ব্যর্থ ভ্যান গখ
অপূর্ণ ভালোবাসা
ভ্যান গখের জীবনের প্রেমের গল্প ছিল কেবল ধাক্কা আর প্রত্যাখ্যানের। নিজের দিক থেকে কখনোই কোনো কমতি রাখার চেষ্টা করেননি তিনি, সম্পর্কে জড়ানোর আগ্রহও ছিল প্রচণ্ড, কিন্তু কখনোই ভালোবাসা এসে ধরা দেয়নি তার হাতে। জীবনে ব্যর্থ চিত্রকার বারবার নিজের প্রেমের জীবনেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। কী ছিল কারণ?
না, কখনোই না
২৮ বছর বয়সী ভিনসেন্ট একবার তার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সেবারই তার সাথে পরিচয় হলো তার এক কাজিন কি ভস-স্ট্রিকারের সাথে। বোন সবেমাত্র বিধবা হয়েছেন, স্বামীহারা সেই বোনকেই পছন্দ করে ফেললেন ভিনসেন্ট। যদিও ভিনসেন্টকে মোটেই স্বামী হিসেবে কল্পনা করতে পারেননি কি। ফলে ভিনসেন্টের একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব কি ফিরিয়ে দিতে থাকলেন, 'না, কখনোই না' বলে।
সিয়েনের সাথে
কিয়ের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ১ বছরের মাথায় ভিনসেন্ট আবারো প্রেমে পড়লেন, এবার এক অন্তঃসত্ত্বা যৌনকর্মীর সাথে। সিয়েন নামের সেই মহিলার এক ছোট মেয়েও ছিল। ভিনসেন্ট তাদের দুজনকে নিজের ছোট স্টুডিওতে ওঠালেন। বেশ কিছুদিন সবকিছু ভালোই চলছিল, বিশেষ করে সিয়েন দ্বিতীয়বার মা হওয়ার পর দুই বাচ্চার সাথেই বেশ ভালো খাতির জমিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু বাগড়া বাধাল স্বয়ং সিয়েনই। আবারো যৌনকর্মীর কাজ শুরু করলে মনে বেশ আঘাত পান ভ্যান গখ। ভগ্নহৃদয় নিয়েই স্টুডিও থেকে নিজের আঁকার রং-তুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন গন্তব্যে।
"ভালোবাসা ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়"
"আমি ভাবতে থাকলাম, আমি নারীসঙ্গ পেতে চাই। ভালোবাসা ছাড়া, কোনো নারী ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অসীম কোনোকিছু, গভীর কোনোকিছু, আসল কোনোকিছু ছাড়া এই জীবনের কোনো মানেই নেই আমার কাছে।"—১৮৮১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ভাই থিওর কাছে এটেন থেকে পাঠানো চিঠিতে ভিনসেন্ট।
প্রতিবেশীর প্রণয়
১৮৮৪ সাল। ৩১ বছর বয়সী ভিনসেন্ট ফিরে গেলেন ন্যুনেনে, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য। দ্রুতই ভ্যান গখ আবারো প্রেমে পড়লেন, এবার এক প্রতিবেশীর মেয়ের সাথে, নাম মার্গো। মার্গোও ভিনসেন্টের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু মার্গোর পরিবার ভিনসেন্টের মতো কারো কাছে মেয়েকে ছাড়তে চায়নি। এদিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল দুজনের প্রেমের কথা। দুজনের নামে বাজে সব কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন মার্গো। বিষ খেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও দুজনের সম্পর্ক আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ভালোবাসার শহরে
ভালোবাসার খোঁজে ভিনসেন্ট এবার এলেন ভালোবাসার শহরে। প্রেমে চরমভাবে ব্যর্থ ব্যক্তিও প্যারিসে এসে নতুন ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার আশা করতে পারে। ব্যতিক্রম ছিলেন না ভিনসেন্ট ভ্যান গখও। প্যারিসের 'লা ট্যাম্বুরিন' রেস্তোরাঁয় খুঁজে পেলেন তাকে। প্রণয়িনী? স্বয়ং রেস্তোরাঁর মালিক আগোস্তিনা সেগাতোরি। নিয়মিতভাবেই আগোস্তিনাকে দেখবার ছলে রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারতেন ভিনসেন্ট। আগোস্তিনাকে যে দারুণ পছন্দ করতেন, সে প্রমাণ মেলে তার ছবিতেই। মাত্র চার মাস রেস্তোরাঁমালিকের সাথে সময় কাটিয়েছেন, এই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রণয়িনীর বেশ কিছু ছবি এঁকে ফেলেছিলেন ভ্যান গখ। তবে অন্য সব প্রেমের মতোই এটিও ব্যর্থ হলো। আগোস্তিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সন্দেহ করতে থাকলেন, এর কারণ হয়তো গর্ভপাত। ফলে এখান থেকেও ব্যর্থ মন নিয়ে ফেরত গেলেন ব্যর্থ চিত্রকর।
স্বীকারোক্তি
প্যারিসে দুই বছর কাটানোর পর ভূমধ্যসাগরের কোলঘেঁষা শহর আর্লের হলুদ বাড়িতে উঠলেন ভিনসেন্ট। বারবার প্রত্যাখ্যাত আর ব্যর্থ হওয়া ৩৫ বছর বয়সী ভিনসেন্ট নিজের ভাগ্যকে মেনে নিলেন। তার অস্থির মন আর খামখেয়ালিপূর্ণ জীবন যে কোনো নারীর সাথে স্থায়ী গাঁটছড়া বাঁধার জন্য যথেষ্ট নয়, তা অনুধাবন করা শুরু করলেন ভ্যান গখ।
শিল্প অনুরক্ত ভিনসেন্ট
সাগর থেকে ভেসে আসা আর্লের মুক্ত বাতাসে ভিনসেন্ট তার জীবনের আসল ভালোবাসা খুঁজে পেলেন। আর্লের প্রাচুর্যপূর্ণ প্রকৃতিতে হারিয়ে গেলেন ভ্যান গখ। নিজের সেরা সব ছবিগুলো এ সময়েই এঁকেছিলেন তিনি। "প্রকৃতি আর নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব না করলেই আমার মন খারাপ হয়ে থাকে"—১৮৮২ সালের ২৬ জুলাই ভাই থিওর কাছে লিখেছিলেন ভিনসেন্ট।