আর্ট জালিয়াত, যার নাম হয়েছিল রবিন হুড!
সাম্প্রতিক সময়ের চিত্রশিল্পের জগতে সাড়া পড়ে গেছে একজন মাত্র ব্যক্তির সু(!)কর্মে। আর্ট মার্কেটে চলছে বিশৃঙ্খলা, কেননা সেই মানুষটির আঁকা নকল ছবি এখনও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এসবেই কিন্তু শেষ নয়...'আর্ট জগতের রবিন হুড'-কে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে খোদ নিউ ইয়র্কে!
তার নাম?
উলফগ্যাং বেলট্রাচ্চি।
হাসিখুশি এই মানুষটাকে দেখে যেমন মনে হয়, তার বেড়ে ওঠা তেমন কিছু ছিল না। ৬৪ বছর বয়সী উলফগ্যাংকে যে আপনি কী বলে ডাকবেন, তা নিজেই বুঝতে পারবেন না। অসম্ভব প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী? তা তো তিনি বটেই। আবার তাকে এই 'শতাব্দীর সেরা নকলবাজ' বললেও কেউ দুষতে পারবে না আপনাকে। সম্ভবত সেরা উপাধিটি দিয়েছেন তার গ্যালারিস্ট, কার্টিস ব্রিগস। উলফগ্যাংকে তিনি বলেছেন আর্ট জগতের রবিন হুড।
২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট নিউ ইয়র্কে শুরু হয়েছিল 'বেলট্রাচ্চি দি আর্ট অভ ফরজারি' নামক ডকুমেন্টারির প্রদর্শনী। তার আগের বছর নানা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানোও হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলে কে এই উলফগ্যাং বেলট্রাচ্চি?
প্রায় সাড়ে তিন দশক হলো, বেলট্রাচ্চি সম্ভবত তিনশর বেশি ছবি এঁকেছেন প্রখ্যাত সব চিত্রবিদদের স্টাইল অনুকরণ করে। তাদের মাঝে আছেন পিকাসো, গগাঁ, মনে। সমস্যা একটাই—এসব ছবির নিচে 'ভুলক্রমে' বেলট্রাচ্চি সই করেছেন তাদেরই নাম, নিজেরটা না। আর তারপর: স্ত্রীকে বলে দিতেন সেগুলো বিক্রি করতে!
স্বামী-স্ত্রী মিলে একটা দারুণ গল্পও ফেঁদেছিলেন তারা। কীভাবে এই প্রখ্যাত শিল্পীদের অজানা ছবি তাদের হাতে এল, এই প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন: পারিবারিক সংগ্রহে ছিল ওগুলো। এমনকি পুরনো দেখতে কিছু ছবিরও ব্যবস্থা করেছিলেন প্রমাণ হিসেবে দেখাবার জন্য। 'ওই সংগ্রহের জন্য আঠা আমি নিজ হাতে বানাতাম। ব্যবহার করতাম হাড় আর জৈব পদার্থ, যাতে কেউ ধরতে না পারে,' বেলট্রাচ্চি জানান।
'বড় বড় জাদুঘরে গিয়ে আমার হাতের কাজ দেখতে খুবই ভালো লাগত, এমনকি মোমাও বাদ পড়েনি (মোমা: দ্য মিউজিয়াম অভ মর্ডান আর্ট)!' চোখ টিপে বলেন তিনি।
এখনও তার অঙ্কিত প্রায় আড়াই শতাধিক ছবির কোনো হদিস নেই। তবে জানা কথা, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে সেগুলো। অনেক ক্রেতাই আজ জানে, তারা নকল ছবি কিনেছে। তারপরেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। হাজার হলেও এই ব্যবসায় লেনদেনের পরিমাণ যে মিলিয়নকে মিলিয়ন ডলার।
বেলট্রাচ্চির হাতের কাজ সত্যিই দারুণ। এতটাই যে, ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো মূল শিল্পীকেই ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। তাই তো ম্যাক্স আর্নস্টের বিধবা স্ত্রী মন্তব্য করেছেন: বেলট্রাচ্চি তার স্বামীর সবচাইতে সুন্দর বনটি এঁকেছেন! বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে ছবিগুলো সত্যিকারের মাস্টারপিস।
তবে কথায় আছে না চোরের দশদিন তো গেরস্তের একদিন? কখনও-না-কখনও তো বেলট্রাচ্চিকে ধরা পড়তেই হতো। ধরা তিনি পড়েছেনও, তবে তার দায় কিন্তু পুরোপুরি তার নিজের। হাইনরিখ ক্যাম্পেনডঙ্কের ১৯১৪ সালে আঁকা ছবি বলে চালিয়ে দিতে গিয়ে নিজের আঁকা ছবিটিতে তিনি ব্যবহার করেন 'টাইটেনিয়াম হোয়াইট'; অথচ ওই আমলে রঙটি আবিষ্কৃতই হয়নি।
তাই বলা যায়: নিজের প্রতিভাই বেলট্রাচ্চির জন্য ফাঁদে পরিণত হয়েছিল।
২০১১ সালে তাকে ছয় বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তার স্ত্রীকে চার বছরের। বিচারের আগে কলোনের একটা জেলখানায় রাখা হয়েছিল এই রবিনহুডকে। সেখানে তিনি পাগলের মতো ছবি আঁকেন। ২০১৫ জানুয়ারির ৮ তারিখে সাজা সংক্ষিপ্ত হওয়ায় ছাড়া পান ভদ্রলোক, তারপরেও আঁকা চালিয়ে যান।
তার আঁকা বিভিন্ন ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করা হয় মিউনিখের একটা গ্যালারিতে যার নাম: আর্ট রুম। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে সেই শোয়ের নাম ছিল: 'ফ্রিডম' বা স্বাধীনতা।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর মনের খুশিমতো আঁকতে থাকেন বেলট্রাচ্চি। তবে আজও তার আঁকার মাঝে পাওয়া যায় অন্যদের ছায়া। ইচ্ছেমতো অনুসরণ করেন কানডিনস্কি, ক্যাম্পেনডঙ্ক, ডুরার আর গগাঁর স্টাইল। সব্যসাচী আঁকিয়ে তিনি, উভয় হাতেই সমান দক্ষ।
ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য ঘটেছে আগের সঙ্গে। এখন ছবিতে তিনি নিজের নামটাই সই করেন: ডব্লিউ. বেলট্রাচ্চি।
ম্যাক্স আর্নস্টের কাজ 'রুনাখটেন' (দ্বাদশ রাত) থেকে অনুপ্রাণিত একটি ছবিতে বেলট্রাচ্চি প্রতীকী রূপে একটা খরগোশ লুকিয়ে রাখেন, ইঙ্গিত ছিল জোসেফ বিউসের দিকে। এর থেকে এটা প্রমাণ হয়, হ্যাঁ, স্বভাব পুরোপুরি বদলায়নি তার; আজও মনে-মননে দুষ্টুমিটুকু রয়েই গেছে।
আবার 'টানজ আউফ দের ট্রেপে' (সিঁড়িতে নাচন) ছবিটায় পাওয়া যায় ১৯১৩ সালে ফারনান্দ লেজারের আঁকা ছবি, তবে তাতে স্থান পেয়েছে অস্কার শ্লেমারের ব্যবহৃত অনেক অবয়ব। এই ছবিটা বেলট্রাচ্চি শেষ করেছিলেন তিন কি চার দিনে।
বেলট্রাচ্চির দাবি, এমন কোনো শিল্পী নেই যার কাজকে তিনি নকল করতে পারবেন না। কেবল একমনে তাকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। 'আধুনিক আর্টিস্টদের চাইতে, রেনেসাঁ যুগের আঁকিয়েদের নকল করা বেশি কঠিন,' জানান তিনি। বলাই বাহুল্য, গর্বটা তার মাঝে বেশ ভালো পরিমাণেই আছে।
মিউনিখের প্রদর্শনীর কথায় আসা যাক। ওতে স্থান পেয়েছিল মোট ২৪টি ছবি। তবে প্রদর্শনী শুরুর আগেই বিশ্বের আনাচকানাচ থেকে সংগ্রাহকরা গ্যালারিতে ফোন করে জানায়, একটা আসল বেলট্রাচ্চি তাদের চাই-ই চাই।
তার সবচেয়ে দামি কাজটার মূল্য ৭৮,০০০ ইউরো। উলফগ্যাং বেলট্রাচ্চি এখন এক হিসেবে শিল্প-জগতের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। অনেক সমালোচক আজও তার নাম শুনে নাক সিটকান। তাদের মতে বেলট্রাচ্চি শিল্পী নন, অপরাধী।
'অপরাধের সাজা তো আমি পেয়েছি,' এই প্রসঙ্গে বেলট্রাচ্চি বলেন। 'যে সমালোচনা করে, হয় তারা প্রতিশোধ নিতে চায়—আর নয়তো ঈর্ষার আগুনে জ্বলছে।'
২০১৪ সালের ডিসেম্বরের একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। বেলট্রাচ্চি তখনও কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। তার ছবি নিয়ে সুইজারল্যান্ডের বার্নের একজন গ্যালারিস্ট প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। ওই ভদ্রমহিলাকে গ্যালারি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে বহিষ্কার করা হয়! তবে তাতে ছবির বিক্রিতে প্রভাব পড়েনি। তিন হপ্তার মাঝে সবগুলো ছবি বিক্রি হয়ে যায় সাড়ে ৬ লাখ ইউরোর বিনিময়ে।
অনেকের কাছেই বেলট্রাচ্চির স্টাইল অন্যদের থেকে নকল করে বানানো একটা জগাখিচুরি। তবে এই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন ভদ্রলোক নিজেই। ছবির স্টাইল তো অনেক দূরের কথা, একেকটা সই দিয়েছেন একেকভাবে! তবে একঘেয়েমিকে ঘৃণা করা এই শিল্পীর যুক্তি হলো—'সবসময় একই জিনিস আঁকায় মজা কই?' তার লক্ষ্য: অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পেইন্টিংগুলোকে এক সুতোয় গাঁথা।
উলফগ্যাং বেলট্রাচ্চিকে এখন পপ স্টারের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায়। সেলিব্রেটিরা লাইন ধরছেন তার থেকে নিজের একটা প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেবার জন্য। স্ত্রীর সঙ্গে মিলে দুটো বই লিখেছেন ভদ্রলোক, কাজ করেছেন ডকুমেন্টারিতে। আমেরিকার অনেক লেখক তার জীবন নিয়ে বই লেখার আগ্রহ প্রকাশ করে যোগাযোগ করছেন।
ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত মন্টপিয়েরের স্টুডিয়োতে বসে এখনও ছবি এঁকে যাচ্ছেন তিনি। ওখানকার আলো তাকে অনুপ্রেরণা দেয়।
বহু বছর 'ছায়ায়' থেকে ছবি আঁকার পর এখন শিল্পজগতের পাদপ্রদীপের আলো উপভোগ করছেন বেলট্রাচ্চি। তবে আজও সেই অতীত জীবনের কিছু কিছু দিকের অভাব বোধ করেন: 'ছায়ায় থেকে কাজ করে যাবার মাঝে আনন্দ ছিল। ধনী, নিস্তরঙ্গ একটা জীবন যাপন করতাম। এখন পয়সাও নেই, শান্তিও নেই। ভালো লাগে?'
২০১৭ সালের মাঝে পাওনাদারদের ২০ মিলিয়ন ফেরত দিতে হয়েছে তাকে। তাই তার এই আফসোসের কারণটা সহজেই বোঝা যায়। তবে সেজন্য খুব বেশি কষ্ট তাকে কররকে হয়নি।
বাজারে বেলট্রাচ্চির কাজের চাহিদা এত যে ছবি এঁকে কুল পাচ্ছেন না বেচারা। ফলশ্রুতিতে তার কাজের দামও বাড়ছে। ছবি কেনা অনেকটা শেয়ারের মালিক হবার মতো, আর এই লোভী আর্ট মার্কেট এখন উলফগ্যাং বেলট্রাচ্চির সইঅলা ছবি কেনার জন্য উদগ্রীব। আশা করা যায় উলফগ্যাং এবং হেলেন বেলট্রাচ্চি এই মার্কেটের চাহিদার নিচে চাপা পড়বেন না!
অতীত এখনও পুরোপুরি পিছু ছাড়েনি তাদের। এক প্রদর্শনীর সময় একজন ব্রিটিশ জার্নালিস্ট জিজ্ঞেস করে বসেন, উলফগ্যাং কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে তিনি আগের অপরাধী জীবনে আর কখনও ফিরবেন না?
জবাবে আর্ট জগতের এই রসিক 'রবিন হুড' জবাব দেন: 'হ্যাঁ। এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আর কখনও টাইটেনিয়াম হোয়াইট ব্যবহার করব না!'