প্যাঁচার প্রণয়, প্যাঁচার গান
কিছুদিন ধরে এক জোড়া লক্ষ্মীপ্যাঁচা আমার প্রতিবেশী। জানি না দালালকোঠার কোন ফাঁকফোকরে এরা দিনে লুকিয়ে থাকে! প্রায়ই দেখি সন্ধ্যার পর লক্ষ্মীপ্যাঁচা বেরিয়ে আসে আর ডাবগাছে বসে চারিদিক চেয়ে দ্যাখে। আমিও চেয়ে থাকি মানবশিশুর মতো বিশাল, গোল, মোলায়েম ও অমলিন এর দেবতুল্য মুখের দিকে। বুঝতে পারি গুজরাটে কেন 'রেবি দেবী' নামে এ পাখিকে পূজা করা হয়।
বাংলার কৃষকের দেওয়া 'লক্ষ্মী' নামটিও অনেক আদর ও ভালোবাসায় ভরা একটি সম্বোধন। সে তুলনায় এর ইংরেজি নাম 'বার্ন আউল', অর্থাৎ 'গোলাঘরের প্যাঁচা' নিতান্তই আটপৌরে। বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এর নাম দিয়েছিলেন 'লক্ষ্মী পাখি'। এদের কথা তিনি লিখেছেন বারবার। তাঁর আমলে প্যাঁচাকে 'পেঁচা' লেখা হতো। প্রেমাতুর একটি প্যাঁচা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন:
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
'লক্ষ্মীটির তরে' লক্ষ্মীপ্যাঁচার এই প্রণয় ও স্বপ্নসাধ কিন্তু শুধু কবির কল্পনামাত্র নয়। লক্ষ্মীপ্যাঁচার ভালোবাসা সত্যই সারা জীবনের বন্ধন। এ পাখি আমৃত্যু জোড়ার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। পাখির জগতে এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রেম খুবই বিরল এবং পশুকূলে একেবারেই দুর্লভ। তবে লক্ষ্মীপ্যাঁচার গড় আয়ু মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বলে দীর্ঘমেয়াদি আখ্যা দিলেও আসলে তা দুঃখজনকভাবে হ্রস্বমেয়াদি।
লক্ষ্মীপ্যাঁচার যৌনজীবনও অত্যন্ত ব্যতিক্রমী না বলে উপায় নেই। এদের যৌনকর্ম চলে সারাটা বছর ধরে; দুনিয়ার তাবৎ প্রাণীর মতো শুধু প্রজননকালেই তা সীমাবদ্ধ থাকে না। মানুষ ও বোনোবো ছাড়া বিশ্বের সকল প্রাণীর যৌনতা প্রজননকাল ছাড়া লুপ্ত অথবা সুপ্ত থাকে। তাদের জন্য যৌনকর্মটা মৌসুমি তাগিদ; দৈনন্দিন বিষয় নয়। মানুষ ও বোনোবোর মতোই লক্ষ্মীপ্যাঁচার জীবনে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। কেন ঘটেছে, তা এখনো অজানা।
জীবনানন্দ দাশ যা-ই বলুন না কেন. লক্ষ্মীপ্যাঁচার গান আমাদের মনে স্বপ্নসাধের কোনো ধারাবর্ষণ করে না। সাপের হিস হিস আওয়াজের সাথে এর গানের সাদৃশ্য আছে বলে বরং তা আমাদের জন্য উৎকণ্ঠারই কারণ ঘটায়। তবুও রক্ষা যে নিমপ্যাঁচা নামের অন্য এক প্রজাতির প্যাঁচার গানের মতো এটা মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ ও ভীতির সৃষ্টি করে না।
যে প্যাঁচার গানে এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়, তার নাম কণ্ঠী নিমপ্যাঁচা। 'নিম, নিম' ডাক থেকেই এর নাম হয়েছে নিমপ্যাঁচা। নিমপ্যাঁচার ডাক আমার কাছে কিন্তু 'টুম' বলে মনে হয়; 'নিম' মোটেই নয়। রাতের আঁধারে নিমপ্যাঁচা দুমিনিট পরপর মিষ্টি সুরে বলে 'টুম'। দেশের লোকে এই ডাক শুধু যে 'নিম' মনে করেছে, তা নয়; তারা এর অর্থ করেছে 'নিমু' মানে 'নিয়ে যাব'। এর আরও বিস্তৃত ও ভয়াবহ যে অর্থ করা হয়েছে, তা হলো 'প্রাণ নিয়ে যাব'। গ্রামের লোক বিশ্বাস করত যে মানুষের প্রাণহরণ করার অলৌকিক ক্ষমতা আছে নিমপ্যাঁচার।
সেকালের মুরব্বিরা নিশ্চিত জানতেন যে নিমপ্যাঁচা ডাকলেই গ্রামে কেউ না কেউ প্রাণ হারাবে। সেকালে গ্রামে নিমপ্যাঁচা তো প্রায়ই ডাকত এবং গ্রামে কেউ না কেউ প্রায়ই মারাও যেত। তাই প্যাঁচার ডাক ও মানুষের মৃত্যুর মধ্যে কার্যকারণের যোগসূত্র টানতে লোকের কোনো অসুবিধে হতো না।
রাতে নিমপ্যাঁচা ডাকলে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে পিতামাতার দুশ্চিন্তার আর অন্ত থাকত না। শিশুর মৃত্যু হলে পিতামাতা সবাইকে শতবার বলতেন যে রাতে নিমপ্যাঁচার ডাক শুনে তাঁরা কতবার প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। কিন্তু শিশু সুস্থ হয়ে উঠলে কৃতজ্ঞ পিতামাতা ভাবতেন, নিশ্চয়ই পাশের গ্রামের কেউ মারা গেছে। নিমপ্যাঁচা 'নিম' বললে মানুষ মারা না গিয়েই পারে না।
কণ্ঠী নিমপ্যাঁচা ছাড়াও এক প্রজাতির নিমপ্যাঁচা আছে এ দেশের গ্রামে। এর নাম উদয়ী নিমপ্যাঁচা। এই প্যাঁচা বছরে একবার ধূসর পালক ঝরিয়ে ফেলে লালচে পালকে দেহ ঢাকতে পারে। লালচে পালকে একে স্বর্গের এক দেবশিশু বলেই মনে হয়।
এই উদয়ী নিমপ্যাঁচা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি সুরেলা এর কণ্ঠ। রাতের আঁধারে সে মৃদু কণ্ঠে গায় 'টুট টুট ট্রুট'। ভাগ্যিস এই গানের সাথে এ দেশের লোক রোগবালাই কিংবা মৃত্যর কোনো সম্পর্ক আবিষ্কার করেনি। তবে পশ্চিমা দেশে এই গানের সাথে বিয়ের একটা সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে। ইংরেজের কানে এই নিমপ্যাঁচার গানটি শোনায় 'হেয়ার কামস দ্য-ব্রাইড'। এর বাংলা তর্জমা হবে 'এই এল কনে'।
নিমপ্যাঁচার মতো ছোট আকারের এক প্রজাতির প্যাঁচা আপনি এ দেশের পাহাড়ি এলাকায় আর চা-বাগানে গেলে সহজেই দেখতে পাবেন। এর নাম দাগিপ্যাঁচা। সারা পিঠে আড়াআড়ি দাগ আছে বলেই অহেতুক অবমাননাকর এই নাম দেওয়া হয়েছে এর।
দাগিপ্যাঁচার পুরুষগুলো সকালে আর সন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় ধরে জোরে 'ফ্রররররর...' শব্দ করতে থাকে। এটাই এই প্যাঁচার গান; খেলার মাঠে রেফারি যে বাঁশি বাজায়, হুবহু সে রকম।
এক দাগিপ্যাঁচা ডাকলে অন্যরাও ডাকতে শুরু করে। পাহাড়ি এলাকার লোক এই কোরাসের সাথে তাই বেশ পরিচিত। যদিও মানুষের প্রাণহরণ করার অলৌকিক কোনো ক্ষমতা দাগিপ্যাঁচার আছে বলে পাহাড়ে জনশ্রুতি নেই, মাঝে মাঝে এরা কিন্তু ঠিকই প্রাণহরণ করে থাকে। তবে মানুষের প্রাণহরণ নয়, কাঠঠোকরার। বাসা বাঁধার জন্য কোটর দখল করার উদ্দেশ্যে কাঠঠোকরাকে আক্রমণ ও হত্যা করতে এরা বেশ পটু।
ছোট আকারের যে প্যাঁচা দাপটের সাথে এ দেশের লোকালয়ে বাস করে, তার নাম খুড়ুলে প্যাঁচা। আলোকিত পথে প্রতি রাতে যেসব পোকামাকড় আসে, সেগুলো খেয়েই এরা জীবনধারণ করে। তাই শহরে ও নগরেই খুড়ুলে প্যাঁচা বেশি নজরে পড়ে। এদের কর্কশ 'ক্যাঁচক্যাঁচ' শব্দের গান আমাদের সুপরিচিত হলেও সুমধুর বলে মনে হয় না। তবে এর গান নিঃসন্দেহে বাংলার অনন্য ছড়াকার সুকুমার রায়কে এই বিশেষ ছড়াটি লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল:
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি/ খাসা তোর চ্যাঁচ্যানি...
গলা চেরা গমকে/ গাছপালা চমকে
সুরে সুরে কত প্যাঁচ/ গিটকিরি ক্যাঁচক্যাঁচ
আমাদের লোকালয়ে খুড়ুলে প্যাঁচার চেয়ে বেশ বড় এক প্রজাতির প্যাঁচা দেখতে পাওয়া যায়। তবে পোকামাকড় ধরতে কখনো আলোকিত পথে নামে না বলে এ প্যাঁচা অত সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। এর নাম 'খয়রা শিকরেপ্যাঁচা'। কিন্তু নগরীর পার্কে কিংবা উদ্ভিদ উদ্যানে রাতে কিছু সময় থাকলে আপনি এর সুরেলা গান শুনতে পাবেন। শিকরেপ্যাঁচা বেশ উচ্চস্বরে গায় 'উ-আপ উ-আপ উ-আপ...'। প্রেমাতুর এই প্যাঁচার বুকের পালকে সারি সারি হার্ট-স্পট থাকে এবং জোড়া ছেড়ে দূরে যেতে একে কমই দেখা যায়।
শিকরেপ্যাঁচার চেয়ে বড় যে প্যাঁচা আজও এ দেশের কোনো কোনো লোকালয়ে টিকে আছে, সেটা হলো এক প্রজাতির মেছোপ্যাঁচা। এর পোশাকি নাম খয়রা মেছোপ্যাঁচা। রাতে জলাশয়ের পাড়ে বসে পায়ের থাবা দিয়ে মাছ শিকার করতে পারে এ প্যাঁচা। পানিতে না নেমেই মাছ শিকার করার এ এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। মানুষের প্রাণহরণ করার মতো অলৌকিক না হলেও এ এক অসাধারণ দক্ষতা।
মেছোপ্যাঁচার গান কিন্তু যান্ত্রিক 'কট কট কট' আওয়াজ ছাড়া কিছু নয়; শুনে মনে হয় একটি মরচে পড়া দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। কিন্তু রোজ রাতে কিছু সময় জোড়া বেঁধে পাশাপাশি বসে ছেলেমেয়ে দুজনেরই এই গান গাওয়া চাই।
যে প্যাঁচার নামই রাখা হয়েছে তার গানের কলি দিয়ে, তার নাম হলো হুতোমপ্যাঁচা। গম্ভীর গলায় 'হুতোম... হুতোম' বলে গান গায় বলেই এ প্যাঁচার এই নাম। ইগলের মতো বিশালদেহী বলে এর ইংরেজি নাম 'ইগল আউল'।
এ দেশে আজও অতিকায় এই হুতোম প্যাঁচার দুটি প্রজাতি টিকে আছে: চিতিপেট হুতোমপ্যাঁচা ও মেটে হুতোমপ্যাঁচা। সাপ, বেজি, খরগোশ, বন মুরগি, শিয়ালছানা ইত্যাদি শিকার করতে পটু এই প্যাঁচা। তবে এই সব বন্য প্রাণী এত বিরল হয়ে যাচ্ছে যে এদের ওপর নির্ভরশীল হুতোমপ্যাঁচা এ দেশে কত দিন টিকবে বলা কঠিন।
লক্ষ্মীপ্যাঁচার মুখে যেমন আছে সরল শিশুর প্রসন্ন, ভোলাভালা দৃষ্টি; তেমনই হুতোমপ্যাঁচার মুখে রয়েছে বদরাগী পণ্ডিতের ভ্রুকুটি। মাথার দুপাশে পালকের দুটো শিং থাকায় হুতোমপ্যাঁচা সর্বক্ষণ ভ্রুকুটি করে আছে বলেই মনে হয়; তা সে যত প্রসন্নবদনেই বসে থাকুক না কেন। হুতোমপ্যাঁচার ভ্রুকুটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখ এড়িয়ে যায়নি বলেই তিনি লিখেছেন:
তালগাছেতে হুতোমথুমো পাকিয়ে আছে ভুরু,
তক্তিমালা হুড়ুমবিবির গলাতে সাত-পুরু