ভ্যান গখ 'দ্য স্টারি নাইট' এঁকেছিলেন আইফেল টাওয়ার দেখে! দাবি বিশেষজ্ঞের
ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখের আঁকা 'দ্য স্টারি নাইট' দুনিয়ার সবচেয়ে আলোচিত ও রহস্যময় চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একটি। বছরের পর বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা ভ্যান গখের দ্য স্টারি নাইট আঁকার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের সাঁ-রেমি প্রদেশের একটি আশ্রমে ভর্তি থাকার সময় ১৮৮৯ সালে তেলরঙে এই ছবিটি আঁকেন ভ্যান গখ।
পর্বতের পাদদেশে একটি গ্রাম, রাতের তারাভরা আকাশের নিচে সাইপ্রাস গাছ, গ্রামের বাড়িঘর- এমন একটি বিমূর্ত দৃশ্যের অবতারণা করেছেন শিল্পী। আশ্রমে নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে দেখা দৃশ্যপট নিয়ে সিরিজ আকারে কিছু ছবি এঁকেছিলেন ভ্যান গখ, তার মধ্যে স্টারি নাইট একটি।
সম্প্রতি শিল্প ইতিহাসবিদ ও সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সাবেক শিল্প সমালোচক অধ্যাপক জেমস হল বলেছেন, তিনি মনে করেন ভ্যান গখের দ্য স্টারি নাইট আঁকার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার।
জেমস হল বলেন, ভ্যান গখ তার একাধারে এই চিত্রকর্মগুলো আঁকতে শুরু করেন ১৮৮৯ সালের জুনের দিকে। এর কিছুদিন আগেই মাত্র আইফেল টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছিল। উদ্বোধনের দিন ইলেক্ট্রিক বাতি-ঝলমলে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি পোড়ানো হয়েছিল এই আইফেল টাওয়ারকে ঘিরে। সেই একই বিষয়গুলো ভ্যান গঘের আঁকা ছবিতে 'আকাশ, তারকারাজি ও মেঘ' হয়ে ফুটে উঠেছে বলে দাবি করেন অধ্যাপক হল।
তিনি আরও বলেন, "ভ্যান গখের কাছে সাইপ্রাস গাছ ছিল আইফেল টাওয়ারেরই একটি প্রাকৃতিক বিকল্প; যা তার ছবির কেন্দ্রীয় বিষয়। আইফেল টাওয়ার উদ্বোধনের দিন যে লাইট শো দেখানো হয়েছিল, দ্য স্টারি নাইটের মধ্যে তারই একটি গ্রামীণ-মহাজাগতিক প্রতিরূপ প্রকাশ পেয়েছে।"
১৮৮৯ সালে ভ্যান গখ তার ভাই থিওকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "সাইপ্রাস গাছগুলো এখনও আমাকে আবিষ্ট করে রাখে, আমি এগুলোকে নিয়ে সূর্যমুখীর ক্যানভাসের মতো কিছু একটা করতে চাই। কারণ আমি এগুলোকে যেভাবে দেখি, সেভাবে আজ পর্যন্ত আর কেউই আঁকেনি। লাইন ও অনুপাতের দিক থেকে, যেন মিশরীয় ওবেলিস্কের মতোই এগুলো সুন্দর।"
জেমস হল বলেন, "আইফেল টাওয়ারকে ফরাসি প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রতীক হিসেবে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এটি পিরামিডের চেয়েও বেশি চিত্তাকর্ষক। ভ্যান গখ প্রাচীন মিশরকে আদর্শ ধরেছিলেন এবং তিনি ভাবতেন সাইপ্রাস গাছ একটি ওবেলিস্কের মতোই সুন্দর এবং সুসমন্বিত।
জেমস হল আরও উল্লেখ করেন, ১৮৮৬ সালের দিকে- যখন ভ্যান গখ সবেমাত্র প্যারিসে পা রেখেছেন, তখন এই মন্যুমেন্ট নির্মাণের জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয় এবং শেষ পর্যন্ত গুস্তাভ আইফেলের দেওয়া রট আয়রনের-খোলা ঝাঁঝরির মতো নকশাটি নির্বাচিত হয়। সেই সঙ্গে আইফেল টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি সব তথ্যই সারাক্ষণ খবরে প্রচার করা হয়।
১৮৮৭ সালে প্যারিসের একটি সংবাদপত্রে খ্যাতনামা শিল্পী ও লেখকদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রকাশ করা হয়, যেখানে তারা আইফেল টাওয়ারকে 'মাথা ঘুরানোর মতো অদ্ভুত একটি টাওয়ার' হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এদিকে ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্যান গখ প্যারিস ছেড়ে যাওয়ার সময়ই আইফেল টাওয়ারের নির্মাণকাজ আকাশ ছুঁয়েছিল।
১৮৮৮ সালে একজন অফিসিয়াল গাইড প্রচার করেছিলেন যে, পিরামিড নির্মিত হয়েছে শোষিত দাসদের দ্বারা, কিন্তু আইফেল টাওয়া্র 'বিশুদ্ধ বিজ্ঞান, মর্যাদাপূর্ণ শিল্প ও শ্রমের স্বাধীনতা'র প্রতীক। লে মনদে ইলাস্ত্রে (যে পত্রিকা ভ্যান গখ সাঁ-রেমিতে বসে পড়তেন) এবং অন্যান্য সব জার্নাল ও সংবাদপত্র আইফেল টাওয়ার উদ্বোধন নিয়ে চমকপ্রদ সব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
হল লিখেছেন- "আইফেল টাওয়ার নামক ধাতব দৈত্যের নির্মাণ- যা মিশরীয় পিরামিডকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল- তার বিপরীতে প্রকৃতির ও ইতিহাসের একটি জবাবস্বরূপ দ্য স্টারি নাইট এঁকেছিলেন ভ্যান গখ। ৩০০ মিটার (শীর্ষসহ ৩৩০ মিটার) উচ্চতার আইফেল টাওয়ার যেমন প্যারিসের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, সাইপ্রাস গাছও তেমনই সাঁ-রেমি ও এর গির্জার চূড়ায় আধিপত্য বজায় রাখে।
"সাইপ্রাস গাছের অংশটিই শিল্পী প্রথম এঁকেছিলেন দ্য স্টারি নাইটে। এর ভিত্তিতে রয়েছে আরও একটি ছোট গাছ, যা এটিকে আরও বেশি পিরামিডসদৃশ করে তোলে এবং আইফেল টাওয়ারের সঙ্গেও সঙ্গতি বজায় রাখে। ভ্যান গখের আকা 'হুইট ফিল্ড উইথ সাইপ্রাসেস' ছবিতেও একই ব্যাপার দেখা যায়। এই ছবিতেও ভ্যান গখ বড় ও ছোট সাইপ্রাস গাছের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা রেখেছেন, এতে মনে হয় দুটি গাছ টাওয়ারের পায়ের মতোই একে অপরের গায়ে ঝুঁকে আছে", বলেন জেমস হল।
অধ্যাপক জেমস হলের লেখা বইগুলোর মধ্যে একটি হলো 'দ্য আর্টিস্ট'স স্টুডিও: আ কালচারাল হিস্টোরি'। তিনি সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ প্রফেসর। তার গবেষণাকর্ম বার্লিংটন ম্যাগাজিনের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।