হর্নিগোল্ডের বিচিত্র জীবন ছিল জলদস্যু, হলো জলদস্যুশিকারি
ব্রিটিশ জলদস্যু বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের চারণক্ষেত্র ছিল মধ্য ক্যারিবিয়ান এবং উত্তর আটলান্টিক। ১৭১৬ থেকে ১৭১৭ পর্যন্ত তৎপরতা চালিয়ে গোটা এলাকাজুড়ে 'নাম' (নাকি 'দুর্নাম') কিনেছিল। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, ব্ল্যাকবিয়ার্ড (মৃত্যু ১৭১৮) নামে পরিচিত এডওয়ার্ড টিচকে জলদস্যুবৃত্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এই হর্নিগোল্ড। শিষ্যের নামেই এভাবে ওস্তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়। সরকারি ক্ষমা ঘোষণার সুযোগে হর্নিগোল্ড জলদস্যুগিরি ছেড়েছুড়ে ভালো হয়ে যায়। এতটাই ভালো হয়ে যায় যে বাহামার সরকার হর্নিগোল্ডকে অন্যান্য জলদস্যুকে পাকড়াও করতে অর্থাৎ জলদস্যু শিকারে নিয়োগ করে। এ দায়িত্ব ওস্তাদির সাথেই পালন করে হর্নিগোল্ড। ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে জাহাজডুবির পর একটি জনমানবহীন দ্বীপে বেঘোরে প্রাণ হারায় হর্নিগোল্ড।
'এ জেনারেল হিস্টোরি অব দ্য রবারিস অ্যান্ড মার্ডারস অব দ্য মোস্ট নটোরিয়াস পাইরেটস' বইটি প্রকাশিত হয় ১৭২০-এর দশকে। চালর্স জনসনের নামে বইটি প্রকাশিত হলেও আসল লেখক ড্যানিয়েল ডাফো, বলা হয়। এই বইয়ে হর্নিগোল্ডের কাহিনি তুলে ধরা হলে 'খ্যাতিমান' জলদস্যু হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া জলদস্যুদের বিচারসংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে বাহমার গভর্নরের পক্ষ নিয়ে তার জলদস্যুশিকারিতে রূপান্তরের জীবনপর্ব সম্পর্কে জানা গেছে।
কথিত জলদস্যুর সোনালি যুগে অন্যান্য জলদস্যুর মতো হর্নিগোল্ডের আস্তানা গড়ে উঠেছিল বাহামার নিউ প্রভিডেন্স দ্বীপে। স্পেন এবং পর্তুগিজ জাহাজে হামলা চালানোর অনুমতি তাকে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ভাড়াটে নৌসেনা বা প্রাইভেটিয়ার হিসেবে এভাবেই জলদস্যুজীবনের হাতেখড়ি হয় তার। ১৭১৩ থেকে ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই জলদস্যু হিসেবে নিজের শিকড় পোক্ত করে ফেলে। বাহামার এ আস্তানা জলদস্যুদের ডেরা হিসেবে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ীরা এখানে জড়ো হতো জলদস্যুদের লুটের মালামাল জুতসই দামে কেনার মতলবে। অন্যদিকে এখানেই ডাঙার জীবনের দুই 'মদ- নারী' নিয়ে মেতে উঠতে আর গানের হুল্লোড়ে গা ভাসিয়ে দিতে পারত জলদস্যুরা।
হর্নিগোল্ডের চেলাচামুন্ডা জলদস্যুদের অনেকেই পরে বেশ 'নামধাম' কামিয়েছিল। এদের একজন হলো স্যামুয়েল বেলামাই (মৃত্যু ১৭১৭)। আট কামান বসানো দখল করা জাহাজ মেরি অ্যান এই সুযোগ্য শিষ্যকে উপহার দিয়েছিল হর্নিগোল্ড। বেলমাইয়ের মতো জলদস্যুদের গুলিতে বা ফাঁসিতে মৃত্যুই স্বাভাবিক হলেও তার বরাতে তেমন মরণ জোটেনি। বরং কেপ কডের কাছে ঝড়ে মারা যায় বেচারা। হর্নিগোল্ডের আরেকজন 'খ্যাতিমান' সহযোগী হলো ফরাসি জলদস্যু অলিভিয়ার লা বুশ।
জলদস্যু সরদারের আওতায় সাধারণভাবে কয়েকটি জাহাজের একটি বহর থাকে। হর্নিগোল্ড এর ব্যতিক্রম নয়। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে তার চেলা ইংরেজ জলদস্যু এডওয়ার্ড টিচকে দলের দ্বিতীয় সরদার বা উপপ্রধান বানায়। তখনো তার 'খ্যাতি' নিয়ে গালগল্প তেমন একটা শোনা যায়নি। হর্নিগোল্ডের এই ইংরেজ চেলা পরবর্তীকালে ইতিহাসে ব্ল্যাকবিয়ার্ড হিসেবে স্থান করে নেয়।
টিচ আগের বছরই বাহামায় হর্নিগোল্ডের জলদস্যুর দলে যোগ দেয়। ছিনিয়ে আনা ছোট একটা জাহাজের সরদার বা কাপ্তান বানিয়ে দেওয়া হলো তাকে। এরপর হর্নিগোল্ড এবং টিচ একযোগের জলদস্যুবৃত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্যারিবিয়ান এবং উত্তর আমেরিকার উপকূলজুড়ে যাতায়াতকারী জাহাজে হামলা এবং লুটপাটে বড় ধরনের সাফল্য পেতে থাকে দুই জলদস্যু সরদার। হর্নিগোল্ড এবং টিচ সহযোগী হিসেবে ডাকাতি চালাতে থাকে। দুজনের নিজ নিজ ডাকাতির মালের সমান ভাগ অপরকে দিত। হয়তো হামলার সময় একজনের জাহাজ অকুস্থলেই ছিল না। তাতেও ভাগ পেতে কোনো অসুবিধা হতো না। কিউবা, বারমুডা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং উত্তর আমেরিকাগামী অনেক জাহাজ তাদের শিকার হয়েছে। মদের পিপে বা ময়দার পিপের মতো নিত্যপণ্য কিন্তু দামি হিসেবে বিবেচিত মালামালও লুট করত এই দুই জলদস্যুরা।
ফরাসি বাণিজ্যিক জাহাজ কনকর্ড আফ্রিকার নানা বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে স্বর্ণ রেণু, মুদ্রা, রতœ এবং অন্যান্য মূল্যবান পণ্য নিয়ে মার্টিনিকে যাওয়ার পথে হর্নিগোল্ড এবং টিচের শিকারে পরিণত হয়। ১৭১৭-এর দিকে সেন্ট ভিনসেন্টের কাছাকাছি এ জাহাজকে কবজা করে টিচ। লুটের পণ্যগুলো টিচ, হর্নিগোল্ড এবং তাদের দলের জলদস্যুদের মধ্যে ভাগ করা হয়। দখল করা জাহাজটি নাম বদলে কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ রাখে টিচ। এতে ৪০টি কামান বসায়। ফলে কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ নৌবাহিনীর অনেক জাহাজের মতোই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এদিকে টিচ এরই মধ্যে ব্ল্যাকবিয়ার্ড নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কুইন অ্যানস রিভেঞ্জকে ডাকাতির কাজে লাগিয়ে ওস্তাদকে ছাড়িয়ে যায়। হনিগোল্ডের চেয়েও দুর্ধর্ষ জল-ডাকাত সরদার হয়ে ওঠে।
এর কিছু পরেই দুজনে দুটি পথ বেছে নেয়। ঝগড়া-বিবাদ বা রেষারেষি না করে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ড উত্তর আমেরিকার সাগরে ডাকাতিতে চলে যায়। অন্যদিকে হর্নিগোল্ড ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে চালিয়ে যায় ডাকাতি। ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর দুই জাহাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ১৭১৮ খ্রিষ্টাব্দে নিহত হওয়ার মাধ্যমে দস্যুসুলভ মৃত্যু ঘটে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের।
জলদস্যু সর্দার হর্নিগোল্ড রাজক্ষমার পুরো সুযোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে সাগরে ডাকাতির ঘটনাবলিকে খুব গ্রাহ্য করেনি মার্কিন উপনিবেশ এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অনেক গভর্নর এবং কর্মকর্তা। কেউ কেউ নিজেরাই এসব তৎপরতায় জড়িত ছিল। জলদস্যুদের মালামাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে সস্তায় কেনা যেত। তাতেই অনেকে খুশি ছিল। ১৭১০-এর দশকের শেষ ভাগে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছিল। সাগরে ডাকাতি, জলদস্যুর তৎপরতা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার এবং সৎ ব্যবসায়ীদের দলবল গভর্নরদের ওপর চাপ দিতে থাকে। এ কারণেই ব্রিটিশ রাজা প্রথম জর্জ (শাসনামল ১৭১৪ থেকে ১৭২৭) জলদস্যুদের জন্য রাজক্ষমা ঘোষণা করেন। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বরে এ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, যারা জলদস্যুবৃত্তি ত্যাগ করবে, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে। জ্যামাইকার গভর্নর পিটার হেওয়ার্ডের পাঠানো একটি জাহাজের মাধ্যমে হর্নিগোল্ড এ ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে। রাজক্ষমাকে গ্রহণ করবে জানিয়ে ভুল বানানে চিঠি দেয় হর্নিগোল্ড।
১৭১৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হর্নিগোল্ড বাহমার গভর্নর উডস রজার্সের (১৬৭৯-১৭৩২) কাছ থেকে ক্ষমা গ্রহণ করে হর্নিগোল্ড। একই সাথে নতুন করে জীবন শুরু করবে বলে প্রতিশ্রুতিও দেয়। জলদস্যুরা ভালো মানুষ হতে শুরু করলে তার ফল বাহামার জন্য মোটেও ভালো হয় না। জলদস্যু দল নেই, নেই চোরাই মালের ব্যবসা। উপনিবেশগুলোর কাছে বাহমা নিজ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পরিণামে খোদ রজার্সই দেউলিয়া হয়ে যায়।
জলদস্যু দলের সবাই রাজক্ষমা গ্রহণ করেনি বা ডাকাতি ছেড়েছুড়ে সাদামাটা জীবনে ফিরে আসেনি। কিন্তু সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যে স্বাভাবিক জীবনে যে ফিরে এসেছে, হর্নিগোল্ড তা প্রমাণ করার সুযোগ পায়। জলদস্যুদের মধ্যে যারা রাজক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করেনি এবং ডাকাতি পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের ধরার জন্য বা জলদস্যুশিকারি হিসেবে হর্নিগোল্ডকে নিয়োগ দেন গভর্নর রজার্স। ইংরেজ জলদস্যু চালর্স ভেইন গভর্নরের প্রথম লক্ষ্যে পরিণত হয়। ১৭১৮ সালে নিউ প্রভিডেন্স বন্দর থেকে ভেগে যাওয়ার সময় রজার্সের জাহাজ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। ভেইন দ্রুতগামী জাহাজ ব্যবহার করত। তাকে তাড়া করা হর্নিগোল্ডের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। কিন্তু কপালের ফেরে ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে ভেইনের জাহাজডুবি ঘটে। ডুবে মরার হাত থেকে উদ্ধার পেলেও তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। পরের বছর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
এবারে জন অগার বা অগর নামের এক জলদস্যুকে পাকড়াও করার দায়িত্ব হর্নিগোল্ডকে দেওয়া হয়। অগার তখন তিন সরবরাহকারী জাহাজ ছিনতাই করেছিল। এসব জাহাজ নিউ প্রভিডেন্স থেকে ছিনতাই করা হয়। এর আগে অগার রাজক্ষমা লাভ করেছিল। কিন্তু তারপরও জলদস্যু জীবনের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাজক্ষমাকে অবজ্ঞা করে সে আবার জলদস্যুর জীবনে ফিরে যায়। তার এ কর্মকা-কে রাজক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার হিসেবে গণ্য করা হয়। গভর্নর রজার্স এ কারণে অগারকে উদাহরণমূলক শাস্তি দিতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। অগারকে তাড়া করার জন্য একটি জাহাজের নেতৃত্ব দেয় হর্নিগোল্ড। অপর জাহাজ ছিল ক্যাপ্টেন ককরামের নিয়ন্ত্রণে। লং আইল্যান্ডে অগারের জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। সে ধরা পড়ে।
অগারসহ কয়েকজন জলদস্যুকে পাকড়াও করে নিউ প্রভিডেন্সে ফিরে আসে হর্নিগোল্ড। জলদস্যুদের রেহাই দেওয়া হবে না। তাদের আটক করা হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করা হবে। নিজের এ সিদ্ধান্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করার সুযোগ পায় রর্জাস। নাসাউতে তাদের বিচার হয়। বিচারে নেতৃত্ব দেন রজার্স। বিচারে ১০ জলদস্যুর মধ্যে ৯ জনকেই প্রাণদ- দেওয়া হয়। অনেক সাক্ষী এবং আলামত থাকার পরও জলদস্যুরা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে। ছাড়া পায় শুধু জন হিপস নামের এক জলদস্যু। এ জলদস্যু বিচারকদের বোঝাতে সক্ষম হয়, জলদস্যু দলে সে নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছিল।
অগারকে পাকড়াও করতে সফলতা লাভ করায় হর্নিগোল্ড গভর্নর রজার্সের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। মেক্সিকোর বিভিন্ন বন্দরের সাথে বাণিজ্য করার জন্য হর্নিগোল্ডকে পাঠানো হয়। এই সফর হর্নিগোল্ডের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। হর্নিগোল্ডের জাহাজ একটি ডুবো প্রবালপ্রাচীরের সাথে ধাক্কা খায়। হর্নিগোল্ডসহ কয়েকজন জনমানবহীন দ্বীপে আটকা পড়ে। তাদের মধ্যে পাঁচজন একটি ক্যানো তৈরি করে পালাতে পারলেও হর্নিগোল্ড আটকাই থেকে যায়। শেষ অবধি নির্জন দ্বীপটিতে প্রাণ হারায় হর্নিগোল্ড। বার্থোলোমিউ রবার্টসের মতো জলদস্যুদের পর্যায়ে সফলতা অর্জন করেনি হর্নিগোল্ড। তারপরও মানুষ তাকে ভুলে যায়নি। মানুষের কল্পজগতে এখনো তার স্থান রয়েছে। তারা আছেন ভিডিও গেম অ্যাসাসিনস ক্রিড ওঠ: ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ এবং টিভি শো ব্ল্যাক সেইলসে।