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, বলেছিলেন, আপনি ঢাকা যাননি!
একাত্তরের এপ্রিল অথবা মে মাস। সুদর্শন মানুষটির সঙ্গে হাবলু একদিন ফিরছিলেন শহরে। পাকিস্তান আর্মির দোসররা তাদের পথ আটকায়। সেতুর ওপর নিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসায়, আশপাশে গুটিকয় মৃতদেহ পড়ে ছিল। হাবলু ভাবছিলেন, ওরা কি তাদেরও মেরে ফেলবে? পানিতে কি ঝাঁপ দেবেন? এসবের মধ্যে পেছন থেকে একটি হলুদ রঙের ভক্সওয়াগন এল। তাতে আর্মির ঊর্ধ্বতন কোনো কর্তাব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করে জানলেন, হাবলুরা বাজনাদার। কিছু পরে চলে যাওয়ার অনুমতিও দিলেন।
সুদর্শন মানুষটি বললেন, পালাতে হবে। হাবলু জানতে চাইলেন, কেন? তিনি জবাব দিলেন, ওরা আমার খোঁজে এসে থাকতে পারে। হাবলু বললেন, আপনি কে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমি 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' গানের সুরকার, আমার নাম আনোয়ার পারভেজ (শাহনাজ রহমতুল্লাহর ভাই)।
হাবলু তখনো বুঝতে পারেননি 'জয় বাংলা' গানে সুর করলে কার কী ক্ষতি। কিছুদিন পরে অবশ্য হাবলু নিজেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ভিড়ে গিয়েছিলেন কমান্ডার ওমর ফারুকের গেরিলা দলে। গেরিলাদের পোশাক-আশাক, টিফিন ক্যারিয়ার, হাতিয়ার বহন করতেন। সুন্দরবনের পিরোজপুরের বৈঠাকাটা, সুন্দরবনঘেঁষা লবণচরায়ও তিনি যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন হলে হাতিয়ার জমা দিয়ে ৩০০ টাকা ভাতা পান।
এবার ভাবলেন, ঢাকায় যাবেন। বেতারে গিয়ে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) নিলেন। ঢাকার শাহবাগে ছিল বেতার অফিস। কিন্তু অনুমতিপত্র না থাকলে ঢোকা যায় না। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল লাকী আখান্দের; হাবলুদের কুমিল্লার বাড়িতেও গিয়েছিলেন বেতারের কর্মকর্তা। আজিমপুর কলোনিতে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে লাকী আখান্দ তার বাজনা শুনলেন, প্রীত হলেন, ফিরোজ সাঁইয়ের সঙ্গেও পরিচয় ঘটল কলোনিতেই। ফিরোজ সাঁই একদিন তাকে নিয়ে চললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, হাবলু জানেন না কার জন্য অপেক্ষা। কিছুকাল পরে '৬৯ মডেলের একটি গাড়ি থেকে প্রাণবন্ত এক যুবক নামলেন। তার চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে হাফ হাতা শার্ট। এগিয়ে এসে বললেন, কি রে ফিরোজ কেমন আছিস? ফিরোজ ভাই আলাপের একপর্যায়ে বললেন, 'কামাল ভাই, এ ছেলেটা দুর্দান্ত বাজায়। আমাদের গ্রুপে ওকে নিলে ভালো হয়।' হাবলুর তখনো জানতে বাকি ইনি শেখ কামাল, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। কামাল ভাই আপনজনের মতো হাবলুর কাঁধে হাত রাখলেন আর বললেন, 'এখন একটু কষ্ট কর, পরে পোলাও খাবি।'
চিৎকার দিয়েছিলেন জোরে
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেই শেখ কামাল গড়ে তুলেছিলেন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী। অল্প দিনেই হাবলু দলের একজন হয়ে উঠলেন। মাহবুবুল হক খান, যিনি বছরখানেকের মধ্যে আজম খান নামে সারাদেশে আলোড়ন তুলবেন, তিনিও মাঝেমধ্যে স্পন্দনে গান গাইতে আসতেন। একহারা গড়নের বছর বাইশের এক সতেজ প্রাণ তখন আজম খান। গেরিলা দলের নেতা, ত্রিশটি সম্মুখযুদ্ধে আর অগণিত হিট অ্যান্ড রান অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধফেরত মানুষটির যুদ্ধবিধ্বস্ত, ভাঙাচোরা দেশে কি বসে থাকার উপায় আছে? তিনি নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন, হাতিয়ার যার গান, রক গান। তখনো দেশে রক গান কী–চেনা নয়। কিন্তু যুদ্ধফেরত তরুণদের রক অ্যান্ড রোল ছাড়া চলবে কেন? এ গানের মন্ত্রই যে কাঁপিয়ে দাও, ঝাঁকি দাও। পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছু যার কাক্সিক্ষত নয়। স্বাধীন দেশে মায়ের ভাষায় উচ্চকণ্ঠ হলেন আজম খান, গাইলেন, 'ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে।'
কাজী হাবলু বললেন, 'মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠলেন কণ্ঠযোদ্ধা। যুদ্ধফেরত একঝাঁক নবীন প্রাণ আমরা সময়টাকে গড়ে তুলছিলাম। লোকগান, লোকায়ত সুর ছিল আমাদের ভিত্তি; তবে প্রকাশটা হলো বৈশ্বিক আঙ্গিকে। ষাটের দশকের দুনিয়ায় যে ঢেউ জেগেছিল, তার ধাক্কায় কাঁপছিল সত্তরের দশকও। আর তা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না বাংলাদেশও। নিজেদের সদ্য স্বাধীন দেশ হওয়ায় আমাদের সুবিধা ছিল কিছু বেশি–সুবিধাবাদের, ভোগবাদের মুখোশ খুলতে চেয়ে আমরা চিৎকার দিতে পেরেছিলাম সবচেয়ে জোরে।'
সবাই ছিল ভাই ভাই
আরও কিছু গুণী শিল্পী সঙ্গী করে ওই বাহাত্তরেই আজম খান নিজের ব্যান্ড 'উচ্চারণ' গড়ে তোলেন। বিটিভিতে পরিবেশন করলেন 'এত সুন্দর দুনিয়ায়, কিছুই রবে না গো, হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে' এবং 'চার কলেমা সাক্ষী দেবে' গান দুটি। বাংলা গানের নতুন ধারা বাংলা পপ তৈরি হতে থাকল। পথটা অবশ্য সহজ ছিল না। বুদ্ধিজীবীরা অপসংস্কৃতি বলে গাল দিতে ছাড়েনি। কাজী হাবলু বলছিলেন, 'উচ্চারণে অনেকেরই অবদান আছে। ভেদ, বিভেদ তখন কমই ছিল। নিয়মিত যে গিটার বাজায়, সে বোনের বাড়ি বেড়াতে গেছে, তার জায়গায় আরেকজন এসে বাজিয়ে দিল, পরে দেখা গেল সে নিয়মিত হয়ে গেছে। এটা অহরহই ঘটত।'
সত্তরের দশক, অনন্য এক কাল। হাতে হাত ধরে চলার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল তরুণদল। কাজী হাবলুর সঙ্গে আজম খানের ভাই-ভাই সম্পর্ক হয়ে যায় অল্প দিনেই। আজম খান কিছু বড় ছিলেন হাবলুর চেয়ে। কিন্তু দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা, দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর দুজনেই, দুজনেরই হাতিয়ার গান; তাই এক প্রাণ হতে সময় লাগেনি বেশি। একই খাবার তারা ভাগাভাগি করে খেতেন, থাকতেনও একই ঘরে। আজম খানের বাড়ি ছিল কমলাপুরে চিটাগাং হোটেলের কাছে। গান করতে করতে, বাজাতে বাজাতে অপেক্ষা করতেনÑকখন হোটেলের একটা ঘর খালি পড়ে থাকবে আর তাতে গিয়ে দুজনে ঘুমাবেন। আধপেটা খেয়ে তারা গান করেছেন কিন্তু কখনোই মনঃকষ্টে ভোগেননি।
রোববার, ৩ মার্চ ২০২৪। হাবলু ভাইয়ের (কাজী আফতাব উদ্দিন হাবলু, পরিচালক, সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি বিভাগ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি) সঙ্গে তার অফিস কক্ষে দেখা করলাম। টেলিফোনে সময় নিয়ে রেখেছিলাম। জানিয়েছিলাম আজম খান নিয়ে স্মৃতিচারণা শুনব। তিনি সময় রেখেছিলেন, আমাদের সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। সেই বিকেলে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন সত্তরের সেই দিনগুলোতে, যখন তারা বাংলা ব্যান্ড গানের ইতিহাস লিখেছিলেন। বলছিলেন, 'ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি ট্রেনে, আমি আর আজম ভাই, ট্রেন চলার ছন্দ ধরে গান বুনে ফেলছি, পানির পাম্পের শব্দও গেঁথে নিচ্ছি মনে। গান ছাড়া আমাদের জীবনে তখন আর কিছু ছিল না। তেমন কোনো দিনে ধানমন্ডি আট নম্বরের ব্রিজের ওপর একজনকে পুঁথি পড়তে শুনলাম। কান খাড়া করে থাকলাম, যতক্ষণ পড়লেন নড়লাম না। শেষে পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম পুঁথিটি। তত দিনে কঙ্গো আমার বলতে গেলে সারাক্ষণের সঙ্গী। পুঁথিটি নিয়ে ফেরদৌস ওয়াহিদকে দিলাম। তিনি একটা করে বাক্য বলেন; আমি কঙ্গো বাজাই। পুরোটা তোলা হয়ে গেলে বিটিভির সপ্তবর্ণা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে (অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের উপস্থাপনায়) পরিবেশন করলাম। গিটার, ড্রাম, কি-বোর্ড, কঙ্গো মানে ব্যান্ড সংগীতে আমরা যা যা বাজাই, পুঁথির সঙ্গে সবগুলোই বাজানো হয়েছিল। সে আমলে আমরা শিখতাম পথ চলতে চলতে, বাউল-ফকিরদের কাছ থেকে। সে গানগুলো গিটার, ড্রাম বা কি-বোর্ডে চড়িয়ে যখন বাজাতাম, তখন হয়ে যেত পপ গান। লোকগানকে তখন লোকে বলত ফকিরি গান আর আমাদের গানকে বলত পপ গান। ব্যান্ডের একটা বিশেষ ব্যাপার হলো, কোনো একক ব্যক্তি নয়, এখানে সবাই মিলে গান তৈরি করে। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের সূচনাকালে দস্তগীর, নীলু, নয়ন মুন্সি, ইদু, ইশতিয়াক, নাসির আহমেদ অপুসহ আরও অনেকে অবদান রেখেছেন। আজম ভাইয়ের বিশেষত্ব ছিল তার সারল্য ও ধ্যানমগ্নতা। তিনি ছিলেন শিশুর মতো। ফুটবল খেলতেন, সাঁতার কাটতেন, ঘুড়ি ওড়াতেন। অদ্ভুত এক কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন মানুষটি। মে গান করতে করতে হাত সামনে মেলে দিতেন বা শরীর বাঁকাতেন–সবটাতেই ছিল সে সারল্য। আর তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত দর্শক-শ্রোতা। পাড়া-মহল্লায় মাইকে বাজত আজম খানের গান। ছন্দ, সুর, গান ধরতে আজম ভাই মেলায় যেতেন, ওরশে যেতেন।'
কনসার্টে ফিরে পেতেন যুদ্ধদিনের চাঞ্চল্য
আজম খানের দীর্ঘদিনের গিটারিস্ট রকেট তার 'আমার গুরু, আজম ভাই' শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখছেন, কুষ্টিয়ায় লালন শাহের মাজারে গিয়ে আজম খান রাতভর গান করেছিলেন। ভোর হওয়ার একটু আগে হঠাৎ সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে দেখেন কুপি হাতে এগিয়ে আসতে। পরে জানা গেল, তিনি ফকির মোকসেদ আলী সাঁইয়ের স্ত্রী। সাঁইজির মাজারের চাবি তার কাছেই থাকে। তিনি দরজা খুলে আজম খান, রকেটদের মাজার দেখিয়েছিলেন।
আজম খানের কনসার্টে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। দেশ স্বাধীন করে ফেরা তরুণরা কনসার্টে এসে তাদের যুদ্ধদিনের চা ল্য ফিরে পেতেন, আতিশয্যে গুলি ছুড়ে ছাদ ফুটো করে ফেলতেন। হাবলু ভাই বলছিলেন, 'এমনটা পৃথিবীর কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না, ব্যান্ড সংগীতে তখনকার তারুণ্য নিজেদের পুনরাবিষ্কার করত। জ্বালা জ্বালা (ফ্রাস্ট্র্রেশন) গানটির কথা এখানে মনে করা যেতে পারে। গানটি সময়ের ক্ষতের ওপর প্রলেপ বুলিয়ে দিত। এটাকেই বলছি যুদ্ধের পরের নতুন যুদ্ধ, শিল্পী-শ্রোতা সবাই মিলে কষ্ট ভুলবার চেষ্টা।'
জীবন থেকে নিয়েই বেশির ভাগ গান রচনা করেছিলেন আজম খান। রকেট তার স্মৃতিকথায় লিখছেন, আজম ভাই একবার হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি হলেন। উনার আল-জিহ্বায় একটা ঘা হয়েছিল। চিকিৎসা চলছে, এর মাঝে উনার পাশের বেডের রোগী মারা যান। উনি খুব ভয় পেয়ে যান। মনে মনে রচনা করে ফেলেন, 'এ কী জীবন! এর চেয়ে ভালো মরণ।' নয়ন মুন্সি কানাডায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আজম খান খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখে তার মনে হয়েছিল নয়নের মুখ দেখছেন। গান বানিয়ে ছিলেন, নয়ন সবার নয়নমনি...। হাবলু ভাই বলেছিলেন, 'আজম ভাই থাকতেন কমলাপুরে, রেললাইনে ঘুরে বেড়াতেন, তাই বাংলাদেশ (রেললাইনের ওই বস্তিতে) গানের প্রেরণা প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা থেকেই পেয়েছেন বলা যায়।' আজম খান সরল যেমন ছিলেন, দরদি মানুষও ছিলেন। তাই তো বাংলার মানুষের অভাব, স্বভাব, ভাব, ভালোবাসা, দুঃখ ছিল তার গানের বিষয়। দুঃখ পুষে রাখার চেয়ে অবশ্য দুঃখের উদ্যাপনে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। জীবনে কিছু পাবেন না জানেন কিন্তু তা জানিয়ে গেছেন সোল্লাসে। অভিমানীকে বলছেন, তোমারই তো বোঝানোর কথা, চলে গিয়ে লাভটা কী হলো?
পপসম্রাট, পপগুরু নামে তাকে ডাকতে ভালোবাসত লোকে। যদিও নিজে এসব তকমা পছন্দ করতেন না। রকেট লিখছেন, 'আজম ভাইকে প্রথম অবস্থায় আমিই গুরু, গুরু বলে ডাকা শুরু করেছিলাম। তিনি খুব বিরক্ত হতেন। আজম ভাই বলতেন, এই ধুর। এইগুলো কী কও তুমি? আজম ভাই কইবা, না হলে আসবাই না এখানে। অনেক বকতেন।'
ডাইল-ভাত খাওয়া মানুষ
হাবলু ভাইও বললেন, 'আজম খান এবং আমরা তখনকার সবাই ছিলাম ডাইল-ভাত খাওয়া মানুষ। টাকাই বুঝতাম না, অন্য কিছু দূরে থাক। আমি বেশি কথার লোক না। আজম ভাইয়ের কারণে আমাকে মুখ খুলতে হয়েছে। মারা যাওয়ার পর দেখলাম লোকজন তাকে মগডালে উঠিয়ে মই সরিয়ে ফেলছে, আমি মুখ খুললাম। চাইলাম মাঠের মানুষ, ঘাটের মানুষ, সাদামাটা মানুষটাকে তেমনই রাখতে, যেমনটা তিনি ছিলেন।'
স্বভাব শিল্পী ছিলেন আজম খান। গানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। তবে পরিবারে সংগীতের চল ও চর্চা ছিল। তাঁর মা ছিলেন শিল্পী এবং বড় ভাই আলম খান ছিলেন সংগীত পরিচালক। মূলত মায়ের গান শুনতে শুনতেই গানের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৫০ সালে আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে তার জন্ম। কমলাপুরের জসীমউদ্দিন রোডে নিজেদের বাড়িতে চলে যান ১৯৫৬ সালে। ১৯৬৬ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। কিশোরবেলায় বন্ধুদের বাড়ির ছাদে গানের আসর জমাতেন। শ্যামল মিত্র, মুহাম্মদ রফি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমারসহ দেশি-বিদেশি নানা শিল্পীর গান গেয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। কলেজে পড়ার সময় তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর (কামাল লোহানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দলটির) সঙ্গে। দলের সঙ্গে জেলায় জেলায় ঘুরে পাকিস্তানি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। সত্তরের নির্বাচনের পরপরই বুঝতে পেরেছিলেন সংগ্রাম আসন্ন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাশভারী সরকারি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি যুদ্ধে যেতে চাই। উত্তরে বাবা বলেছিলেন, যেতে পারো; তবে দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবে না।
গান গাইতেন আর যুদ্ধ করতেন
পরের দিন ভোরেই তিন বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন আজম খান। দুই দিন পর আগরতলা পৌঁছান। মেলাঘরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। আজম খানকে দেখে পুরোনো বন্ধুরা এসে জড়িয়ে ধরল। পরিচয় হলো শাফী ইমাম রুমীর সঙ্গে। রুমীর কাছেই প্রশিক্ষণে হাতেখড়ি আজম খানের। যুদ্ধেও আজম খান গান ছাড়েননি বরং গান গাইতে গাইতেই যুদ্ধ করতেন। সহযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিতও করতেন গান গেয়ে। একপর্যায়ে ঢাকা প্লাটুনের সঙ্গে তাকে পাঠানো হয় ঢাকায়। দুর্ধর্ষ 'অপারেশন তিতাস'-এ তিনি বোমা মেরে ডেমরার পাশে তিতাস গ্যাসের পাইপলাইন উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম 'একাত্তরের দিনগুলি'তে লিখেছেন, '২০ আগস্ট ১৯৭১, একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর, হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ–বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।'
দেশ স্বাধীন হলে পরে আজম খান ফিরে আসেন গানের জগতে। গায়কীর ভিন্নতাগুণে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠতে তার সময় লাগেনি। প্রায় একই সময়ে পপসংগীত ধারায় আরও যুক্ত হন ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামান এবং পিলু মুমতাজ। আজম খান প্রথম মে গান শোনান নটর ডেম কলেজে। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে মোট ১৭টি একক অ্যালবাম করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। একসময় তিনি গান থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সুরের বাণিজ্যিকীকরণ তিনি সইতে পারেননি। তিনি দুঃখ পেতেন এই দেখে যে বাণিজ্য শিল্পীদের আর সাধারণ মানুষের কথা বলতে দিচ্ছে না, স্টার বনে যাওয়াই সবার কাছে মুখ্য হয়ে উঠছে।
বেলবটম লাইফস্টাইল
কবীর সুমন বাংলা ব্যান্ড প্রসারে আজম খানের ভূমিকা নিয়ে বলেছিলেন, 'দশ-বারো বছর আজম খান ছিলেন বাংলাদেশের একচ্ছত্র রক সম্রাট। তারপর তিনি আর গান করেননি। কিন্তু আজও তিনি যদি গান করতে মে ওঠেন, তো দর্শক ও ভক্ত সমাগম যা হবে, তা দুই বাংলার অন্য কোনো শিল্পীর ভাগ্যেই জুটবে না।' তিনি দেশের প্রথম রকস্টার। হাজারো তরুণকে তিনি পথ দেখিয়েছেন; যার মধ্যে জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হামিন, শাফিন, মাকসুদ, হাসান, বিপ্লবও আছেন। বাবরি চুল, দাড়ি, বেলবটম প্যান্ট নিয়ে তিনি ও ব্যান্ড শিল্পীরা হয়ে উঠেছিলেন একটি জীবনধারা বা লাইফস্টাইল। অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন আজম খান; যার মধ্যে হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে পেয়েছে বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড। তার আলাল ও দুলাল, সারা রাত জেগে জেগে, আমি যারে চাইরে, জীবনে কিছু পাব না রে, জীবনে মরণ কেন আসে, আভিমানী তুমি কোথায়, চাঁদকে ভালোবেসো না, বঁধুয়া কি গাইতে জানে গান শুনে এখনো অনেকে নির্ঘুম রাত পার করেন। ২০১১ সালে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তিনি যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য, যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বেকার ও হতাশাগ্রস্ত তরুণদের পথ দেখাতেই গানকে করেছিলেন হাতিয়ার। গণশিল্পী ছিলেন- যার অর্থ মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল তার গান।
আজম খান, স্পন্দন ও উচ্চারণের কথা বলতে বলতে কাজী হাবলু একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমরা হারব না, কাউকে হারিয়ে যেতে দেব না–এমনটাই ভেবেছিলেন সেদিন আজম খানরা। তার জন্য সকল ত্যাগ স্বীকার করতেও রাজি ছিলেন। কত না রাত মাথার ওপর ছাদহীন কাটিয়েছেন, কত দুপুর গেছে আধপেটা! সবই একে একে ঘুরে ঘুরে মনে পড়ছিল কাজী হাবলুর। সেগুলোর সব কি কথা দিয়ে ধরা যায়? আসলে তো অনেকটাই থেকে যায় অনুভবে।