ইংল্যান্ড বনাম জার্মানি: ফুটবল ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল যে দ্বন্দ্ব
ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, ফুটবল ইতিহাসে এমন নজির আর দ্বিতীয়টি নেই।
দুই দলের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে জড়িয়ে আছে কয়েক দশকের ইতিহাস, অসংখ্য স্মৃতি, হাসি-কান্না। আর সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ডের দুঃখ হিসেবে আছে পেনাল্টি শুটআউট।
আসছে মঙ্গলবার ইউরো ২০২০ এর কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইয়ে নতুন করে ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায় যুক্ত করতে যাচ্ছে দুই দল।
২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানি এখন পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে আছে। ইংল্যান্ডে নিঃসন্দেহে এই দ্বন্দ্বে বেশ শক্তিশালী, পিছিয়ে নেই জার্মান ভক্তরাও।
১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ড ছেড়ে জার্মানিতে চলে আসেন স্টুয়ার্ট ডাইকস। দুই দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে ডাইকস এর। এরই মধ্যে তিনি বুন্দেসলিগার দুটি ক্লাব অফিসে কাজ করেছেন। ডাইকস এই দ্বন্দ্বকে উভয় দেশের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন।
সিএনএনকে ডাইকস বলেন, 'আমার মনে হয় এটা জার্মানির জন্য সবচেয়ে বড় খেলা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জার্মানি মাঠে নামা মানেই বাকি সবকিছুর উর্ধ্বে। ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না হলেও, ইতিহাস আর পটভূমির বিচারে তো বটেই।'
'ইংল্যান্ড হলো ফুটবলের আঁতুড়ঘর, ওয়েম্বলেকেও তাই মনে করা হয়। তাই এটা নিঃসন্দেহে জার্মানদের জন্য বিশেষ কিছু। তবে দুই দলই জেতার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে', বললেন ডাইকস।
ফুটবলকে বদলে দিয়েছিল যে খেলা
২০১০ বিশ্বকাপে শেষবার জার্মানির মুখোমুখি হওয়ার সেই ম্যাচের কথা বোধহয় আর স্মরণ করতে চাইবেন না ইংল্যান্ডের ভক্তরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লোয়েমফন্টেইন এর সেই ম্যাচে ৪-১ গোলে জয়লাভ করে জার্মানি। কিন্তু খেলার ফলাফলের বাইরেও, সেদিন ঘটনাবলী ফুটবল জগতে নিয়ে এসেছিল নতুন মোড়।
সেদিনের ম্যাচে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের করা 'ভৌতিক গোল' ই আধুনিক গোল-লাইন প্রযুক্তি চালুর পথ করে দেয়।
খেলার ফলাফল যখন ২-১, তখন ইংলিশ মিডফিল্ডার ভেবেছিলেন, ম্যানুয়েল নয়্যারকে ফাঁকি দিয়ে তিনি খেলার সমতা ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু বল স্পষ্ট ক্রসবার ছুঁয়ে চলে গেলেও, কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েনি এবং তার সেই গোলের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
এই ঘটনার জেরে ইংল্যান্ড জুড়ে ক্ষোভের ঝড় উঠে। এমনকি খেলার গভর্নিং বডিকে ক্ষমাও চাইতে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপেই ফিফা আধুনিক গোল-লাইন প্রযুক্তি চালু করে এবং ২০১৮ সালের মধ্যেই আমরা ভার (ভিএআর) প্রযুক্তির বাস্তবায়ন দেখতে পাই।
পেনাল্টি নিয়ে যত দুর্দশা
ইতিহাসে ইংল্যান্ডের জন্য শুধু যে হতাশা আর নেতিবাচক দিকই আছে, তা নয়।
ডেভিড বেকহাম, মাইকেল ওয়েন ও স্টিভেন জেরার্ড এর মত চমৎকার সব খেলোয়াড়দের নিয়ে ২০০১ সালে ওয়েম্বলিতে বিশ্বকাপে কোয়ালিফায়ারের ম্যাচে জার্মানিকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষেও জয় পেয়েছিল তারা, যদিও সেই ম্যাচ নিয়েও আছে নানা বিতর্ক।
তবে সত্যি বলতে, জার্মানির বিপক্ষে ইংল্যান্ডের দুর্দশার ও লাখো ইংরেজের হৃদয়ভঙ্গের পেছনে বড় কারণ হিসেবে আছে পেনাল্টি।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি এবং ইউরো ১৯৯৬, দুই বারেই জার্মানির কাছে পেনাল্টি শুটআউটে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে ইংল্যান্ড।
১৯৯০ সালের সেই ম্যাচে হলুদ কার্ড দেখার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইংল্যান্ডের পল গাসকয়েন। কারণ সেই হলুদ কার্ডের ফলে তিনি ফাইনাল খেলতে পারেননি।
আর ফুটবল জগতে অতি পরিচিত সেই বিখ্যাত উক্তি তো সবারই জানা- 'ফুটবল এমন একটা খেলা যেখানে ২২ জন মানুষ ৯০ মিনিট একটা বলের পেছনে ছোটে এবং দিনশেষে জার্মানরা জিতে'।
ইংল্যান্ড দলের বর্তমান ম্যানেজার গ্যারেথ সাউথগেটও ১৯৯৬ সালে ওয়েম্বলিতে চূড়ান্ত মুহূর্তের এক পেনাল্টি মিস করেছিলেন। মঙ্গলবারের খেলায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক, তা নিশ্চয়ই চাইবেন না ইংল্যান্ড ভক্তরা।
ডাইকস বলেন, 'এটা আসলে জার্মান ভক্তদের কাছে বেশ মজার ব্যাপার যে ইংরেজরা পেনাল্টি নেয়াতে মাত্রাতিরিক্ত অদক্ষ। আমি একটা খবরের শিরোনামও দেখেছি যেখানে লেখা- ইংল্যান্ড জার্মানিকে হারাতে পারবে, তবে পেনাল্টিতে নয়।'
ওয়েম্বলির জাদু
কোভিড-১৯ সম্পর্কিত নানা বিধিনিষেধের মধ্যেই আগামী মঙ্গলবার ওয়েম্বলির ম্যাচ সরাসরি দেখতে জড়ো হবেন ৪০ হাজার দর্শক। কিন্তু ডাইকস মনে করেন, ওয়েম্বলি আসলে দুই পক্ষের ভক্তদের জন্যই একটা জাদুকরী জায়গা।
'ওয়েম্বলিতে একটা প্রীতি ম্যাচ জেতাও অনেক বড় ব্যাপার। তবে এটা খুবই লজ্জাজনক যে কোভিডের কারণে এবার খুব বেশি জার্মান এই খেলা দেখতে যেতে পারবেন না। ওয়েম্বলি আসলে জার্মান ফুটবল ভক্তদের জন্য সেরা জায়গা', আরও বললেন ডাইকস।
ইংলিশ গণমাধ্যমের কিছু ট্যাবলয়েড অবশ্য এখনো দুই দলের ফুটবলীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে দুই দেশের রাজনৈতিক অতীত ও দুটি বিশ্বযুদ্ধকেও টেনে আনতে চান।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একে ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন। তাদের কাছে এর মানে দুটি শক্তিধর দল, এক ঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় নিয়ে গড়া স্কোয়াড এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলের অদ্বিতীয় এক ইতিহাস।
'আমাদের খেলোয়াড়দের কাছে ইতিহাস খুব একটা চিন্তার বিষয় নয়। মাঠের খেলায় জার্মানি কোন কোন দিকে ভালো আর আমরা কোন কোন দিকে বেশি জোর দেখাতে পারবো সেটাই মুখ্য', মঙ্গলবারের ম্যাচ নিয়ে এমনটাই ভাবছেন ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় জর্ডান হেন্ডারসন।
- সূত্র- সিএনএন