আত্মবিশ্বাসী ক্রোয়েশিয়ার লক্ষ্য মেসির বিশ্বকাপ স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়া!
ব্রাজিল প্রাণ ভোমরা নেইমারের বিশ্বকাপ স্বপ্ন আগেই শেষ করে দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া; এখন তাদের লক্ষ্য আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। এ ব্যাপারে আশাবাদী ক্রোয়েট দল। তবে তারা আর্জেন্টাইন সুপার স্টারকে ম্যান-মার্ক করে থামানোর চেষ্টা করবে না, এর পরিবর্তে মঙ্গলবারের বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে তারা পুরো দলকে অচল করার দিকে মনোনিবেশ করবে বলে জানিয়েছেন দলের সদস্যরা।
রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রোয়েশিয়ার স্ট্রাইকার ব্রুনো পেতকোভিচ বলেন, 'মেসিকে থামানোর জন্য আমাদের এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই এবং সাধারণত আমরা একজন খেলোয়াড়কে থামানোর দিকে মনোনিবেশ করি না, আমরা পুরো দলকে থামাতে চাই। আমরা ম্যান-মার্কিং দিয়ে নয়, দল হিসেবে তাদের থামানোর চেষ্টা করব। আর্জেন্টিনা শুধু মেসিই নয়, তাদের বেশ কয়েকজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় রয়েছে। আমাদের পুরো আর্জেন্টিনা দলকে থামাতে হবে।'
২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল তথা ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে হেরে যাওয়ার পর ক্রোয়েশিয়া টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সাথে কোনও খেলোয়াড় কার্ড দেখার কারণে বাদ না পড়ায় এবং কোনও ইঞ্জুরি থেকে শঙ্কামুক্ত থাকায় পূর্ণ দল নিয়েই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ক্রোয়েশিয়া দল।
কোয়ার্টার ফাইনালে টুর্নামেন্ট ফেবারিট ব্রাজিলকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া অতিরিক্ত সময়ে এক গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পরেও। ম্যাচ শেষ হওয়ার মাত্র ৩ মিনিট আগে খেলাকে পেনাল্টি শ্যুটআউটে নিয়ে যেতে বাধ্য করে তারা, যেখানে ৪-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা।
খেলা শেষে ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকার নেইমার কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্রোয়েশিয়া এখন মেসির দলের সাথেও একই কাজ করার মিশনে নেমেছে, এবং মেসির হাতের ছোঁয়া না পাওয়া একমাত্র শিরোপা বিশ্বকাপ ট্রফি থেকে বঞ্চিত করতে বাধা দিতে প্রস্তুত তারা।
অধিনায়ক লুকা মদ্রিচ, মাতেও কোভাসিচ এবং মার্সেলো ব্রোজোভিচ নিয়ে তৈরি ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড খেলার গতি নির্ধারণে চাবিকাঠি হবে, যা তারা ব্রাজিলের বিপক্ষে প্রমাণ করে এসেছেন। ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার জোসিপ জুরানোভিচও এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন: 'মাতেও, লুকা এবং মার্সেলো ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ড। আমি মনে করি না এর পুনরাবৃত্তি হবে। আপনি যখন তাদের কাছে বল পাস করেন তখন এটি আপনার টাকা ব্যাঙ্কে রাখার চেয়েও নিরাপদ।'
'আমি মনে করি না আমাদের কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার আছে। আমাদের সেরা খেলাটি খেলার জন্য আমাদের নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। আমি বলব আমাদের সাফল্যের রহস্য হলো আমাদের ঐক্য, আমাদের একতাবোধ। আমরা একটি পরিবার হিসাবে কাজ করি এবং খেলি।' যোগ করেন জুরানোভিচ।
সাতবারের ব্যালন ডি'অর বিজয়ী মেসি এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনার মূল চালিকাশক্তি। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে পা রাখা পর্যন্ত মেসি পাঁচটি খেলায় চারটি গোল করেছেন, এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তিনি নিজের দেশকে বিশ্বকাপ জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
শেষবার মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ ছোঁয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন ২০১৪ সালে, যখন ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। আরও একবার বিশ্বকাপ শিরোপা তুলে ধরা থেকে তিনি মাত্র দুই ধাপ দূরে রয়েছেন, যার প্রথম ধাপ ক্রোয়েশিয়া।
হেরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মাঠে নামা, এমনকি যখন তারা ম্যাচে পিছিয়েও থাকে, সুশৃঙ্খল ক্রোয়েট দল এখন তাদের টানা দুইবার বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার সংকল্প নিয়ে প্রস্তুত। এবং তাদেরকে অবমূল্যায়ন করলে আর্জেন্টিনা ঝুঁকিতে পড়বে।
১৯৮৬ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনার দল নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের পর এখনো বিশ্বকাপ শিরোপা ছুঁতে না পারা আর্জেন্টিনা দলের শক্তি কিছুটা কমে এসেছে ডিফেন্ডার মার্কোস আকুনা আর গনজালো মন্তিয়েলের বুকিংয়ের কারণে সাসপেন্ড হওয়ায়। নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকোকে দিয়ে আকুনাকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হলেও আকুনার আক্রমণের ধার তার কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
আনহেল ডি মারিয়ার ফিটনেস নিয়েও সন্দেহ রয়েছে, ৩৪ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ইনজুরি থেকে সেরে উঠলেও তাকে মূলত বদলি খেলোয়াড় হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে এখনো পর্যন্ত।
অন্যদিকে, ৩৫ বছর বয়সী মেসি সম্ভবত তার শেষ বিশ্বকাপ খেলছেন এবং পুরো দেশের ভারও তার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটি বিশ্বকাপ শিরোপা ছাড়া মেসির সাথে ম্যারাডোনার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের খেতাবের তুলনা সম্পূর্ণ হয় না, যা প্রয়াত ম্যারাডোনা ৩৬ বছর আগে প্রায় একা জিতিয়েছিলেন।
ক্রোয়েশিয়া এবং আর্জেন্টিনার ম্যাচ প্রচণ্ড জমজমাট এবং টানটান উত্তেজনাময় হবে, যা পেনাল্টি শ্যুটআউট পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনাও আছে।
আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে প্রায় বাদই হয়ে যাচ্ছিলো ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরেও, খেলার শেষ মুহূর্তে পরপর দুই গোল হজম করে। মানসিকভাবে শক্ত ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি শ্যুটআউটের পুনরাবৃত্তি হওয়া আর্জেন্টিনাদের জন্য হুমকি হতে পারে, যদিও তাদের গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দুটি স্পট কিক বাঁচিয়ে সেমিফাইনালের টিকিট নেদারল্যান্ডসের হাত থেকে কেড়ে এনেছেন।
ফ্রান্সের কাছে হেরে যাওয়ার আগে ২০১৮ সালের ফাইনালে পৌঁছানোর জন্য ক্রোয়েশিয়া দুটি পেনাল্টি শ্যুটআউট জিতে এসেছিল। কাতারেও তাদের নকআউট পর্বের দুটি ম্যাচেই পেনাল্টি পর্যন্ত গড়িয়েছে, যেখানে জাপান এবং ব্রাজিল, দুই দলই তাদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে। এই নিখুঁত পেনাল্টি শ্যুটআউট রেকর্ডের জন্য তারা ইতিমধ্যেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কাছ থেকে অভিহিত হয়েছে "বিশ্বকাপের পেনাল্টি শ্যুটআউট রাজা" হিসেবে ।
এই পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আরেকটি শ্যুটআউট সম্ভবত তাদের ফাইনালে নিয়ে যাবে।
সূত্র: আল জাজিরা