বিরোহর ‘আজব কলম’ বলপয়েন্টের ঠিকুজি
১৯৪৫ সালের ২৯ অক্টোবর। নিউইয়র্ক শহরে গিম্বেল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে মহা ভিড় জমিয়েছে কয়েক শ লোক। ওদের সামলে রাখতে শেষে অন্তত ৫০ জন পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছে। এত লোকের হাজির হওয়ার কারণ, 'লেখালেখি'র জগতে 'বিপ্লব' ঘটাতে যাওয়া 'আজব কলম' দেখতে এসেছে এরা। এটা ছিল অনেকটা আইফোন নিয়ে শুরু হওয়া হুজুগের মতো। ওখানে জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর চোখে প্রযুক্তির বিকাশ ছিল বিস্ময়কর: কালি বয়ে বেড়ানো কলম!
অশ্রুতপূর্ব। বেশ খরুচে জিনিস ছিল কলমটা—একেকটা ১২.৫০ ডলার—আজকের দিনের ১৩০ ডলারের সমান। কিন্তু দামটা লাগসই ছিল। একটানা ছয় বছর লেখা যাবে ওই কলম দিয়ে!
পনেরো বছর! পানির নিচেও লেখা যাবে এই কলমে!
কিন্তু আমাদের পরিচিত বিক বা পার্কার ছিল না এটা। কলমটার নাম ছিল রেনল্ড রকেট, শিকাগোর এক উদ্যোক্তা মিল্টন রেনল্ডের কল্পনার ফল। মাত্র চার মাসে এই জিনিস তৈরি করেছেন তিনি। জাঁকালো উদ্যোক্তা হওয়ায় একটা কনভার্টেড বম্বারে চেপে সারা দুনিয়া ঘুরেছেন তিনি। হায়ার্ড হিউজের রেকর্ড ভেঙে প্রতিটা দোকানে কলম পৌঁছে দিয়েছেন। এভারেস্টের চেয়েও উঁচু চূড়ার খোঁজে (নিজের নামে নাম রাখবেন বলে) বেআইনিভাবে বিমান নিয়ে উড়ে গেছেন চীনে। তাকে আটকের চেষ্টা হলে কার্টন কার্টন কলম ছুড়ে দিয়েছেন টমি গানধারী প্রহরীদের দিকে, পাইলটকে বলেছেন ওটা দিয়ে গুলি বর্ষণ করতে, এবং পালিয়ে গেছেন জাপানে। 'আই স্টোল দিস পেন ফ্রম হ্যারি এস ট্রুম্যান' কথাটা খোদাই করা দুই শ কলম উপহার দিয়েছেন প্রেসিডেন্টকে। প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল তার উপস্থিতি।
কিন্তু এখন রেনল্ডের কথা কারও মনে নেই। কারণ, বেশির ভাগ কলমই কাজ করেনি। ছয় বছর ধরে লেখা যায়নি, অনেক সময় এমনকি ছয় ঘণ্টাও লেখা সম্ভব হয়নি, তার আগেই বিগড়ে গেছে কিংবা কালি চুইয়ে জামাকাপড়ের সর্বনাশ করেছে। ক্রুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ ক্রেতারা বদলি, টাকা ফেরত এবং লন্ড্রির খরচও দাবি করেছেন। অল্প দিনেই কলমের দাম নেমে আসে ৩.৮৫ ডলারে। বাজারে আসার দুই বছর পরই দাম ঠেকেছিল মাত্র ১৯ সেন্টে, কিন্তু কেনার মানুষ ছিল না।
এভাবেই রেনল্ডের কল্যাণে বলপয়েন্টের প্রয়াণ ঘটে।
কিন্তু সেটা প্রথমবার বা সাময়িক। বলপয়েন্ট চিরতরে হারিয়ে যায়নি। তার প্রমাণ আপনি আমি প্রতিদিন লেখার কাজে ব্যবহার করছি বলপয়েন্ট। তবে এটা বলা যায় এখন সর্বব্যাপী হওয়ার কারণেই স্রেফ এক সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্ন তো থেকেই যায় হারিয়ে গিয়ে আবার সর্বব্যাপি হয়ে উঠল কিভাবে জিনিসটা?
বলপয়েন্ট কলমের উদ্ভাবন হয় হাঙ্গেরিতে, ১৯৩৮ সালে লাযলোর হাতে।
স্পোর্টস কার প্রতিযোগী, সৌখিন উদ্ভাবক এবং সাংবাদিক ছিলেন 'লাযলো' জোসেফ বিরোহ বা বিরো। ইহুদিবিরোধী আইনের কারণে তিনি হাঙ্গেরি থেকে পালিয়ে যান। ১৯৪৩ সালে আর্জেন্টিনায় তার উদ্ভাবন পেটেন্ট করেন। এখানেই ব্রিটিশ ব্যাংকার হেনরি জর্জ মার্টিনের সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি এর স্বত্ব কিনে নিয়ে বোমারু বিমানে অনেক উঁচুতেও লেখার মতো একটা যন্ত্রের খোঁজে থাকা রয়্যাল এয়ারফোর্সের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এতে কাজ হয় এবং সারা কমনওয়েলথ অঞ্চলেই 'বিরোহ' হয়ে যায় বলপয়েন্টের সমার্থক শব্দ। কিন্তু এই কলম ব্যবহারকারী (এবং 'বাই-রোহ' হিসেবে নামের বিকৃত উচ্চারণকারী) লক্ষ লক্ষ মানুষের ভেতর অল্প কজনই তার নাম শুনেছেন।
ফাউন্টেন পেনের কালিতে প্রুফ শিটের দফারফা হয়ে যাওয়া মহা বিরক্ত লাযলো বিরোহ লক্ষ করলেন ছাপাখানা ঘন দাগমুক্ত কালি ব্যবহার করছে। একটা ঝলকের মতো ধারণাটা ধরা দেয় তার কাছে—ওই কালিই একটা নলে ভরে একমাথায় বল বিয়ারিং এঁটে দাও, ব্যস খুদে একটা রোটারি প্রেস মিলে যাবে। কালির পেস্টকে যথেষ্ট উষ্ণ করে ফের জমাট বাঁধার মতো ঘর্ষণও মিলবে। দারুণ এক চিন্তা নিসন্দেহে।
কিন্তু হাঙ্গেরিতে গেলে মনে হতে পারে যে বিরোহর খোঁজ বুঝি পাওয়া সহজ। অনেকটা ডাবলিনে জেমস জয়েসকে পাওয়ার মতো। বুদাপেস্টে বিরোহর ভাস্কর্য থাকবে, বিরোহ-দর্শনের ব্যবস্থা, বিরোহ টি-শার্ট, কিংবা বিরোহ পাব। এবং নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত দামি বিরোহ কলমের চীনে তৈরি রেপ্লিকা। কিন্তু আসলে এসবের কিছুই নেই। বইয়ের দোকানে বিরোহর ওপর বই খোঁজ করলেও নিরাশ হতে হবে। বিরোহ আঁকিয়েও ছিলেন, রাষ্ট্রীয় জাদুঘরে তার আঁকা ছবির সংগ্রহ থাকার কথা। কিন্তু সেটাও নেই। বিরোহ হাঙ্গেরিতে মারা যাননি। তবে উনচল্লিশ বছর বয়স অবধি সেখানে ছিলেন। তত দিনে ওয়াশিং মেশিন, একধরনের ইলেকট্রম্যাগনেটিক মেইল সিস্টেম এবং অটোমেটিক ট্রান্সমিশন উদ্ভাবনের পেটেন্ট করে ফেলেছেন। শেষেরটি জেনারেল মটরসের কাছে বিক্রি করেন বিরোহ।
অবশ্য টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে বিরোহ যেসব শিল্পকলা সাময়িকীতে কাজ করেছেন সেগুলোর মাইক্রোফিল্ম আছে: হোঙরি-ম্যাগিয়ারোর্সযাগ-হাঙ্গেরি এবং ইলোরি। এ ছাড়া বলপয়েন্টের ওপর লেখা একটি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা দ্য নেভার এন্ডিং লাইন: দ্য বলপয়েন্ট লেজেন্ড, লিখেছেন ইয়র্গি মোলদোভা।
এসব বইপত্র থেকে যত দূর জানা যায়, পরিবারের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলে ছিলেন লাযলো। তার বড় ভাই ইয়র্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ডেন্টিস্ট হয়েছেন। লাযলোও চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে কয়েক সেমিস্টার পড়াশোনা করলেও তার আসল নজর ছিল সম্মোহনে। তো মেডিকেল স্কুল থেকে বিদায় নেন তিনি। আরও অনেক কিছুর ভেতর বিরোহ প্রাণিবিজ্ঞানের গবেষক এবং একজন রেসিং ড্রাইভার ছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আসলে তার গবেষণা ছিল স্রেফ গোটাকতক ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ আর অটো রেসিং ছিল মাত্র এক দফা।
একরাতে মদ পানের পর সভেতিস্লাভ পেত্রোভিচ নামে এক অভিনেতার কাছ থেকে একটা লাল বুগাত্তি স্পোর্টস কার কিনেছিলেন লাযলো। সত্যি বলতে এটা ছিল অনেকটা হলিউডের সবচেয়ে বিখ্যাত অটোভক্ত স্টিভ কুইনের (অংশত হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি) সাথে আড্ডা মেরে সন্ধ্যার শেষে তার কাছ থেকে রেসিং কার কেনার মতো। অভিনেতা পেত্রোভিচ হাঙ্গেরীয় নির্বাক ছবি দিয়ে পেশা শুরু করেছিলেন এবং এক শর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর ভেতর ১৯৫৮ সালে জিন মরোর সাথে লুই মিলারের থ্রিলারে অভিনয়ও আছে। বিরোহর কাছে গাড়িটি বিক্রির সময় পেত্রোভিচ তিরিশটিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বাটালির মতো চোয়ালের অধিকারী অভিনেতার চেয়ে বেশি জাঁকাল একমাত্র জিনিসটা হতে পারে তার ওই বুগাত্তি গাড়িটা, আজকের দিনের ফেরারির চেয়েও বেশি দামি এবং জৌলুশময়। ওই সময়ের কোনো বুগাত্তিরই বিশাল বারো লিটারি মটোর ছিল না। বিরোহ কীভাবে এটা কেনার পয়সা জোগাড় করেছিলেন, সেটা একটা বিস্ময়। সম্ভবত পানীয়র সাথে এর একটা সম্পর্ক ছিল। বিরোহ বলেছিলেন, কুলোতে না পেরে অচিরেই ওই বুগাত্তি বেচে দেন তিনি।
শ্যাম্পেনের ঘোরেই দুই সপ্তাহ পর বুদার সভাব পাহাড়ে একটা মোটর গাড়ি প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর প্রস্তাব পান বিরোহ, অথচ তিনি জীবনে কখনো ড্রাইভ করেননি। এক পুরোনো শোফার বন্ধুর কাছ থেকে তালিম নিয়েছিলেন কিন্তু প্রায়ই গিয়ার বদলানোর সময় ক্লাচ চাপার কথা ভুলে যেতন। শোফার তার পা মাড়িয়ে দিয়ে সাজা দিতেন তাকে।
অবাক ব্যাপার হলো, ওই প্রতিযোগিতায় জেতার দাবি করেছেন বিরোহ, কিন্তু তাতে ঘটনাটা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি, এখান থেকে আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য হয়েছে বরং। ক্লাচ নিয়ে কাজ করার ঝামেলা থেকেই অটোমেটিক গিয়ারবক্সের ভাবনা মাথায় আসে বিরোহর।
অটোমেটিক ট্রান্সমিশন উদ্ভাবনের জন্যে বছরখানেক অন্য এক প্রকৌশলীর সাথে কজে করেন তিনি। একটা ৩৫০ সিসি মোটরসাইকেলে এটি স্থাপন করেন তারা। সাইডকারে দুই শ পাউন্ড ওজনদার প্রকৌশলীকে নিয়ে বুদাপেস্ট থেকে বার্লিনে হাজির হন লাযলো। এখানে জেনারেল মটর্সের প্রতিনিধির সাথে দেখা করেন। জিমএম জিনিস দেখে মুগ্ধ হয়ে বিক্রির আধা শতাংশ দেওয়ার শর্তে বিরোহর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং টানা পাঁচ বছর অগ্রিম হিসেবে মাসে ২০০ ডলার হারে মেটানোর অঙ্গিকার করে। বিরোহর অর্ধেক, বাকি অর্ধেক প্রকৌশলীর। ১৯৩২ সালে উল্লেখ করার মতো নগদ অর্থ ছিল এটা। তো উকিলের সাথে পরামর্শ না করেই সোৎসাহে চুক্তিতে সই দিয়ে দেন তারা, কিন্তু পরে খেয়াল করেন যে উৎপাদন শুরুর সময় এবং গিয়ারবক্সের সংখ্যাও চুক্তিতে উল্লেখ করেনি জিএম। আসলে জিএম অনেক বছর ধরে তাদের নিজস্ব অটোমেটিক গিয়ারবক্স নিয়ে কাজ করছিল। বিরোহর উদ্ভাবনকে বাজার থেকে দূরে রাখতেই চুক্তি করে তারা। একই ধরনের প্রতিভা, উচ্ছ্বাস এবং সরল বিশ্বাস বলপয়েন্টের বেলায়ও বিরোহর কর্মকাণ্ড ঘিরে ছিল।
পরিবারেই ছিল আবিষ্কারের ধারা। লাযলোর বাবা 'রাবার পোর্টার' বলে একটা জিনিস উদ্ভাবন করেছিলেন। এটা দিয়ে যেকোনো কামরা থেকে বাড়ির সদর দরজা খোলা যেত। এক নতুন ধরনের কলম নিয়েও গবেষণা করেন তিনি। কালির বদলে সেই কলমে ভরা হতো পানি। এই পানি আবার সরু নলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একটা কালির কার্ট্রিজ গলিয়ে দিতো। কালির সঠিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারায় কলমটা কাজে আসেনি। বিরোহর নিজস্ব কলম নিয়েও ঠিক একই রকম ঝামেলার মোকাবিলা করতে হয়েছিল বছরের পর বছর। জোরালো টুকরো ঘটনা মনে রাখার বেলায় বিরোহর সাংবাদিকসুলভ প্রবণতা ছিল: ছোট থেকে বাবাকে একটা ধারণার পিছে লেগে থাকতে দেখার অভিজ্ঞতা ছাপাখানার চকিত ঝলকের তুলনায় কম আকর্ষণীয় ঠেকার কথা। কিন্তু বিরোহ লেগে থেকেছেন। আসলে বিরোহর প্রথম পেটেন্ট করা উদ্ভাবন ছিল ১৯২৮ সালের 'ওয়াটার ফাউন্টেন পেন'। তার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৯ সালে। যদিও বিরোহর ওই কলম সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। পরে বিরোহ বলপয়েন্টের বিভিন্ন পেটেন্ট করেন। কিন্তু তার কলম নিখুত ছিল না। কালি লিক করত। কাগজে কালি শুকাত না। বিরোহর বল পয়েন্ট নিয়ে পরের ধাপের কাজ করেন আরেক দুরন্ত প্রায় ঠগবাজ আবিষ্কারক রেনল্ডস।