বিশ্বকাপে মরক্কোর দুঃসাহসিক যাত্রায় যেভাবে ‘আন্ডারডগ’ শব্দের অর্থ বদলে গেছে!
স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবে করে দেখানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য, একথা জ্ঞানীজন মাত্রই মানবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে একথার যৌক্তিকতা মরক্কো ফুটবল দলের অধিনায়ক রোমান সাইসের চেয়ে ভালো আর কেউই বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করতে পারবেন না। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে তথাকথিত 'নিচের সারির দল' হিসেবে যাত্রা শুরু করে একের পর এক ফেভারিটদের হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে মরক্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৯২ বছরের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে অ্যাটলাস লায়নরা। তাদের এই স্বপ্নযাত্রাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এখন থেকে বিশ্বকাপে 'আন্ডারডগ' বলে কিছু নেই; বরং নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ীই দলগুলো শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলে রেখেছিলেন, "এই দলটিকে নিয়ে যেন কেউ খুব বেশি প্রত্যাশা না রাখেন।" সাবেক উলভস ডিফেন্দার এবং মরক্কান অধিনায়ক রোমান সাইস নিজেই বলেছিলেন, তাদের লক্ষ্য থাকবে নক-আউট পর্ব পর্যন্ত পৌঁছানো। অর্থাৎ, আফ্রিকান এই দলটির খেলোয়াড়েরাই পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারেননি যে তারা নক-আউট পর্ব পেরোবেন! অথচ সেই মরক্কো এখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, ৯০ মিনিটের ম্যাচে দুর্দান্ত ডিফেন্ডিং কৌশলে হারিয়ে দিয়েছে বিশ্বসেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে।
কিন্তু বাইরে প্রকাশ না করলেও, মনের ভেতরে কি বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নতা পুষে রাখেননি কোচ ওয়ালিদ বা অধিনায়ক সাইস? কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল বাধা পেরোনোর পর মরক্কান অধিনায়ক বলেন, "আমরা আরও ইতিহাস গড়ে যেতে চাই।" কিন্তু সেমিফাইনালে যে তাদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, সেকথা ভুলে গেলে চলবে না! গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের এবারের দলটির ভারসাম্য এবং পারফরমেন্স এতটাই চমৎকার যে তা যেকোনো প্রতিপক্ষের মনে ভীতি তৈরি করার মতো। এদিকে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আছে মরক্কোর খেলোয়াড়দের ইনজুরি। পর্তুগালের বিপক্ষে ম্যাচেই স্ট্রেচারে করে মাঠ ছেড়েছেন অধিনায়ক সাইস।
কিন্তু তবুও জয়ের আশা ছাড়ছেন না রোমান সাইস। তিনি বলেন, "আমি আশা করছি যে সবকিছু ভালোয় ভালোয় কাটবে। আমি জানি তাদের বিপক্ষে খেলা কতটা কঠিন হবে। আমি কোনো ঝুঁকি নেবো না এবং শুধুমাত্র সেমিফাইনালে খেলার জন্য পুরো দলের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবো না।"
তার মতো খেলোয়াড়দের এরকম নিঃস্বার্থপরতাই মরক্কোকে এতদূর নিয়ে এসেছে বলা যায়। হাকিম জিয়েচ এবং সুফিয়ান বুফলের মতো খেলোয়াড়, যারা কখনোই খুব ভালো পারফরমেন্সের জন্য খ্যাত ছিলেন না; তাদের কাছ থেকেও ডিফেন্সিভ খেলা বের করে এনেছেন কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই। তারা দুজনেই এখন অসাধারণ পাস, ফ্লিক দেওয়ার মতো আত্মবিশ্বাসী। মরক্কোর মতো আর কোনো দলই এত ব্যতিক্রমী রক্ষণাত্বক উপায়ে প্রতিপক্ষের চাপ ঠেকাতে পারেনি।
মরক্কান মিডফিল্ডার সুফিয়ান আম্রাবাত ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে মরক্কো তাদের লুকানো দক্ষতাগুলো একে একে প্রকাশ করতে পারছে। তিনি বলেন, "আমরা খুব ক্লান্ত, কিন্তু কোনো উপায় নেই। আমি খুব একটা সজীব-প্রাণবন্ত অবস্থায় ছিলাম না, কিন্তু এটা বিশ্বকাপ, এখানে আপনাকে পাগলের মতো দৌড়াতে হবে শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত।"
আর মাঠের খেলায়ও আম্রাবাত ঠিক সেটাই করেছেন। কোয়ার্টার ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অধিনায়ক ইনজুরির কারণে মাঠ ছেড়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত সময়ে লাল কার্ড দেখে ১০ দশ খেলোয়াড় নিয়ে পর্তুগালের সাথে লড়াই করে জেতাই প্রমাণ করে দেয় যে, মরক্কো এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং তারা বিশ্বকাপে স্রেফ 'অঘটন' ঘটাতে আসেনি। আফ্রিকার এ দলটি তাদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা সম্পর্কে এখন অনেকটাই নিশ্চিত। আম্রাবাতের কথায় যেন সেটিই ফুটে উঠেছে, "আমি এই মৌসুমে তিন-চার মাসে প্রায় ৩০টি ম্যাচ খেলেছি। এটা আমাদের জন্য খুব কঠিন, কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। আমাদেরকে নিজেদের সর্বোচ্চ খেলোয়াড়ি দক্ষতা বের করে এনে কাজে লাগাতে হবে।
সম্ভাবনার জায়গা থেকে কী কী হওয়া সম্ভব, সেই নীতি নতুন করে লিখেছে মরক্কো। ওয়াইদাদ এসির মতো একটি ক্যাসাব্লাংকা ক্লাবে খেলা একজন লেফট-ব্যাক বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কতখানি ভূমিকা রাখতে পারবেন তা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় ছিল। কিন্তু শনিবারে ম্যাচে ইয়াহিয়া আত্তিয়াত আল্লাহ দেখিয়ে দিয়েছেন যে নুসাইর মাজরাউই যদি ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সেরে না ওঠেন, তাহলে তিনি তার জায়গায় বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন। এদিকে রোমান সাইসের বদলি হিসেবে নামা আশরাফ দারিও মাঠে খেলেছেন নির্ভীকভাবেই।
মরক্কো দলে এই ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো খেলার মাঠে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে-কাতার বিশ্বকাপেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে ফুটবল মানেই এখন আর শুধু ইউরোপের দলগুলোর শক্তির প্রদর্শন নয়। গ্রুপ পর্বে প্রায়ই গণমাধ্যমকর্মীরা আফ্রিকার দলগুলোর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে প্রশ্ন করতেন, বিশেষ করে ঘানার কোচ অটো আড্ডোকে; তাদের প্রশ্ন ছিল এই যে- আফ্রিকার দলগুলোর নিজেদের ইমেজ পরিবর্তনের পথ কেন বার বার বিশ্বকাপে তাদের দুর্বল পারফরমেন্স দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ক্রোয়েশিয়ার সাথে মরক্কোর ড্রয়ের পর মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলেছিলেন, "তাদের যদি ১০টি আফ্রিকান দল থাকে, তাদের মধ্যে ৫টি হয়তো কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেত। আফ্রিকান দলগুলোর মনে রাখা উচিত যে আমরাও গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দলের মতোই।"
সেসময় মরক্কান কোচের কথার আরেকটি পয়েন্ট ছিল এই যে- আফ্রিকার দলগুলো 'তীরে এসে তরী ডুবায়'। কিন্তু এরকম আর চলতে দেওয়া যায় না। মরক্কোর গোলকিপার ইয়াসিন বোনো যে সেই প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন। তাইতো ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো তারকার দলকেও তিনি উপেক্ষা করেছেন এবং ম্যাচে শেষ হাসি হেসেছে মরক্কোই।
মরক্কোর এই জয়ের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের মিডফিল্ডার আম্রাবাত বলেন, "২২ জন খেলোয়াড়, কীভাবে আমরা ডিফেন্ড করি, এটাই আমাদের লড়াই করার স্পিরিট।" এবারের বিশ্বকাপে যা দেখা যাচ্ছে যে আফ্রিকান দলগুলোর ভাণ্ডারে রত্ন আছে ঠিকই, কিন্তু কীভাবে তা কাজে লাগানো হবে সেটাই দেখার বিষয়। এরপরেই আসে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি, তা হলো- তারা কি সত্যিই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারে?
'হ্যাঁ, কেন নয়?' সেকেন্ডের মধ্যেই জবাব দিলেন মরক্কোন মিডফিল্ডার আম্রাবাত। কারণ মরক্কো এখন আকাশের তারা ছোঁয়ার মতো অবস্থান তৈরি করেছে!
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান