বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচিত ব্যক্তি কে এই গানিম আল মুফতাহ?
এবারে কাতার বিশ্বকাপের শুরুটা হয়েছে একেবারেই ব্যতিক্রমীভাবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যসব বারের মতো ছিল না অতিমাত্রায় আলোর ঝলকানি, নাচ-গানের আড়ম্বর এবং তারকার মেলা। বরং রোববার(২০ নভেম্বর) কাতারের আল-বাইত স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে, এরপরেই হলিউড অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যানকে দেখা গেছে মঞ্চে... কিন্তু মঞ্চে তিনি একাই ছিলেন না, তার সাথে কথপোকথন চালিয়েছেন এক তরুণ, যার শরীরের নিম্নাংশ নেই।
বিশ্বকাপের মঞ্চে এবারই প্রথম এমন দৃশ্য দেখলো কোটি কোটি দর্শক। মর্গান ফ্রিম্যানকে নাহয় সবাই চেনেন, কিন্তু তার সঙ্গে থাকা সেই কাতারি তরুণ কে? কী তার পরিচয়? কেনই বা তাকে নিয়ে তোলপাড় ইন্টারনেট জগতে?
মর্গান ফ্রিম্যানের সঙ্গে বিশ্বকাপের এক মঞ্চে জায়গা করে নেওয়া এই তরুণের নাম গানিম আল মুফতাহ। শারীরিক দিক থেকে আর দশটা সুস্থসবল মানুষের মতো না হয়েও তিনি হয়ে উঠেছেন উপসাগরীয় অঞ্চলের বহু মানুষের অনুপ্রেরণা, কাতারের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি একজন আইকন!
গানিম আল মুফতাহর জন্ম হয়েছিল তার মায়ের জমজ সন্তানদের একজন হিসেবে। জন্মের সময়ই কাডল রিগ্রেসন সিনড্রোম নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হন তিনি, যার ফলে তার দুই পা সহ নিম্ন মেরুদণ্ডের বিকাশ ব্যহত হয়। কিন্তু শারীরিক প্রতিকূলতা নিয়েই বেঁচে আছেন ২০ বছর বয়সী গানিম। এবছর তিনি নির্বাচিত হয়েছেন ফিফার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে।
শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এখনো পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন গানিম। বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করছেন এবং ভবিষ্যতে একজন কূটনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
গানিম আল মুফতাহর আরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি একজন একজন পরিচিত মুখ। ইনস্টাগ্রামে তার ৩ মিলিয়ন অনুসারী রয়েছে এবং টিকটকেও তিনি বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বকাপের মঞ্জে হাজির হওয়ার পর গানিমের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেছে, ইতোমধ্যেই সব গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তিনি। এমনকি কারো কারো ভাষ্যে, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সেরা অংশটিই ছিল মর্গান ফ্রিম্যান ও গানিমের কথপোকথন। ফুটবলের শ্রেষ্ঠ আসরের মঞ্চে তারা সকল জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা দিতে চেয়েছেন। ফুটবল বিশ্বকাপ যেভাবে সবাইকে এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছে, সেই ঐক্য যেন টিকে থাকে সেই বার্তাই দিয়েছেন তারা।
গানিম আল মুফতাহর জীবন শুরু হয়েছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। অনেকেই গানিমের মাকে বলেছিলেন গর্ভপাত করতে, কিন্তু গানিমের মা তা অগ্রাহ্য করেই তাকে জন্ম দেন। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, গানিম পনেরো বছরের বেশি বাঁচবেন না। কিন্তু নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণীকেও মিথ্যা প্রমাণ করেছেন গানিম। এই মুহূর্তে তিনি কাতারের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা, তার নিজের রয়েছে আইসক্রিমের ব্যবসা।
শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও থেমে নেই গানিম। এ অবস্থাতেই তিনি একাধিক খেলায় অংশ নেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিজের হাতে জুতো পরেই ফুটবল খেলতেন এবং তার 'স্বাভাবিক আকৃতির' বন্ধুদের সঙ্গেই বল নিয়ে ছুটতেন! হাতের সাহায্যে চলাফেরা করলেও গানিম আল মুফতাহ অনেক ধরনের কাজই করতে পারেন, এমনকি গাড়িও চালাতে পারেন তিনি! পাঠক জেনে অবাক হবেন যে, সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জেবেল শামস-এও উঠেছেন গানিম!
ছোটবেলায়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন গানিম, মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। এখন তিনি লাফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র।
কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মধ্য দিয়ে 'সকলের অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্যের' প্রত্যাশা করেন গানিম। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, "ফিফার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে আমার যেটুকু ক্ষমতা আছে, তার মধ্যে থেকেই আমি মানুষকে মানবতার জন্য অন্তর্ভুক্তি, আশা, শান্তি ও ঐক্যের বার্তা দিতে চাই।"
শারীরিক অক্ষমতা মানেই যে জীবনের শেষ নয় বা পুরোপুরি অক্ষম হয়ে যাওয়া নয়, তার আদর্শ উদাহরণ গানিম আল মুফতাহ। বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নেওয়ার মাধ্যমেই গানিম প্রমাণ করে দিয়েছেন যে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের জোরে মানুষের পক্ষে সব স্বপ্নই পুরণ করা সম্ভব। কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে আল-বাইত স্টেডিয়ামে বিশাল মঞ্চের মাঝে মর্গান ফ্রিম্যান ও গানিমের যে দৃশ্য দর্শক দেখলো, তা হয়তো তারা কখনোই ভুলতে পারবেন না। আর এভাবেই ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে থাকবেন গানিম আল মুফতাহ নামের এই অদম্য কাতারি তরুণ!
সূত্র: ডেইলি মেইল, স্পোর্টস ব্রিফ