অকুল দরিয়ায় জলদস্যুর জীবন
গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রে দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের দেখা যায়। যেভাবে দেখা যায়, সেভাবেই কি তারা জীবন যাপন করেছে? ব্ল্যাকবিয়ার্ড, ক্যাপ্টেন হুক বা অন্যদের জীবনটা কেমন? তীব্র গতিতে সমুদ্রে চষে বেড়ানো, লড়াই, লুটতরাজÑবল্গাহীন এক রোমাঞ্চকর জীবন। তাই কি? ফিকশনের কারিশমায় নিদেনপক্ষে কোমরে একটি তলোয়ার, এক জোড়া বুট, কাঁধে একটি পাখি বসিয়ে একচোখ পর্দায় ঢেকে দেওয়া জলদস্যু সরদার সাজতে ইচ্ছে হয় অনেকের। নিজেকে ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের একজন দুর্ধর্ষ পাইরেট কল্পনা করতে অসুবিধা নেই। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, ফিকশনের বাইরে জলদস্যুদের জীবনের রয়েছে এক অন্য বাস্তবতা।
রূপকথার গল্প বা ইতিহাসের অনেক বইয়ে জলদস্যুদের জীবনের সত্যিকারের গল্প থাকে না। গল্প, উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে জীবনের শুধু চমকপ্রদ দিকই জায়গা পায়। জীবনের উত্থান-পতনের অধ্যায়টি অনালোচিত থাকে। কূল-কিনারাহীন সমুদ্রে খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন বাস করা কেমন, ডাকাতি না করতে পারার দিনগুলোতে মাঝদরিয়ায় খাদ্য-পানীয়ের জোগান কীভাবে হয়, বাঁচার জন্য যেটুকু নাওয়া-খাওয়া আর ঘুম প্রয়োজন, তা কি তারা পায়, এসব জানতে হলে জলদস্যুদের জীবনের 'গুড, ব্যাড অ্যান্ড আগলি' দিকগুলোতে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় নেই। জীবনের এই অধ্যায়ে অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে বেদনা বেশি।
জলদস্যুদের উদ্ভব
খোলা জলে চুরি-ডাকাতি ও খুনখারাবিই জলদস্যুদের কাজ। এই পেশার জন্ম কবে, কোথায় হয়েছেÑসুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের শুরু থেকেই চুরি-ছিনতাই বা অপরাধে জড়িয়েছে। তারপর সমুদ্রে যাওয়া শেখার পর একে নিয়ন্ত্রণের কৌশল রপ্ত করেছে। ধারণা করা হয়, স্বল্প ব্যয় ও সহজ সমুদ্রপথে যখন থেকে মানুষের যাতায়াত, তখন থেকেই জলদস্যুদের আবির্ভাব। কারও কারও মতে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জলদস্যুদের তথ্য-উপাত্ত প্রথম নথিভুক্ত হয়েছে। এজিয়ান সাগর থেকে আসা এই জলদস্যুদের বলা হতো 'সি পিওপল'। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা জলদস্যুদের শ্রেণিবদ্ধ 'সমুদ্রের মানুষ' বলে নথিভুক্ত করেছেন। এই নথিভুক্তদের দলে প্রাচীন গ্রিসের দস্যুরাও রয়েছে। মনে রাখতে হবে, এটি জলদস্যুদের প্রথম সম্ভাব্য নথিভুক্ত হওয়ার ঘটনামাত্র। যথাসম্ভব তাদের অস্তিত্ব আরও আগে থেকেই ছিল।
বিশ্বের প্রায় সব মহাদেশেই জলদস্যুদের নথিভুক্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকার জলদস্যুদের কথা লেখা রয়েছে। ইউরোপের কুখ্যাত জলদস্যু ভাইকিংদের নাম কে না জানে। এশিয়ায় ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও চীনের জলদস্যুরা। উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দর থেকে উদ্ভব ঘটে বারবারি করসাইর জলদস্যুদের। 'গোল্ডেন এজ অব পাইরেসি'র কথা সবাই জানেন, যখন ধনসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে আসা জলদস্যুরা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণ করেছিল।
জলদস্যু কারা
জলদস্যু কারা? কেন, কীভাবে তারা জলদস্যু হয়? এর উত্তরে প্রথমেই আসে নাবিকদের নাম। সমুদ্রের অতল জলরাশিকে সবচেয়ে বেশি জানে বা বুঝতে পারে নাবিকেরা। বছরের বেশির ভাগ সময় জলের ওপর ভেসে বেড়াতে হয় তাদের। এই নাবিকেরা বুঝতে পারে প্রায় 'বিনাশ্রমে' দ্রুত অর্থবিত্ত কামাইয়ের উৎকৃষ্ট উপায় হলো সমুদ্রগামী জাহাজগুলো লুণ্ঠন করা। এই চিন্তা থেকে তারা দস্যু হয়ে ওঠে। ব্ল্যাকবিয়ার্ড এবং ক্যালিকো জ্যাকের মতো কিংবদন্তি জলদস্যু এই পেশায় আসার আগে ছিলেন নাবিক। আবার না চাইলেও অনেককে বাধ্য হয়ে জলদস্যু হতে হয়েছে। অভিযান বা লড়াইয়ে অনেক বন্দীর জলদস্যুরা দাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করত। এরা যখন বুঝতে পারত এই জীবনে আর মুক্তি নেই, তখন নিয়তি মেনে নিয়ে নিজেরাই জলদস্যু হয়ে উঠত।
জলদস্যু হওয়ার সহজ উপায় হলো বন্ধুর হাত ধরা। রাতারাতি ভরপুর ধনসম্পদ লাভের আশায় নিজের জলদস্যু বন্ধুর হাত ধরে অনেকে এ পেশায় এসেছেন। নারী হলে কোনো পুরুষ জলদস্যুকে বিয়ে করে এ পেশায় নাম লিখিয়েছেন। ক্যালিকো জ্যাককে বিয়ে করেই কুখ্যাত জলদস্যু হয়ে উঠেছিলেন অ্যান বনি। জলদস্যুদের সামান্য অংশই সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবার থেকে এসেছে। অভাব ও দারিদ্র্য ঘোচাতেই বেশির ভাগ ডাকাত খোলা জলের জীবন বেছে নিয়েছে। তবে একবার জড়িয়ে পড়ার পর অথই জলরাশির আহ্বান আর ধনসম্পদের লোভ তাদের ঘরে ফেরাতে পারেনি।
জলদস্যুরা কী করত
জলদস্যুদের নিজেদের সম্পদ ছিল না। ফলে সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এ ছাড়া তাদের জীবন অচল। দামি-স্বর্ণালংকার তারা ছিনিয়ে নিত তো বটেই, সবচেয়ে বেশি নিত মামুলি জিনিস। চাল-ডাল, রুটি। জলদস্যুরা সমুদ্রেই দিনের পর দিন ভাসতে থাকত। এ জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ত প্রচুর খাবারের। তাজা খাবার, পানীয় এবং নৌকা বা জাহাজ চালানোর রসদ জোগাড় করায় সবচেয়ে প্রাধান্য দিত তারা। খাবারদাবার ফুরিয়ে গেলে এবং লুট করার মতো জাহাজ না পেলে উপকূলের কোনো গ্রাম বা দ্বীপে আক্রমণ চালাতেও দ্বিধা করত না। বিনোদনও আর সব জরুরি খাদ্যের মতোই একটি। ফলে শুধু বিনোদনের জন্যও তারা কখনো কখনো নির্দয় খেলায় মেতে উঠত।
জলদস্যুরা প্রচুর খেতে এবং ফুর্তি করতে পছন্দ করত। পার্টি, মৌজ-মাস্তি করতে পছন্দ করত তারা। এক রাতে সব আনন্দ উপভোগ করে ফেলার পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল। পরদিন কোন আক্রমণের মুখে পড়বে, তারা জানত না। আবার কখন ভালো খাবার পেটে পড়বে, তা-ও অনিশ্চিত। সমুদ্রে মাসের পর মাস থাকার ফলে খেতে হতো পচা-বাসি খাবার, নষ্ট পানি। জলদস্যুরা মদ খেতে পছন্দ করত। মদে বুঁদ হয়ে তারা কষ্টের দিন ভুলে থাকতে চাইত। ফলে একবার সুযোগ পেলে পার্টি সহজে শেষ হতো না।
এসব আনন্দ-ফুর্তি, অ্যাডভেঞ্চার এক পাশে সরিয়ে রেখে জলদস্যুদের মনোযোগ দিতে হতো জাহাজের দিকেও। যে জাহাজে ভর করে তারা ছুটে চলে, সেই জাহাজের মেরামত করা, পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি নিয়মিতই করতে হতো। ছিনতাই করা পণ্যের হেফাজত করা আরেক চ্যালেঞ্জিং কাজ।
জলদস্যুদের খাবার
ফিকশনের উসিলায় বেশির ভাগ মানুষের ধারণা হয়েছে, জলদস্যুরা যখন যা ইচ্ছা খেতে পারে। কিন্তু এই কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক রয়েছে। কয়েক মাস ধরে সমুদ্রে থাকার পর খাদ্য সরবরাহ কমে যায়। হিমায়িত করে রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় খাবার পচে-গলে যায়। মাংস, রুটি, দুগ্ধজাত খাবার সবই পচনশীল। এ কারণে প্রচুর লবণ দেওয়া মাংস বা গাজানো শাকসবজি খেতে হতো। সাওয়ার কাউট (প্রক্রিয়াজাত বাঁধাকপি), হাড়ের স্যুপ, লবণাক্ত মাংস, শক্ত রুটিÑএগুলোই মূলত তাদের খাদ্য।
বুদ্ধিমান জলদস্যুরা গবাদিপশু ডাকাতি করে আনত। গরু-ছাগল রেখে তারা নিয়মিত দুধ খেত। মুরগির মাধ্যমে হতো ডিমের সরবরাহ। সব খাদ্য পচে গেলে বা ফুরিয়ে গেলে শেষ খাবার হিসেবে থাকত এসবের তাজা মাংস।
জলদস্যুদের পানীয়
জলদস্যুদের পছন্দের পানীয় কী? অবশ্যই অ্যালকোহল। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের জলদস্যুরা প্রচুর রাম খেত। দ্বীপে চাষ হতো প্রচুর আখ। রামের উৎস সেসব আখ। বিয়ারও তাদের প্রিয় পানীয়। কখনো অন্য জাহাজে আক্রমণ করে আনতে পারলে ব্রান্ডি, ওয়াইনও জুটত। যেকোনো ধরনের অ্যালকোহল পেলে ওরা চুরি-ছিনতাই করতে ছাড়ত না। ছবিতে জলদস্যুদের সোনাদানা চুরি করতে দেখা যায়। বাস্তবে ওরা মদের জন্য হীরা-জহরতও ছাড়তে রাজি।
মনে হতে পারে, সি-ফুড বুঝি জলদস্যুদের প্রিয় খাবার। বাস্তবে ওরা বড়শি নিয়ে মাছ ধরার ফুরসত পেত খুব কম। এক কামড় পুষ্টিকর খাবার জোগাড়ের জন্য দিনভর মাছ ধরাকে ওরা নির্বোধের কাজ মনে করত। তবে বৈরী সময়ে সবকিছুই যে করতে হতো, তাতে সন্দেহ নেই। প্রধানত ওরা অন্য জাহাজ থেকে লুট করে নিয়ে আসা খাবারই খেত।
জলদস্যুদের গোসল ও ঘুম
ক্যাপ্টেন বা নিদেনপক্ষে ক্রদের মধ্যে হোমরাচোমরা কেউ হলে কেবিন পাওয়া যেত ঘুমানোর জন্য। নয়তো আরও অনেকের সঙ্গে খোলা কোনো জায়গায় মাথা পাতার জায়গা মিলত জলদস্যুদের। তবে বেশির ভাগই মেঝের তুলনায় হ্যামকে (দড়ি বা কাপড়ের দোলনার মতো বিছানা) ঘুমানোকে প্রাধান্য দিত। ঢেউয়ের তালে তালে দোলার কারণে ঘুমে সুবিধা হয় এতে।
জলদস্যুদের পরিচ্ছন্নতা
জলদস্যুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কোনো ব্যবস্থা বা গরজ কোনোটাই ছিল না। একে তাদের কাছে পানির সুবিশাল মজুত থাকত না। যা থাকত, তা শুধু পান করার জন্য। তাই অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন জীবন বা গায়ের দুর্গন্ধ নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। প্রাচীন নথিপত্রে উল্লেখ আছে, জলদস্যুরা সমুদ্রের পানিতে নামত। তবে তা গোসলের জন্য নয়। গা ঠান্ডা করার জন্য। দুর্গন্ধ নিয়ে তারা থোড়াই কেয়ার করত। এবং দাঁত ব্রাশ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করত না।
তাজা খাবার, পর্যাপ্ত পানি পান, গোসল করা, মলমূত্র থেকে পরিষ্কার থাকা এবং গভীর ঘুমের চিন্তা আমরা করতে পারি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু জলদস্যুদের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্নতর। পরিবার থেকে বহুদূরের দীর্ঘদিনের সফরে তাদের এসব নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
জলদস্যুরা সাধারণত দীর্ঘ জীবন পেত না। দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি, অসুস্থদের স্পর্শে আসা, অনাহার, বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া, শরীরের পানিশূন্যতা ইত্যাদি কারণে তারা দ্রুত মারা যেত। অন্য জাহাজে ডাকাতি করতে গিয়ে আহত বা নিহত হয়ে মৃত্যু ঘটা সাধারণ বিষয়। লড়াই মানেই তলোয়ারের কোপ বা বন্দুকের গুলি কারও না কারও গায়ে লাগা। কখনো গভীর ক্ষত নিয়ে ফিরে আসতে হতো। রক্তক্ষরণ বা ক্ষতের সংক্রমণ তাদের ঘায়েল করে ছাড়ত। কখনো জাহাজের দিকে ছুটে আসত কামানের গোলা, কখনো তীব্র ঝড়ে পড়ত জাহাজ, কখনো পাথরে আঘাত লেগে উল্টে যেত, এসবের কারণে স্বল্পায়ু হতো জলদস্যুরা। আর ধরা পড়লে? ঝুলিয়ে দেওয়া হতো ফাঁসিতে। আক্ষরিক অর্থেই তখন তারা হতো পাখির খাবার।
জলদস্যুদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগ ছিল স্কার্ভি। এ রোগে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পিঠ বেঁকে যায়। চামড়ায় দাগ পড়ে। মাড়ি ফুলে যায়। চুল ও দাঁত ক্ষয়ে যায়। চলাফেরায় অস্থিরতা তৈরি হয়। এই রোগটা হয় খাবারে ভিটামিন সি-এর অভাবে। কয়েক মাস সমুদ্রে থাকার কারণে ভিটামিন সি-যুক্ত খাবারের ঘাটতি তৈরি হয়। এতে শরীরে স্কার্ভি বাসা বাঁধে। একসময় এটাই হয় মরণব্যাধি।
আমাশয় আরেকটি সাধারণ 'জলদস্যু রোগ'। দূষিত খাবার এবং নোংরা পানি খাওয়ার কারণে এটি হয়। জলদস্যুদের অনেক জাহাজেই এই রোগের আলামত পাওয়া গেছে।