ঢাকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান: সেইসব আধা সাদা সাহেব-মেম
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলতে কী বোঝেন আপনি?
এ প্রশ্নের জবাবে আমি ছোট্ট করে বললাম, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান মিক্সড।
হাশেম সূফী বললেন, কেবল ব্রিটিশ নয়, বলা উচিত ইউরোপিয়ান-ইন্ডিয়ান মিক্সড। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখলে নেওয়ার পর দলে দলে ডাচ, আইরিশ, আর্মেনীয়, স্প্যানিশ, গ্রিকরা এসেছিল এখানে। পর্তুগিজরা তো এসেছিল তাদেরও আগে। গোয়া তো পর্তুগিজ কলোনিই ছিল। গোয়ানিজ পর্তুগিজদের বড় একটা দল ভারতের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে অ্যাংলোদের বেশি দেখা গেছে বাংলাতেই বেশি। বাংলাদেশে তাদের বসতি বেশি ছিল ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ মানে ১৮৪০ বা ১৮৫০-এ ঢাকা শহরটি ছিল সদরঘাটের আশপাশে এক বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে, মানে লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, পাটুয়াটুলি, মিটফোর্ড বা নওয়াবপুর। তীব্র আত্মপরিচয় সংকটে ভুগত অ্যাংলোরা। এরা হাফ রেড, বাদামি বা ফর্সা রঙের হতো। তবে তাদের সবার নাক ছিল খাড়া। বাইরের কারও সঙ্গেই তারা সেভাবে মিশত না। বিয়েশাদি তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমিত ছিল। পরিচয় জটিলতায় ভুগত বলেই সম্ভবত তারা কিছুটা উগ্র মেজাজের হতো।
এ বর্ণনা সূফী ভাইয়ের। উল্লেখ্য, সূফী ভাই মানে হাশেম সূফী ঢাকার ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী। লক্ষ্মীবাজারের রোকনপুরে তাঁর পৈতৃক নিবাস। বয়স পঁচাত্তর।
অ্যাংলো ইতিহাস
আদিতে মানে সতেরো ও আঠারো শতকে যেসব ইংরেজ বণিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারতে আসে, ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর তাদের বলা হতো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা ইস্ট ইন্ডিয়ান। তাদের মধ্যে যারা ধনী ছিল, তাদের বলা হতো নবাব। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তারা শক্তিশালী লবি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ভারতে বসবাসকারী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক নতুন সামাজিক শ্রেণি। সাধারণত এরা ব্রিটিশ বাবা ও ভারতীয় মায়ের সন্তান। স্থানীয় বাঙালিরা তাদের বর্ণসংকর বলে হেয় করত আর এদের সঙ্গে কোনো রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কে জড়াত না। এমনিতেও স্প্যানিশ, পর্তুগিজ বা ব্রিটিশরা যেখানে উপনিবেশ গড়েছে, সেখানেই এমন মিশ্র সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। উনিশ শতক শুরুর আগে ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতেন না বাংলায়। তখন তাদের অনেকের মধ্যেই রক্ষিতা ও দাসী রাখার প্রবণতা ছিল। কেউ কেউ এদেশীয় নারীদের বিয়েও করে। ফলে উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে দেখা গেল এদের উত্তরাধিকারেরা বড়সড় একটা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। এদের বৈধ সন্তানদের অনেককেই তখন পড়াশোনার জন্য ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সমাজ তাদের সম্মান দেয়নি বরং অপমান করেছে, তাই অনেকেই বাধ্য হয়েই ফিরে আসে। বিশ শতকের আগপর্যন্ত সম্প্রদায়টির কোনো আইনগত বা সামাজিক অভিধা ছিল না। তারা পরিচিত হতো বর্ণসংকর, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান বা ইন্দো-ব্রিটন নামে। ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে তাদের ইউরেশিয়ান গণ্য করা হয়। ওই শুমারিতেই বাংলা সরকার প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে তাদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অভিধায় ভূষিত করে। ওই শুমারির সংজ্ঞা অনুসারে ভারতীয় মাতা ও ব্রিটিশ পিতার সন্তান এবং বাংলায় বসবাসরত সকল ইউরোপীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। ১৯২১ সালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। সংখ্যায় কম হলেও তারা ছিল প্রভাবশালী। এটা বোঝা যায়—২৫০ সদস্যের আইন পরিষদে ২৫ জন ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। ১৯৩৫ সালের সংবিধানেও তাদের জন্য আইনসভায় ৪টি আসন সংরক্ষিত ছিল।
তিনটি গির্জা দিচ্ছে সূত্র
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে ৩ থেকে ৪ মিনিট হাঁটা দূরত্বেই তিনটি গির্জা। রোমান ক্যাথলিকদের সেন্ট গ্রেগরি পূর্ব দিকে, উত্তর দিকে অ্যাংলিকানদের সেন্ট থমাস আর দক্ষিণে ব্যাপ্টিস্ট মিশন চার্চ স্কুল। ওই গির্জা তিনটিই সূত্র দিচ্ছে হাশেম সূফীকে। সূফী ভাই বলছিলেন, ' প্রটেস্টান্ট অ্যাংলিকান চার্চ কিন্তু পোপের অধীনে নয়, চার্চ অব ইংল্যান্ড তাদের হেড কোয়ার্টার। ব্রিটিশ-ভারতীয় অ্যাংলোরা এখানে প্রার্থনা করত। আর সেন্ট গ্রেগরি চার্চ পোপের অধীন। গোয়ানিজ-পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত অ্যাংলোদের প্রার্থনাঘর ওই সেন্ট গ্রেগরিজ চার্চ।
ব্যাপ্টিস্ট চার্চ মূলত ধর্মান্তরিতদের উপাসনাঘর, আগে এটি ছিল ছোট কাটরায়। অ্যাংলিকান সেন্ট থমাস চার্চ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২৪ সালে, বিশপ হেপার এটি উদ্বোধন করেছিলেন।
অ্যাংলোরা সাধারণত ধার্মিক হতেন। খ্রিষ্টান হওয়া ও ইংরেজি জানা—এই দুটি বিষয় তাদের পরিচয়সংকট থেকে খানিকটা রেহাই দিত। সদরঘাট এলাকাতেই দেখুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল দুই বাংলার প্রথম স্কুল—ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ১৯৩৫ সালে। পরের বছর হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। আর্মেনীয় নিকি পোগোজ (পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা) ছিলেন এ স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। মানে আমি বলতে চাইছি, সদরঘাট এলাকাই ছিল শহরকেন্দ্র। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ এখানে কয়েক শ ঘর অ্যাংলো থাকার কথা। তারা ছিল মূলত পেশাজীবী। ব্যবসা-বাণিজ্য করত সে আমলে মূলত আর্মেনীয়রা। বেকারি ব্যবসাও ছিল আর্মেনীয়দের হাতে। সেগুলোয় বেশি ছিল মুসলমান কারিগর। আবেদ অ্যান্ড কোং নামের একটি বেকারি ছিল ১৮৫৯-এর দিকে। ওয়াইজঘাটে ছিল তাদের ফ্যাক্টরি। নবাববাড়ির পৃষ্ঠপোষকতা পেত তারা।'
আমি একটু অবাক বনলাম, মুসলমান কারিগররা বেকারিতে ভালো করত! এর ইতিহাসটা কী? সূফী ভাই আবার বলতে লাগলেন, 'রুটি তো আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, পারস্যের লোকেরাই বেশি ভালো বানায়। তাই মুসলমান কারিগররাই যে ভালো বেকারি আইটেম তৈরি করতে পারবে, সেটা স্বাভাবিক। প্রিন্স অব ওয়েলস নামের যে দোকানটি এখনো টিকে আছে, সেটিরও মালিক ছিল মুসলমান। তার প্রধান কারিগর বুদ্দু বা বুদ্দিন মিস্ত্রিকে আমি দেখেছি। যা হোক হেকিম হাবিবুর রহমানের বইটার (ঢাকা পাচাস বারাস পাহ্লে) ব্যাখ্যায় আমি রুটির বিবর্তন বলেছি।' আমি আবার সূফী ভাইকে থামাই। বলি, প্রিন্স অব ওয়েলস নাম রাখার সাহস কীভাবে করলেন একজন নেটিভ বা ইংরেজ নন এমন কেউ?
প্রশ্নটায় আনন্দ পেলেন তিনি। বললেন, 'ভালো কথা বলছেন। আসলে তো নেটিভদের কিং, কুইন বা প্রিন্সদের নামে ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রের নাম রাখা আইনত দণ্ডনীয় ছিল। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এমন হতে পারে যে কোনো ইংলিশম্যান এর লাইসেন্স নিয়েছিলেন, পরে বুদ্দিন মিস্ত্রি এর মালিকানা পান।'
কেক, পেস্ট্রি, কাপকেক, বিস্কুট, ক্রিমরোল, সসেজ ইত্যাদি আইটেমগুলো কি মিলত তখনকার বেকারিগুলোতে? জানতে চাইলে সূফী ভাই আবার বলতে শুরু করেন, 'হ্যাঁ, সবই মিলত। অ্যাংলোরা বেকারি আইটেমের ওপরই নির্ভর করত বেশি। তারা রাতে ভারী খাবার খেত, দুপুরে হালকা আর সকালেও হেভি ব্রেকফাস্ট করত। একদম ইংলিশ কায়দার খাওয়াদাওয়া। ঢাকার প্রথম যে ইংলিশ রেস্টুরেন্ট, যার নাম ছিল আলেকজান্ডার, জজ কোর্টের উল্টো দিকে ছিল। বাবা-দাদাদের মুখে শুনেছি, আলেকজান্ডারের প্রবেশমুখে লেখা ছিল, এশিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর প্রহিবিটেড। পরে রূপলাল আর নবাবদের বিরোধিতার মুখে তারা কথাটি তুলে নেয়। সুইং ডোর ছিল আলেকজান্ডারে। এটা আমিই দেখেছি। ওখানে একটা বেকারি আইটেমের দোকান ছিল। অ্যাংলোরা কেনাকাটা করত। এক বেলায় তারা কমপক্ষে দুটি ডিম খেত। তারা আমাদের মতো মামলেট বলত না, বলত ডিমের অমলেট। রুটি তারা টোস্ট করেও খেত, আবার না ভেজেও খেত।'
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় থামলেন কিছুক্ষণ সূফী ভাই। তারপর বললেন, 'কলকাতারও বড় বড় বেকারিগুলোর কারিগর সব মুসলমান। যেমন নিউমার্কেটে, যেটা জুইশ বেকারি নামে বিখ্যাত, তারপর সালদানহা নামের বেকারিটার কারিগরও মুসলমান।'
এই সময় একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে বসলাম, 'কোনো ব্রিটিশ কি মুসলিম কোনো নারীকে বিয়ে করেছিলেন?'
সূফী ভাই একটু রহস্যময় হাসি দিলেন। তারপর বললেন, 'ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইনটন (১৭৩১-১৮০৪) তো এক মুসলিম নারীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন। এই সুইনটনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে ঢাকা অধিকার করেন। তিনি ছিলেন কোম্পানির চার নম্বর ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ওই মুসলিম নারী শেষে তাকে দুটি শর্ত দিয়েছিলেন, দিল্লির সম্রাটের অধীনতা স্বীকার করে নিতে হবে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তবেই তিনি সুইনটনকে বিয়ে করবেন। এরপরের ইতিহাস জানা নেই। তবে আর্চিবল্ড সুইনটনেরই বংশধর টিলডা সুইনটনের কথা আমরা শুনেছি। তিনি একজন অস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী। বছর কয়েক আগে ঢাকাও ঘুরে গেছেন।'
অ্যাংলোরা চাকরিই করত
সুইনটনের মুসলিম নারীর প্রেমে পড়ার বিষয়ে খটকা লেগে গেল, কিন্তু সূফী ভাই আলপটকা কথা বলার মানুষ নন। তিনি শোনা কথা যাচাই করে নেন এবং জানা বিষয়ও নিশ্চিত হয়ে নেন। তাই আমি একরকম শান্তিতেই থাকলাম এবং পরের প্রশ্নটি করলাম, আচ্ছা সুফী ভাই আপনি যে বলছিলেন, অ্যাংলোরা ছিল মূলত চাকরিজীবী?
সূফী ভাই বলতে লাগলেন, 'হ্যাঁ অ্যাংলোরা ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে যায়নি। তারা চাকরিই করত বেশি, আর তাতে দক্ষতারও পরিচয় দিয়েছে তারা। ১৮৫৭ সালে সিপাহি মহাবিদ্রোহের পর কোম্পানির কাছ থেকে ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিয়ে নেয় ব্রিটিশ রাজ। সেই সঙ্গে তারা যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিতে মনোযোগী হয়, যেন বিদ্রোহ দমন সহজতর হয়। তাই রেল সার্ভিস, স্টিমার সার্ভিস, ডাক, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ সার্ভিস সম্প্রসারিত করতে থাকে। এসব সার্ভিসে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী চাকরিতে পদায়ন হতো। কালেক্টর, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ইত্যাদি উচ্চপদে পিওর ব্রিটিশরাই থাকত। পরের স্তরগুলোতে পর্যায়ক্রমে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান (ব্রিটিশজাত), অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান (পর্তুগিজ-গোয়ানিজজাত), হিন্দু ভারতীয় এবং মুসলিম ভারতীয়রা নিয়োগ পেত। ইংরেজি ভালো জানত বলে অ্যাংলোদের কাজ পেতে সুবিধাও হতো। এ ছাড়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, চা-বাগানগুলোতেও প্রচুর অ্যাংলো কর্মী ছিল। এক অর্থে প্রাইভেট সেক্রেটারি ও স্টেনোগ্রাফার (শ্রুতিলিখন ও শর্টহ্যান্ডে দক্ষতাসম্পন্ন) পদগুলোয় অ্যাংলোরা কাজ করত। যেমন গভর্নর মোনায়েম খারও একজন অ্যাংলো স্টেনো ছিল।'
অ্যাংলোদের অবদান
পরিচয়সংকটে ভোগা অ্যাংলো জনগোষ্ঠী বলা চলে আবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত বা গণ্ডিবদ্ধ জীবন যাপন করত। খুব বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তারা থাকত না। কলকাতায় তারা বেশি থাকত রিপন স্ট্রিটে, ঢাকায় থাকত লক্ষ্মীবাজারে, পাট ব্যবসার সূত্র ধরে কিছু অ্যাংলো ছিল নারায়ণগঞ্জেও। ফার্মগেট-তেজগাঁও আর দিলু রোডেও কিছু পরিবারের বসবাস ছির পরের দিকে।
এ জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অবদান কতটা ছিল, জানতে চাইলে সূফী ভাই বললেন, 'পাবলিক ওয়ার্কসে বেশি অবদান তারা রাখেনি। তবে চাকরি তারা করত মন দিয়ে। যে পেশাতেই ছিল, সেখানে তারা অবদান রেখেছে। রেলে যিনি কাজ করেছেন, তিনি স্টেশন ম্যানেজার হন বা টিটি, তারা যাত্রীদের চলাচল সহজ করতে চাইতেন। আবার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে যিনি কাজ করেছেন, তিনি বনের সীমানা ঠিকমতো যেন নির্ধারণ করা হয়, তাতে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। তবে অ্যাংলোরা ভালো ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষা খাতে। ঢাকার প্রথম দিকের কিন্ডারগার্টেনগুলো তারাই পরিচালনা করেছেন। সেন্ট্রাল আইডিয়াল স্কুল ও সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স প্রথম দিকের কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে চালু হয়েছিল এগুলো, ইংলিশ মিডিয়মে পড়ানো হতো। ঢাকা কলেজিয়েটও কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছিল। এ ছাড়া ঢাকায় সংগীত আবহ সৃষ্টিতেও অ্যাংলোদের ভালো অবদান ছিল। তারা বেহালা, পিয়ানো, গিটার ভালো বাজাতে পারত। ঢাকার প্রথম সংগীতযন্ত্র বিক্রি প্রতিষ্ঠান মিউজিক্যাল মার্টের প্রতিষ্ঠাতাও ছিল অ্যাংলোরা। দোকানটি ছিল জগন্নাথ কলেজের (এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ঠিক উল্টো দিকে, পরে সেখানে ফুজি কালার ল্যাব হয়েছিল। প্রাইভেট টিউশন ছিল অ্যাংলোদের একটা সাইড ইনকাম। তারা বাড়িতে গিয়েও গান শেখাত। ফটো স্টুডিও পেশাতেও ছিলেন অনেকে। ফ্রিৎজ ক্যাপ (জার্মান আলোকচিত্রী, ১৮৯২ সালে নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়াইজঘাটে স্টুডিও খোলেন) স্টুডিও ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে দায়িত্ব পেয়েছিলেন একজন অ্যাংলো। নওয়াবপুরেও ছিল অ্যাংলোদের ফটো স্টুডিও।'
অ্যাংলোদের প্রস্থান
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই বেশির ভাগ অ্যাংলো বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিল। রোকনপুরে তিনি অন্তত ২০টি অ্যাংলো পরিবার দেখেছেন। নটরডেম কলেজে তিনি চৌষট্টি ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। সেখানেও কিছু অ্যাংলো বন্ধু পেয়েছিলেন। তার বেশি মনে পড়ে টেলবার্টের কথা। টেলবার্টের মা ছিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের প্রথম প্রিন্সিপাল। টেলবার্ট ভালো গিটার বাজাতে পারত। ঢাকার প্রথম গানের ব্যান্ড টেলবার্টের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল। 'আয়োলাইটস' ছিল ব্যান্ডের নাম। সে দলের লিড গিটারিস্ট ছিল ফজলে রাব্বি আর নবাববাড়ির শাব্বির ছিলেন ড্রামার। তাঁরা এলভিস প্রিসলির গান বেশি গাইত। টেলবার্ট ভাঙা ভাঙা বাংলা জানত, তবে কথা বলত ইংরেজিতেই।
সূফী ভাইয়ের মনে পড়ে, 'অ্যাংলোরা ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করত। পুরুষেরা কোট-প্যান্ট পরত, মেয়েরা পরত গাউন বা ফ্রক। পাজামা-পাঞ্জাবি বা ধুতি পরা অ্যাংলো আমি দেখিনি একজনও। তারা কোয়েকার ওটস খেত। ইমপোর্ট করা ক্যানের চিজ খেত। তারা রোকনপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। আমার বাড়ির পেছনের বাড়ি মানে ৯ নম্বর রোকনপুরে যে অ্যাংলো পরিবারটা থাকত, তাদের এক সদস্য অসাধারণ বেহালা বাজাত। বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ছিল একতলা, কোনো কোনোটি দোতলা। অ্যাংলোরা ফুল পছন্দ করত, বাড়ির সামনে জায়গা থাকলে বাগান করত অথবা বারান্দায় ফুলের টব ঝোলাত। ঘরের ভেতরের ফুলদানিতে তাজা ফুল সাজিয়ে রাখত। আমি নিজে কয়েকটি বাড়িতে ফায়ারপ্লেসও দেখেছি।'
এবার আর প্রশ্ন না করে পারলাম না, ফায়ারপ্লেস কেন? ঢাকায় কি বরফ পড়ত? অত শীত কি কখনও ছিল?
সূফী ভাই বললেন, 'ঢাকায় কোনোকালেই বরফ পড়েনি। আগের দিনে ঢাকায় শীতও বেশি পড়ত না, এখন বরং এখন আমার কাছে মনে হয় শীত বেশি। কিন্তু অ্যাংলো বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ফায়ারপ্লেস থাকত, যেমনটা ইউরোপীয় বাড়িগুলোতে থাকে। বলছিলাম না, তারা পুরোপুরি ব্রিটিশ কেতার জীবন যাপন করতে চাইত, সে কারণেই ফায়ারপ্লেস রাখার চল তৈরি হয়েছিল। অ্যাংলোরাই কিন্তু বার্থডে, ম্যারেজ ডে পালন করত ঘটা করে। আমাদের এখানকার হিন্দু বা মুসলমান কারও মধ্যেই এসবের চল ছিল না। সে অর্থে বলা যায় অ্যাংলোরাই ঢাকায় বার্থডে পালনের রীতি চালু করে।'
এ পর্যায়ে থামাই সূফী ভাইকে। জিজ্ঞেস করি, খেলাধুলায় অ্যাংলোরা কেমন ভূমিকা রেখেছিল?
সূফী ভাই: একজন নারী ডিস্ক থ্রোয়ারের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু তাঁর নাম খেয়াল নেই।
—ঢাকায় যখন লর্ড কার্জন এসেছিলেন, তখন কি কোনো কনসার্ট হয়েছিল বা অর্কেস্ট্রা?
সূফী ভাই: তা আমার জানা নেই। তবে অর্কেস্ট্রা হলে তাতে নিশ্চয়ই অ্যাংলোরাই নেতৃত্ব দিয়েছে।
—পরের প্রশ্ন, নিজেদের বাইরে কি তারা বিয়ে করতই না?
সূফী ভাই: সাধারণত নিজেদের মধ্যেই তাদের বিয়ে হতো। তবে পিওর ইংরেজরা অ্যাংলো বিয়ে করতে চাইত না। আর প্রেমঘটিত ব্যাপার থাকলে বহির্বিবাহ হতো। একটা ঘটনা খুব মনে আছে। ভিক্টোরিয়া পার্কের ধারে যে লালরঙের পানির ট্যাংকি একটা আছে, এর কাছেই থাকত নূরুল হক বাচ্চু ও তাঁর পরিবার। তিনি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। নিজেও পরে অনেক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, যেমন আমজাদ হোসেনের সঙ্গে মিলে 'আগুন নিয়ে খেলা', 'দুই ভাই', এককভাবে করেছেন 'কুচবরণ কন্যা', 'আশার আলো', 'আপোষ' ইত্যাদি। তার বড় ভাইকে আমরা হক সাহেব নামে জানতাম, তিনি এক অ্যাংলো মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।
—অ্যাংলোরা শেষ কোন সময় পর্যন্ত ঢাকায় ছিল?
সূফী ভাই: বেশিরভাগই দেশভাগের আগে চলে গেছে, বেশি গেছে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায়। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের একটা ঘটনা মনে আছে। দুই ভাই-বোন বাড়িতে মরে পড়ে ছিল, দুই দিন তাদের কোনো আনাগোনা না দেখে আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। তারা পরে লাশ দুটি উদ্ধার করে।
—অ্যাংলোরা কি স্থায়ী বাড়িঘর করেনি ঢাকায়?
সূফী ভাই: না, তারা ভাড়া বাড়িতেই থাকত। আমার ওদের মনে হয় মাইগ্রেটরি বার্ডসের মতো।
—ঢাকার কোনো বিখ্যাত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের কথা কি মনে করতে পারেন? চিত্রতারকা বা পেইন্টার?
সূফী ভাই: না। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
—যারা ঢাকায় মারা গেছেন, তাদের কবর কোথায়?
সূফী ভাই: বেশির ভাগই নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানে।
তবে সূফী ভাইয়ের কলেজের বন্ধুদের কয়েকজন ছিলেন হিউবার্ট, পল ডি কস্তা বা স্তানিস্লাস ডি রোজারিও। এর মধ্যে স্তানিস্লাস আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে ভিসা অফিসার হয়েছিলেন। পরে নিজেও আমেরিকা চলে যান। স্তানিস্লাসের সঙ্গে সূফী ভাইয়ের এখনো ফেসবুকে যোগাযোগ আছে।
আরও কিছু কথা
বলা হয়ে থাকে, দুই লাখ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছিল বাংলাদেশে। তবে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সংখ্যাটি নেমে আসে চার হাজারে। সারা পৃথিবীতে এখন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আছে ১০ লাখের বেশি। ভারতে আছে এক লাখের মতো। তারা কলকাতা, চেন্নাই, মুম্বাই, দিল্লি, গোয়া, কোচি বা পুনেতে বসবাস করে। ভারতের সেনাবাহিনীতে এ পর্যন্ত আটজন এয়ার মার্শাল এসেছেন অ্যাংলো পরিবার থেকে। এলভিন রবার্ট কর্নেলিয়াস নামের এক অ্যাংলো সুপ্রিম কোর্ট অব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। খ্যাতিমান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে আরও আছেন লেখক রাস্কিন বন্ড, জাঙ্গল বুকের লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং, জর্জ অরওয়েল, বিশ্বসুন্দরী ডায়ানা হেইডেন, হলিউডের ভিভিয়ান লেহ্, বেন কিংসলে প্রমুখ। তাদের মধ্যে কিপলিং জন্মেছেন মুম্বাইয়ে, বেন কিংসলে গুজরাতে, জর্জ অরওয়েল বিহারে, ডায়ানা হেইডেন হায়দ্রাবাদে জন্মেছেন। কিংসলের মা ছিলেন ইংরেজ আর পিতা গুজরাতি। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল কৃষ্ণ পণ্ডিত ভাঞ্জি। তিনি পড়াশোনা করেছেন ম্যানচেস্টারে। চাকরি খুঁজতে গিয়ে ষাটের দশকে তিনি নাম পরিবর্তন করেন আর নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নাম বদলানোর পরপরই আমার কাজ জুটে যায়।
বাঙালি তথা ভারতীয়রা অ্যাংলোদের জাত খোয়ানো জনগোষ্ঠী মনে করত আর অ্যাংলোরাও মিশতে চাইত না নেটিভদের সঙ্গে। তবু বাঙালিদের একটা রোমান্টিসিজম ছিলই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ব্যাপারে। বিশেষ করে অ্যাংলো মেয়েদের প্রেমে পড়ার ব্যাপারে একটা হুড়োহুড়ি লেগে যেত। ১৯৬১ সালে তৈরি কলকাতার ছবি 'সপ্তপদী'তে (উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত) তার স্বাক্ষর আছে। তবে ১৯৮১ সালে নির্মিত অপর্ণা সেনের '৩৬ চৌরঙ্গী লেন' ছবিতে ফুটে উঠেছে নিঃসঙ্গ অ্যাংলো বৃদ্ধার একাকী বেলার কথা। তবে সংগীতশিল্পী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা অঞ্জন দত্ত এখনো তার অ্যাংলো বান্ধবীদের খুঁজে ফেরেন। সেই সঙ্গে তিনি উচ্ছেদ পরিচয়ের সংকটে ভোগা কলকাতার বো স্ট্রিটের অ্যাংলোদের নিয়ে ২০০৪ সালে তৈরি করেছেন 'বো ব্যারাকস ফরেভার'। তার ছয় বছর আগে 'বড়দিন' নামের সিনেমাতেও তিনি অ্যাংলোদের প্রসঙ্গ এনেছেন। ২০১৬ সালে অঞ্জন আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছিলেন, সেন্ট্রাল কলকাতায় আমার পাড়ায় মাইক বাজিয়ে যিশুপুজো হয়। কম বয়সে সেন্ট জেমস চার্চে বড়দিনের প্রার্থনায় যেতাম মেয়েদের পাশে বসার জন্য। আমার প্রথম বান্ধবী ছিল অ্যালিস্যান। ওর বাবা জার্ডিন জন্তু-জানোয়ারের ব্যবসা করতেন। সত্যজিৎ রায়ের 'গোরস্থান সাবধান'-এ জার্ডিনের উল্লেখ আছে। বড়দিনে অ্যালিস্যানদের বাড়িতে ঘি-ভাত আর মিটবল হতো। অপূর্ব! কিন্তু ওরা চলে গেল অস্ট্রেলিয়া।
অ্যালিস্যানকে নিয়েই বুঝি অঞ্জন দত্ত তার বিখ্যাত 'ম্যারি অ্যান' গানটি লিখেছেন। গানটির কথা এমন—'কালো সাহেবের মেয়ে, ইশকুল পালিয়ে, ধরতে তোমার দুটো হাত, কত মার খেয়েছি...ম্যারি অ্যান, ম্যারি ম্যারি অ্যান...'
অঞ্জন দত্তের মতোই অনেক অনেক অ্যাংলো স্মৃতি কলকাতা আর ঢাকার অনেকের মনের গভীরে ডুবে আছে। আধা সাদা সেই সব সাহেব-মেমরা আজ কে কোথায়, কিছু হদিশ নেই, কিন্তু স্মৃতিগুলো বড় তাজা। জ্বালায় সদা। সূফী ভাইয়ের যেমন মনে পড়ে টেলবার্টের কথা, যে গাইত এলভিস প্রিসলির গান।