বুড়িগঙ্গা—ভালোবাসা আর লজ্জার নদী
প্রায় হাজার দশেক বছর আগে মানুষ যখন থেকে অল্পস্বল্প চাষবাস করা শিখলো তখন থেকে মানুষ একটু বড় জলাশয়ের পাশে থাকা শুরু করলো। তারও প্রায় দুই হাজার বছরের মধ্যে মানুষ যখন সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেললো তখন থেকে নদীর পাড়ে বড় স্থায়ী জনপদ গড়ে ওঠা শুরু হলো। যখন নগরায়ণ শুরু হলো তখন যাতায়ত আর পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে নদীর তীর ঘেঁষে ছোট-বড় নগর গড়ে উঠতে লাগলো। এই কারণে আজও সারা দুনিয়াজুড়ে বড় বড় শহরগুলো, বিশেষত দেশের রাজধানীগুলো, সাধারণত কোন না কোন নদীর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা কোন্ নদীর তীরে অবস্থিত বললে সবাই এক বাক্যে বুড়িগঙ্গার নাম বলবেন, কিন্তু ঢাকা মহানগরের সীমানা ঘেঁষে আরও নদী আছে। ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে তুরাগ নদী, দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা নদী, উত্তর-পূর্বে বালু নদী আছে। প্রশাসনিক ভাগাভাগিকে বিবেচনায় না নিলে ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণ-পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীও আছে। ১৯৮৮ সালে যখন এই সব নদী উপচে বন্যা হয়েছিল তখন বন্যার পানি প্রশাসনিক ভাগাভাগি না মেনে ঢাকা মহানগরকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
এতোগুলো নদী থাকার পরেও ঢাকাকে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। প্রথমত, বুড়িগঙ্গা ঢাকাতে উৎপন্ন এবং মোটামুটি ঢাকাতেই এর শেষ। দ্বিতীয়ত, ঢাকা অংশে তুরাগ বা বালু নদীর চেয়ে বুড়িগঙ্গা এখন অপেক্ষাকৃত চওড়া ও গভীর। তৃতীয়ত, ঢাকার পুরনো অংশের প্রায় পুরোটাই বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা। চতুর্থত, ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য অংশ বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের সাথে নদী পথে যোগাযোগের জন্য বুড়িগঙ্গাই একমাত্র নদী। গায়ে গায়ে লাগোয়া উঁচু উঁচু ভবনে ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক ঢেকে যাবার আগে পর্যন্ত চলতি পথে দিগন্তে বুড়িগঙ্গা ঝিলিক দিত, তার তীর ঘেঁষে শহর প্রতিরক্ষার জন্য বানানো বাকল্যান্ড বাঁধের উপরে বানানো বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা গাড়িতে চড়ে বেড়ানো যেতো, নৌকা চড়ে বুড়িগঙ্গার বুক থেকে ঢাকার সৌন্দর্য দেখা যেতো।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে উৎপন্ন বংশাই নদী গাজীপুরের কড্ডাতে আসলে তার নাম হয়ে যায় 'কহর দরিয়া'। অবশ্য এই নামে আজ আর কেউ তাকে ডাকে না, তাকে বলে 'তুরাগ'। ঢাকার গাবতলীর কাছে তুরাগের সাথে মিলে যায় 'ধলেশ্বরী' নদীর শাখা নদী 'কর্ণতলী'। এই দুই নদীর মিলিত প্রবাহের নাম হলো 'বুড়িগঙ্গা'। স্বাভাবিক প্রশ্ন হচ্ছে এই মিলিত প্রবাহের নাম তুরাগ বা কর্ণতলী হলো না কেন? তুরাগ-কর্ণতলী সঙ্গমের মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে পশ্চিম দিক থেকে আগত ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখাও এই নদীটির সাথে যুক্ত হয়েছিল। সেই শাখাটির নাম ছিল 'বুড়িগঙ্গা'। ধলেশ্বরী 'যমুনা' নদী থেকে উৎপন্ন নদী হলেও তা 'ইছামতী' নদী দিয়ে 'গঙ্গা' বা 'পদ্মা' নদীর সাথেও যুক্ত। গঙ্গার যে প্রবাহটি ধলেশ্বরী হয়ে, 'মেঘনা' হয়ে শেষে বঙ্গপোসাগরে মিশেছে সেটিকেই বুড়িগঙ্গা বলা হতো। অবশ্য ধলেশ্বরী থেকে আগত এই শাখাটি ভাকুর্তার ছাগলাকান্দিতে পলিভরাট হয়ে মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বন্যা হলে এর প্রবাহ আবার বুড়িগঙ্গাতে যায়। একইভাবে ধলেশ্বরীর যে শাখাটি কলাতিয়ার আকছাইল থেকে বুড়িগঙ্গা নামে আটি বাজার হয়ে কামরাঙ্গীর চরের কাছে বুড়িগঙ্গাতে মিলেছে, উৎসমুখে তার অবস্থাও করুণ। বুড়িগঙ্গা শেষে জাজিরা-ফতুল্লাতে গিয়ে ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হয়ে ধলেশ্বরী নাম ধারণ করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার সাথে মিলিত হতে দক্ষিণ-পূর্বে এগিয়ে যায়।
উপরে বুড়িগঙ্গা ও অন্যান্য নদীর প্রবাহের যে বর্ণনা দেয়া হলো সেটা এখনকার মানচিত্র অনুসারে। ১৭৭৬ সালে জেমস রেনেলের করা মানচিত্র অনুযায়ী এই বর্ণনা ভিন্ন প্রকারের হবে। রেনেলের এই মানচিত্রে যমুনা নদী এখনকার আকারে নেই – এতো সরু যে তাকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। রেনেলের এই মানচিত্রটিতে বুড়িগঙ্গা নদী দেখানো হলেও তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। কর্ণতলী নদীকে তুরাগ (Taraag) বলা হয়েছে এবং সেটিকে বেশ প্রশস্ত আকারে দেখানো হয়েছে। ধলেশ্বরী থেকে আসা বুড়িগঙ্গার প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার দুটোই দেখানো হয়েছে বেশ সরু আকারে। তবে মূল বুড়িগঙ্গাকে প্রশস্ত আকারেই দেখানো হয়েছে। রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী পুরো নদীটিকে তুরাগ বলেই মনে হবে। ১৭৮০ সালে রেনেলকৃত 'A Bengal Atlas: Containing maps of the theatre of war and commerce on the side of Hindoostan' শীর্ষক মানচিত্রগুচ্ছে এর সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বুড়িগঙ্গাকে (Boorygonga) ধলেশ্বরীর হৃষ্টপুষ্ট শাখানদী হিসাবে দেখানো হয়েছে। তাতে তুরাগ যুক্ত হবার আগে আরও দুটি ছোট নদী এবং পরবর্তীতে ধলেশ্বরীর আরও দুটি ধারা যুক্ত হতে দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, ফতুল্লা'র কাছে বুড়িগঙ্গার একটি শাখা নদী নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর ভাগের উপর দিয়ে গিয়ে হাজীগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে যুক্ত হতে দেখানো হয়েছে। এই নদীটি বর্তমানে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর সাথে যুক্ত হবার পরে মিলিত ধারা থেকে উৎপন্ন আরও একটি নদী নারায়ণগঞ্জ শহরের দক্ষিণ ভাগের উপর দিয়ে গিয়ে শীতলক্ষ্যার সাথে যুক্ত হতে দেখানো হয়েছে। এই নদীটি বর্তমানে কাশীপুর নদী/খাল নামে পরিচিত, এর পশ্চিমাংশ যা দিয়ে এটি ধলেশ্বরীর সাথে যুক্ত ছিল তা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য মোটে ২৯ কিলোমিটার। গড় প্রশস্ততা ৪০০ মিটার, গড় গভীরতা ৭.৬ মিটার, আর সর্বোচ্চ গভীরতা ১৮ মিটার। চল্লিশ বছর আগে এর সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ছিল প্রায় তিন হাজার কিউসেক, এখন সেটা মোটামুটি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে পোস্তগোলা, বাবুবাজার ও বসিলাতে তিনটি কংক্রিটের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া বুড়িগঙ্গার ২৭টি ফেরিঘাট ও খেয়াঘাট দিয়েও যাত্রী পারাপার এবং মালামাল পরিবহন করা হয়ে থাকে। ২০শে জুলাই ১৬৭৮ সাল থেকে ৬ই অক্টোবর ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত মুঘল শাহযাদা মুহম্মদ আযম শাহ্ বাংলার গভর্নর বা সুবাহ্দার ছিলেন। তাঁর সময়ে ঢাকার নিরাপত্তার জন্য বুড়িগঙ্গার খুব কাছে লালবাগে একটি কেল্লা স্থাপন করা শুরু হয়, যদিও সেটি তিনি বা তাঁর পরবর্তী সুবাহ্দার শায়েস্তা খান (১৬৮০ – ১৬৮৮) সেটির নির্মাণ কাজ শেষ করেননি। শাহযাদা আযম কেল্লা বরাবর নদীর তীর ঘেঁষে বাবুবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। এটি সম্ভবত নদী শাসন ও তীরের প্রহরার সুবিধার্থে করা হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে ঢাকায় ব্যাপক মাত্রায় ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে প্রচুর ব্যবসাকেন্দ্র ও বসতি স্থাপিত হয়, কিন্তু নতুন করে কোন শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয় না। ১৮৬৪ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কমিশনার চার্লস থমাস বাকল্যান্ড বুড়িগঙ্গার তীরের ভাঙন রোধ, নৌযান থেকে যাত্রী ও পণ্য ওঠানামা করার সুবিধার্থে ফরাসগঞ্জ থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত প্রায় এক মাইল লম্বা একটি বাঁধ এবং বাঁধের সমান্তরালে পাথরে বাঁধানো রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে তিনি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তাঁর কার্যকালের পাঁচ বছরেও বাঁধটি ও রাস্তা নির্মাণের কাজ শেষ না হলে তাঁর পরবর্তী কমিশনার সিমসন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে আবারও অনুদান ও ঋণ সংগ্রহ করে কাজটি শেষ করেন, চার্লস বাকল্যান্ডের নামানুসারে বাঁধটি বাকল্যান্ড বাঁধ নামে পরিচিত। বাঁধটি নির্মাণের পরবর্তী প্রায় একশ' বছর ধরে এটি ঢাকাবাসীদের কাছে পছন্দের প্রাত্যহিক বেড়ানোর জায়গা ছিল। বাঁধ থেকে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এর উপরে লোহার বেঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। তাছাড়া সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গার তীরে একটি ছোট উদ্যানও গড়ে তোলা হয়। ১৯৬৩ সালে বাঁধ ও তৎসংলগ্ন উদ্যান ও পথ রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব স্থানীয়দের কাছ থেকে সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এর পর থেকে যথাযোগ্য রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে বাঁধটি এবং তৎসংলগ্ন রাস্তা ও উদ্যান ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। জায়গা বেদখল হয়ে পুরো বাঁধ এলাকাটি ঘিঞ্জি ও নোংরা রাস্তায় পরিণত হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর নাম উচ্চারণ করলে এর সাথে অবধারিতভাবে প্রথম যে শব্দটি সবার মনে উদয় হবে তা হচ্ছে 'ঢাকা'। বস্তুত ঢাকা ও বুড়িগঙ্গা অবিচ্ছেদ্য। জ্ঞাতকাল থেকে বাংলার রাজধানী নগর বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু রাজধানী নগর বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন তান্দ্রা। ১৬১০ সালে মুঘল শাসনের গোড়ার দিকে প্রথম বারের মতো ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। শাহযাদা সুজা'র গভর্নর থাকার সময়টুকু বাদ দিলে ১৭০৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার এই মর্যাদা টিকে থাকে। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকা আবার তার মর্যাদা ফিরে পায়। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই প্রথম ঢাকা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। রাজধানী হিসাবে বার বার ঢাকাকে বেছে নেবার পেছনে বুড়িগঙ্গার ভূমিকা অপরিসীম। পদ্মা, মেঘনা বা ধলেশ্বরী নদী বুড়িগঙ্গার চেয়ে অনেক বড় নদী হলেও সেগুলো ব্যাপক ভাঙনপ্রবণ। ফলে তার তীরবর্তী বড় শহরগুলোকে নিয়মিত তীর থেকে সরে যেতে হয়। যেমন, পদ্মার তীরবর্তী বিক্রমপুরকে কোন কোন সময়ে কোন কোন রাজ্যের রাজধানী করা হলেও নদী ভাঙনের কারণে তা ধরে রাখা যায়নি। বিক্রমপুরের অনেক সমৃদ্ধ এলাকা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে যেহেতু ঢাকার ভূপৃষ্ঠে ও ভূত্বকের স্বল্প গভীরতার স্তর 'মধুপুর কর্দমশিলা' দিয়ে গঠিত তাই বুড়িগঙ্গা নদীর গতিপ্রবাহ সুস্থিত, পাড়ও ভাঙনপ্রবণ নয়। এ'কারণে গত চারশ বছরের বেশি সময়ে ঢাকার বড় কোন অংশ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবার ইতিহাস নেই। বুড়িগঙ্গার ভাটি অঞ্চল সারা বছর নাব্য থাকে বলে ঢাকার সাথে নদী যোগাযোগ ব্যাহত হয় না। একই কারণে সদরঘাট এখনো দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ঢাকা শহরের সবচেয়ে পুরনো টিকে থাকা স্থাপনাটি হচ্ছে ১৪৫৭ সালে নির্মিত নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদ। ইলিয়াস শাহী আমলের দ্বিতীয় পর্বে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে জনৈক মারহামাতের কন্যা মুসাম্মাৎ বখত বিনত এটি নির্মাণ করেন। সুলতানী আমল দূরে থাক তার পরবর্তী দেড়শ বছরেও বাংলার শাসকদের কাছে ঢাকা কোন গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল না। মুঘলরা ছাড়া ঢাকাকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কৃতিত্বের কিছুটা বহিরাগত ইউরোপীয়দের প্রাপ্য। ১৫৭৪ সালে বাংলায় মুঘল শাসন শুরু হতে না হতে ১৫৮০ সালেই পর্তুগীজরা ঢাকায় বসতি স্থাপন করে এবং ঢাকার মাধ্যমে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মসলিনসহ তুলা ও রেশমজাত দ্রব্য রফতানী শুরু করে। স্থলপথে পশ্চিম দিক থেকে আগত ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ বা বিদেশীরা ঢাকাতে যা করতে পারেনি বুড়িগঙ্গা বেয়ে আসা পর্তুগীজরা সেটা শুরু করতে সক্ষম হয়। পর্তুগীজদের দেখাদেখি বুড়িগঙ্গা দিয়ে বহির্বাণিজ্যের এই সুযোগটি অন্যান্য ইউরোপীয়রাও নিয়েছিল। ১৬৩৬ সালে ওলন্দাজরা ঢাকায় প্রথম আসলেও তারা ১৬৬৬ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে বর্তমান সলিমুল্লাহ্ মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় বাণিজ্যকেন্দ্র ও বর্তমান ফার্মগেট এলাকায় বসতি স্থাপন করে। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে আর্মেনীয়রাও ঢাকায় আসা শুরু করে। তারাও বুড়িগঙ্গার তীরে নলগোলা, মৌলভীবাজার এলাকায় বাণিজ্যকেন্দ্র, এবং পরবর্তীতে আরমানিটোলায় বসতি স্থাপন করে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে গ্রীকরা কলকাতা থেকে এসে বুড়িগঙ্গার তীরে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। পরবর্তীতে গ্রীক ও আর্মেনীয়রা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিশাল ব্যাপ্তিতে পাটের ব্যবসা শুরু করে। ১৭৪০ সালে ফরাসীরা আহসান মঞ্জিলের কাছে বুড়িগঙ্গার তীরে কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য শুরু করে। পরবর্তীতে তারা বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে 'ফরাশগঞ্জ' নামে ফরাসী বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলে। ১৭৪৬ থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে ফরাসীরা ঢাকা থেকে যে পরিমাণ পণ্য রফতানী করেছিল তার পরিমাণ তৎকালীন মূল্যে গড়ে বার্ষিক প্রায় ২,৮৫,০০০ টাকা।
বুড়িগঙ্গা দিয়ে ঢাকায় প্রথম বহিরাগত আক্রমণ হয় ১৬০৩ সালের মার্চে। মগ জলদস্যুরা পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তায় ঢাকার উপকণ্ঠের ত্রিমোহনীতে মুঘলদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে মগদের পিছু হঠতে হয়। বুড়িগঙ্গা বেয়ে মগদের বিচ্ছিন্ন আক্রমণ চলতে থাকে পরের প্রায় দুই দশক। ১৬২০ সালে মগরা বিপুল শক্তিতে নৌপথে ঢাকা আক্রমণ করলে মুঘল সুবাদার মীর্জা ইব্রাহিম বেগ তাদেরকে সাফল্যের সাথে পরাভূত করতে ও তাদের ৪০০ যুদ্ধ-নৌযান দখল করতে সক্ষম হন। বস্তুত মগরা ছাড়া অন্য কোন বহিঃশত্রু বুড়িগঙ্গা দিয়ে ঢাকা আক্রমণ করতে আসেনি।
বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতি স্থাপন ক্রমে ঢাকাকে অখ্যাত এক অঞ্চল থেকে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত করে। পরবর্তীতে ভৌগলিক অবস্থান, যোগাযোগের সুবিধা, কৌশলগত নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনায় সপ্তদশ শতকের শুরুতে ঢাকা রাজধানী নগরীতে পরিণত হয়। এর প্রায় এক শতক পরে কেন্দ্রীয় মুঘল শাসনের দুর্বলতার কারণে বাংলার দিওয়ানরা স্বাধীন নবাব হিসাবে আবির্ভূত হলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে রাজধানী কলকাতায় স্থাপিত হলে কলকাতার সাথে ঢাকার যোগাযোগ স্থাপন জরুরী হয়ে পড়ে। গোটা বাংলাজুড়ে প্রধানত উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবহমান নদীর জন্য পূর্ব-পশ্চিম বরাবর যোগাযোগ সব সময়েই কঠিন ছিল। ১৮৭১ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু করলে গোয়ালন্দ থেকে স্টীমারযোগে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকার সাথে যোগাযোগের উপায় হয়। ৪ঠা জানুয়ারী ১৮৮৫ থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ চালু হলে এই পথে যাত্রী যোগাযোগ সহজতর হয়। কিন্তু তখনও পণ্য পরিবহনের জন্য বুড়িগঙ্গা দিয়ে যোগাযোগই সহজতর ছিল।
এক হিসাবে বুড়িগঙ্গা মূলত একটি 'নাগরিক নদী'। বুড়িগঙ্গার পানির ওপর নির্ভর করে বড় আকারের কোন কৃষি অঞ্চল গড়ে ওঠেনি। এর দু'পাশে গ্রামের সংখ্যাও কমে হ্রাস পেতে পেতে এখন অনুল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেমে এসেছে। গত চার শতকেরও বেশি সময় ধরে বুড়িগঙ্গার দুই তীরে কেবল নগরায়ণই হয়েছে, এবং এর ওপর নির্ভরশীল নাগরিকের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৫২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫৯,০০০। বিশ বছর পরে ১৯৭২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১,৬৮৮,০০০-এ। মানে বিশ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা ৪৭০% বৃদ্ধি পায়। তারও বিশ বছর পরে ১৯৯২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা এর ৪৩৫% বেড়ে দাঁড়ায় ৭,৩৪৪,০০০-এ। তার বিশ বছর পরে ২০১২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা এর ২১৫% বেড়ে দাঁড়ায় ১৫,৮১৬,০০০-এ। এর দশ বছর পরে ২০২২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ২২,৪৭৮,০০০, জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ বছর আগের ১৪২%। অর্থাৎ গত সত্তর বছরে ঢাকার জনসংখ্যা ৬,২৬১% বা ৬২.৬১ গুণ বেড়েছে। শনৈ শনৈ গতিতে ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বুড়িগঙ্গার ওপর বিপুল চাপ পড়েছে।
'বুড়িগঙ্গা' নামটির সাথে ঢাকার পরে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তা হচ্ছে 'দুষন'। দ্রুত গতিতে ক্রমবর্ধমান ঢাকার জনসংখ্যা বুড়িগঙ্গার পানি যতটুকু না ব্যবহার করেছে তার চেয়ে ঢেড় বেশি ব্যবহার করেছে ভূগর্ভস্থ পানি। এতে বুড়িগঙ্গার পানির পরিমানে প্রভাব পড়েছে। বুড়িগঙ্গার উৎস নদীগুলোতে পানির প্রবাহ হ্রাস, পলি পড়ে নাব্যতা হ্রাস পাওয়াও পানির পরিমান কমেছে। ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠী দৈনিক প্রায় ৪,৫০০ টন প্রাত্যহিক বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য নিক্ষেপের জন্য প্রধানত বুড়িগঙ্গাকে বেছে নেয়ায় এর পানি দুষিত হতে থাকে। দুষনের হার জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে এর তীর ঘেঁষে চামড়া, রাবার, প্লাস্টিকসহ অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায়। শিল্প বর্জ্য, বিশেষত হাজারীবাগে গড়ে ওঠা ৩৪৩টি ট্যানারি থেকে নিক্ষিপ্ত দৈনিক প্রায় ২১,৬০০ ঘন মিটার চামড়া শিল্পের বর্জ্য; জিঞ্জিরা কেরাণীগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা ৬২৭টি ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিক্ষিপ্ত দৈনিক প্রায় ৫,০০০ ঘন মিটার বর্জ্য; ফতুল্লা, ফরিদাবাদ ও বসিলা এলাকার ১০৪টি রাসায়নিক কারখানা থেকে নিক্ষিপ্ত দৈনিক ৯,০০০ ঘন মিটার বর্জ্যের দরুন বুড়িগঙ্গা সারা দুনিয়ার সবচেয়ে দুষিত নদীগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে যায়। গত শতকের আশির দশক থেকে প্লাস্টিক পণ্য, বিশেষত পাতলা পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবহৃত পলিথিনের স্তর জমে বুড়িগঙ্গার অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। শিল্প বর্জ্যের দরুণ বুড়িগঙ্গার পানির তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পর্যন্ত উঠে যায়, এবং এর দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ১.১১ মিলিগ্রাম/লিটারে নেমে আসে যা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর। পানির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হলে এবং এতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৫ মিলিগ্রাম/লিটারের কম হলে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্ষতিকর নাইট্রেট, ফসফেট, সালফেট লবণের মাত্রাও অতি উচ্চ। বুড়িগঙ্গার পানি বহু আগেই তার স্বচ্ছতা হারিয়ে এখন ঘন কালো, ভারি এক তরলে পরিণত হয়েছে। এর নাব্যতাও হ্রাস পেয়েছে। বুড়িগঙ্গার দুই পাশে এখন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য নেই, আছে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফসল - কংক্রিটের জঙ্গল।
ঢাকাসহ বুড়িগঙ্গার দুই তীরবর্তী মানুষের নিজেদের স্বার্থেই বুড়িগঙ্গাকে দুষনমুক্ত করা, এর নাব্যতা বৃদ্ধি, এর বুকে নৌযান চলাচল সীমিতকরণ, এবং এর সৌন্দর্যবর্ধণ আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন নদীর দুই তীর থেকে অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা উচ্ছেদ করে জমি উদ্ধার করা, অবৈধ ড্রেজিং বন্ধ করা, শিল্পকারখানাগুলোকে দূরবর্তী কোথাও স্থানান্তর, প্রাত্যহিক ও পয়ঃবর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করা, নদীর দুই তীর বাঁধিয়ে তাতে বৃক্ষরোপন কর। এছাড়া বুড়িগঙ্গার বক্ষ থেকে পলিথিনসহ অন্যান্য কঠিন বর্জ্য উত্তোলন এবং পানির গুণগত মানোন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাগ্রহন প্রয়োজন। বুড়িগঙ্গাতে নৌচলাচল সীমিতকরণের উদ্দেশ্যে সদরঘাট টার্মিনাল ও পানগাঁও অভ্যন্তরীন কন্টেইনার বন্দরকে আরও দক্ষিণে ফতুল্লা এলাকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ফতুল্লা ঢাকা মহানগরের সাথে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি সংযুক্ত বলে এটি করা সহজতর হবে। পয়ঃ বা শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য আসলে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন নতুবা এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় না হলেও অন্য কোন নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাকে আরেক বুড়িগঙ্গায় পরিণত করবে।
ঢাকাকে বিশ্বমানের মহানগরে পরিণত করতে বুড়িগঙ্গাকে দুষনমুক্তকরণ ও এর সৌন্দর্যবর্ধণের বিকল্প নেই। এর জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আবশ্যিক বটে, তবে তার সাথে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতার। বুড়িগঙ্গার দুই তীরের নাগরিকগণ যতদিন পর্যন্ত না নিজেরা সচেতন হবেন ও বুড়িগঙ্গাকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন ততদিন পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা আমাদের গর্বের পরিবর্তে লজ্জার এক নদী হয়ে থাকবে।