তিন বলে তিন: রেকর্ডটা যেই ভাঙুক, আমি এক নম্বরে থাকব
সোহাগ গাজী, সাত বছর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে টেস্টে বিস্ময়কর হয়ে উঠেছিল এই ক্রিকেটারের নামটি। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাস যা কখনই দেখেনি, সেটাই করে দেখান বাংলাদেশের এই ক্রিকেটার। ক্রিকেটের অভিজাত এই ফরম্যাটে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে কিউইদের বিপক্ষে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক করেন গাজী।
ভুবন ভোলানো পারফরম্যান্স, সোহাগ গাজীরও বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঘোর লাগা এক অনুভূতি কাজ করছিল। ডানহাতি এই স্পিনারের ব্যাটে-বলে টেস্ট ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে নতুন পাতা যোগ হয়। এখনও সেই পাতায় গাজীর একক আধিপত্য। টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয়বার আর এই ঘটনা ঘটেনি, কোনো ক্রিকেটার একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক করতে পারেননি।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ বোলার হিসেবে টেস্টে হ্যাটট্রিক করা গাজী আগে ব্যাট হাতে ছড়ি ঘোরান। আট নম্বরে নেমে অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংস খেলেন এই ডানহাতি। এরপর বল হাতে হ্যাটট্রিকসহ নেন ৬ উইকেট। মধুর সেই স্মৃতি মনে পড়লেই পুলকিত হন দেশের হয়ে ১০ টেস্ট, ২০ ওয়ানডে ও ১০টি টি-টোয়েন্টি খেলা গাজী।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছেন সোহাগ গাজী। হ্যাটট্রিকে একজন বোলারের কেমন অনুভূতি হয়, হ্যাটট্রিক করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, এখনও কীভাবে মনে পড়ে; এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই ক্রিকেটার। তার মুখেই শো যাক সে গল্প।
সোহাগ গাজী: হ্যাটট্রিক তো আসলে অনেক বড় পাওয়া। সব পর্যায়েই হ্যাটট্রিক আনন্দ দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হ্যাটট্রিক অন্যরকম একটা অনুভূতি দেয়। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে হ্যাটট্রিকের, অনুভূতিটা পুরনো। কিন্তু এটা কখনই ভোলার নয়।
সত্যি বলতে তখন আমি বুঝিনি হ্যাটট্রিক ও সেঞ্চুরিতে বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে বা এটা বিশাল কোনো পর্যায়ে চলে গেছে। প্রেস কনফারেন্সে যখন জানা হয়েছে, খুবই ভালো একটা অনভূতি কাজ করছিল। দলের সবাই আমাকে নিয়ে খুব খুশি ছিল। প্রশংসা করছিল সবাই। ঘরোয়াতেও আমার এমন একটা পারফরম্যান্স আছে। ভাগ্যক্রমে আন্তর্জাতিকেও হয়ে গেছে।
যে ক্যাচটা সাকিব ভাই ধরেছিলেন, ওটা ছিল প্রথম স্লিপের ক্যাচ। অসাধারণ একটা ক্যাচ ছিল। ওটা ছাড়া আমার হ্যাটট্রিক হতো না। তো হ্যাটট্রিকে আমার যদি ৫০ ভাগ কৃতিত্ব থাকে, উনারও ৫০ ভাগ আছে। উনার জন্যই হ্যাটট্রিকটা হয়েছে, বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে।
ওই পারফরম্যান্সের অনভূতিটা আসলে সেভাবে তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু এটা নিয়ে যখন ভালোভাবে শুনেছি, জেনেছি, তখন মনে হয়েছে এটা কতবড় একটা ব্যাপার।
ওই ম্যাচে আসলে ব্যাটিংয়ের কথা আগে মনে পড়ে। আমি সব সময়ই আমার ব্যাটিংটা একটু দেখি। সেঞ্চুরিটার কথা মনে পড়ে। তখন হয়তো খুব আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলতাম, ব্যাটিং করতাম। ব্যাটিংটা একটু পারি। প্রথম শ্রেণিতেও সেঞ্চুরি ছিল। তো সেঞ্চুরিটা আমাকে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক ব্যাটসম্যানেরও সেঞ্চুরি নেই।
বোলার হিসেবে শুরু করে ক্যারিয়ারে অনেক কিছুই পেয়েছি। ব্যাটসম্যান হিসেবেও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়েছি। সেই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক করে বিশ্ব রেকর্ডের কথা যখন জানতে পারি, অসাধারণ এক অনভূতি কাজ করছিল। ঘোর লাগা এক অনুভূতি কাজ করছিল।
ওই উইকেটটা আসলে বোলারদের জন্য সুবিধার ছিল না। হ্যাটট্রিক করার আগে আমি আট নম্বরে সেঞ্চুরি করি। তো আট নম্বরে নেমে কোনো বোলার যখন সেঞ্চুরি করে, সেই উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু থাকে না। এমন একটা উইকেটে হ্যাটট্রিক করা অবশ্যই বড় এক অর্জন।
মনে পড়লে ভালো লাগা কাজ করে। মনে হয় হয়তো দেশের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। ওই ম্যাচে আমার পারফরম্যান্সে দলের জন্য সুবিধা হয়েছিল। আমরা জেতার অবস্থাতেই ছিলাম। যদিও ম্যাচটি ড্র হয়েছিল। বৃষ্টির কারণে হয়তো ওরা বেঁচে গিয়েছিল। না হলে আমরাই জিততাম।
আমি ম্যাচ সেরা হই। মনে আছে মুমিনুলও দারুণ ব্যাটিং করেছিল। ওর কাছেই ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা যাওয়ার কথা। এক কথায় ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া। ভালো লাগছিল। তবে সত্যি বলতে সাথে সাথেই বুঝিনি যে টেস্ট ইতিহাসে আমিই প্রথম এমন পারফরম্যান্স করেছি।
সব সিনিয়র খেলোয়াড়ই সাহায্য করেছেন, সমর্থন দিয়েছেন। পাশাপাশি অধিনায়কের আমার প্রতি একটা বিশ্বাস ছিল। তখন আমি নতুন বলে বোলিং করতাম। টেস্টে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি; তিন ফরম্যাটেই আমি নতুন বলে শুরু করতাম। তো মুশফিক ভাইয়েরও অবদান আছে এই হ্যাটট্রিকের পেছনে।
হ্যাটট্রিকের আগে নতুন বল যখন নেওয়া হয়, মুশফিক ভাই বলছিলেন নতুন বলে তু্ই ওই পাশ থেকে শুরু করবি। নতুন বলে আমার একটা সুবিধা ছিল। সেটাই আমি কাজে লাগাই। আমার চিন্তা ছিল স্টাম্পে বোলিং করব। তো হয়ে গেছে। কোরি অ্যান্ডারসনকে এলবিডব্লিউতে আউট করার পর মুশফিক ভাই ভালো একটা ক্যাচ নেন।
হ্যাটট্রিক বলটা করার সময় ৫০-৫০ মনে হয়েছে। মনে হচ্ছিল হয়ে যেতে পারে হ্যাটট্রিকটা। তখন ফিল্ডিংয়ে সবাই আকমণাত্মক মেজাজে ছিল। এ ছাড়া ব্রেসওয়েল তেমন পিউর ব্যাটসম্যান ছিল না। এই সুযোগটাই আমি নিয়েছি। নতুন বলে আমি যে জায়গাটায় বোলিং করি, সেখানেই করেছি। মুশফিক ভাই ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন। আমি আমার জায়গায় বলটা করি। এরপর তো হ্যাটট্রিকটা হয়ে যায়।
হ্যাটট্রিকের অনুভূতিটা আসলে মুখে বলে বোঝানো কঠিন। যে করে কেবল সেই বুঝতে পারে কত বড় একটা অর্জন সে করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা অনেক বড়। এর সাথে আবার সেঞ্চুরি। ঘরোয়া ক্রিকেটের মতো এখানেও এটা হবে, আমি সেটা কল্পনাও করতে পারিনি।
বোলার হিসেবে একজন হ্যাটট্রিক করতে পারেন। ৫০টি টেস্ট বা ৫০টি ওয়ানডে খেললে হ্যাটট্রিক যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে। কিন্তু বোলার হয়ে ১০০ করা খুবই কঠিন। এ ছাড়া সে সময় নিউজিল্যান্ড টেস্টে খুব ভালো একটা দল ছিল। ভালো বোলিং আক্রমণ ছিল। তাদের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করায় ভালো লাগছিল। দলেরও কাজে এসেছিল, সব মিলিয়ে দারুণ এক অনুভূতি। ব্যাটসম্যানের ভূমিকা নিয়ে সেঞ্চুরি করাটা সব সময়ই ভালো লাগার মতো ব্যাপার।
নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করাটা আনন্দ পাওয়ার মতোই। সব সময়ই ওরা একটা পজিশনে থাকে। তিন-চারটা দল ধরলে ওরা একটা। তো ওদের মতো ওইরকম ব্যাটিং আক্রমণের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা সত্যিই স্পেশাল। এ ছাড়া আমার তখন অতটা অভিজ্ঞতা ছিল না। মাত্র শুরু করেছি। অভিজ্ঞতা না থাকলে টেস্টে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের উইকেট নেওয়া খুব কঠিন।
ওদের দলে ম্যাককালাম, টেলর, উইলিয়ামসনদের মতো ব্যাটসম্যান ছিল। সব মিলিয়ে বড় একটা অর্জন। এ ছাড়া তখন আমরা পুরো বছরে ৩-৪টা টেস্ট খেলতাম। এখন হয়তো বেড়েছে। তখন এমন ছিল না। বোলারদের অভিজ্ঞ হতে সময় লাগতো। সেখানে এমন বড় দলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছি আমি, সব মিলিয়ে আমার জন্য বড় একটা পাওয়া ছিল।
একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক; এখন পর্যন্ত এটাই আমার ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স। এটাকেই আমি এক নম্বরে রাখব। কারণ এটা অনেক দিন থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে। হয়তো আমি একটা সময় দুনিয়া থেকে বিদায় নিবো। এরপর যারা আসবে, যে এই রেকর্ডটা ভাঙবে সে কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। রেকর্ডটা যেই ভাঙুক, আমি এক নম্বরে থাকব। তখন তারা ভাববে, ক্রিকেট আবিষ্কারের পর বাংলাদেশের কেউ এই রেকর্ডটা প্রথম করেছিল।