ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১: বাসায় লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি আকাশে উড়ল
আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন, যে ১৯৭১-এ অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। তখন বয়স ছিল কম ছিল বলে মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট বোঝা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অনেক স্মৃতি এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। এত বড় একটি যুদ্ধ দেখেছি, ২৫ মার্চের কালরাত ও কারফিউ দেখেছি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনেছি এবং চোখের সামনে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যেতে দেখেছি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মনে রাখার মতো সেরকমই একটি উজ্জ্বল দিন, আমাদের বিজয় দিবস।
সেই সময় বুঝতে কম পারলেও, সময়ের সাথে সাথে জীবনের ওপর অনেক গভীর প্রভাব ফেলেছে এই সংগ্রাম। তাই তো কেউ যখন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে ফেলতে চায়, তখন মন বিদ্রোহ করে ওঠে। মানুষের জীবনে বড় ঘটনাগুলোর স্মৃতি বোধহয় এরকমই হয়, যা একজন শিশুও মনে রাখতে পারে।
আগস্ট ১৯৭১, আমার খালা পরিবার নিয়ে বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরিবারকে গ্রামে রেখে শহরে একা কাজ করতেন খালু। পিটু ভাই পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে, ১৫ বছরের কিশোর। গ্রামে ঘুরেফিরে দিন কাটছে তার। হঠাৎ একদিন খবর পেলেন, পাশের গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য একটি ৫/৬ বছরের বাচ্চাকে হাত দিয়ে টেনে কয়েক টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেছে। শিশুটির অপরাধ, তার বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এছাড়া তারা গ্রামে আগুন দিয়েছে, নারীদের অসম্মান করেছে।
একথা শুনে সেদিনই পিটু ভাইরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর অপেক্ষা নয়। হাতে অস্ত্র তুলে নিতেই হবে। ব্যস, সেই রাতেই গ্রামের কয়েকজন ছেলে ভারতে চলে গেলেন, কাউকে না জানিয়ে। খালু গ্রামে ফিরে শুনলেন ছেলে যুদ্ধে গেছে। অপেক্ষা করলেন ছেলের জন্য, কিন্তু দেখা হলো না। পিটু ভাই যুদ্ধ শেষে যখন ফিরলেন, তখন বাবাকে আর পেলেন না। এরকম ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হয়ে অনেক ছেলেমেয়ে পরিবার ছেড়ে যুদ্ধে গেছেন। কেউ ফিরেছেন, কেউ ফেরেননি।
যাক, মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আমরা এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। চারিদিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে ঢাকা শহর ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠছিল। সবাই বুঝতে পারছিল এভাবে বাসায় থাকাটা নিরাপদ হবে না, যৌথ বাহিনীর এয়ার অ্যাটাক শুরু হয়েছে। সেন্ট্রাল রোডের মোড়ে আমার ফুপুর বাসার উঠানে ট্রেঞ্চ (পরিখা) কাটা হয়েছিল, এয়ার অ্যাটাক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। সেখানে দ্রুত গিয়ে সবাই ট্রেঞ্চে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।
সেই প্রথম ট্রেঞ্চের অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছিল যেন আমাদের মাথার উপরে বোমা পড়ছে, সাথে কানফাটানো শব্দ, মাথার উপর দিয়ে প্লেনের উড়াউড়ি। আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল, যদিও সবাই কানে তুলা গুঁজে নিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম ভারতীয় বিমানগুলো হামলা চালিয়েছে। তারা রকেট আর কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছিল গভর্নর হাউসের ওপর।
১৬ ডিসেম্বর সকালে আব্বার কাছে শুনলাম ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ওই দিনই সারেন্ডার করতে বলেছে। শহরের চারিদিকে সেদিন সকাল থেকে খন্ড খন্ড ঝামেলা চলছিল। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। আব্বা অফিসে চলে গেল এবং বারবার বলে গেল আমরা যেন বাইরে না বের হই। দুপুরের পর আব্বা ফিরে এসে বলল, দেশ মনে হয় স্বাধীন হয়েই গেছে। কারণ ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা শহরে ঢুকছেন, পথে পথে মানুষের ভিড় আর আনন্দ-উল্লাস। এখন শুধু অপেক্ষা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের।
এমন পরিবেশের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন যৌথ বাহিনীর প্রধান অরোরা ও পরাজিত বাহিনীর প্রধান নিয়াজি। 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা' গ্রন্থে জে এফ আর জেকব আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে লিখছেন, 'গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা ও নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপরে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন। ...ঘড়ির দিকে চোখ (ভারতীয় সময়) ফেলে দেখি, সময় বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিট। এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে অ্যাপলেট (সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়াডসহ (ছোট দড়িবিশেষ) পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার অরোরার হাতে ন্যস্ত করেন। তার চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজিবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালিগালাজ দিতে থাকে।' (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)
রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ হবে, এই কথা শোনার পরপরই মানুষ স্রোতের মতো ঘর থেকে বের হয়ে ময়দানের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা বিপুল করতালি ও মুহুর্মুহু জয় বাংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এরপরই শহরের আপামর মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে মিছিল বের করলেন। আকাশে ফাঁকা ফায়ার করতে করতে স্লোগান দিতে লাগলেন 'জয় বাংলা'। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে ঢাকা হয়ে উঠেছিল উৎসবের নগরী। প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী পথে নেমে এসেছিলেন।
বিকেলের দিকে বাসার বড়দের সাথে গ্রীনরোডের মাথায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা জীপে ও ট্রাকে করে হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছেন আর তাদের দিকে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অগণিত মানুষ। বড়রা কাঁদছেন, কেউ বা হাসছেন, বাচ্চারা পতাকা হাতে লাফালাফি করছে, যোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন অনেকেই। সবার হাতেই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের বাসার লুকিয়ে রাখা ছোট পতাকাটি ট্রাংক থেকে বের করে আম্মা আমার হাতে দিয়েছিল।
আম্মাকে দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে। আম্মা কাঁদছে দেখে আমিও কেঁদেছিলাম, জানি না ঠিক কেন কেঁদেছিলাম। পরে বুঝেছি আম্মার ওই কান্নাটি ছিল আনন্দের। আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, এত মানুষ কোথা থেকে এল ঢাকায়? আমি তো এতদিন দেখেছি আমার পাড়া খালি হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার সব পরিবার, আমার বন্ধুরা, ফেরিওয়ালা, ভাল্লুকের খেলা দেখানো লোকটা, বেবি আইসক্রীমওয়ালাসহ সব মানুষ দল বেঁধে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। তখন আমার বয়সটাই ছিল এমন, যখন প্রশ্ন ছিল অনেক কিন্তু উত্তর মিলত কম।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই স্মরণ করতে পারি। যেমন, নভেম্বর মাসের কোনো এক সময়ে আমার ফুপাতো ভাই মুন সন্ধ্যায় রংপুর থেকে ঢাকা এসেছেন। শুনলাম দু-একদিন থেকেই চলে যাবেন। রাতে মুন ভাই তার ব্যাগটা খুলে আব্বাকে কী যেন দেখালেন। দুজনে ফিসফিস করে কথাও বলছিলেন। আমার উৎসাহও ছিল গলা পর্যন্ত। এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলাম, ব্যাগটার ভেতর অনেক অস্ত্র। ভয় পেলাম, আবার অবাকও হলাম আমাদের বাসায় এত অস্ত্র দেখে। আব্বা আমাকে দেখে ফেলল এবং পইপই করে বারণ করে দিল, এই কথাটা যেন আমি কাউকে না জানাই। আমিও মাথা নেড়ে চলে এলাম।
পরদিন সকাল ১১-১২ টার দিকে পাড়ার কিছু ভদ্রলাক আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী, হুদা ভাই শুনলাম আপনার বাসায় অস্ত্র আছে? আপনার বোনের ছেলে নাকি ওগুলো নিয়ে এসেছে?' আব্বা তো মুহূর্তেই টের পেল, খবর রটানোর এই কাজটি কার। সেদিন সন্ধ্যায় কাউকে কিছু না জানিয়ে মুন ভাই তার ব্যাগটি নিয়ে হঠাৎই গায়েব হয়ে গেলেন। উত্তেজনার বশে কী ভয়াবহ একটি তথ্য আমি একান-ওকান করেছি। মুন ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রের চালান নিয়ে এসেছিলেন। আব্বা তার হাতে এর-ওর কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে দিতো। এরকম অনেক ঘটনার কথা আমার স্পষ্ট অথবা টুকরা টুকরা মনে আছে ।
যাক, বিজয় দিবসের পরেরদিন, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১—আমি আব্বা, আম্মা, পাড়ার আরও অনেকের সাথে দলবেঁধে বের হলাম এয়ারপোর্ট দেখব বলে। সবাই বলাবলি করছিল আমাদের বিমানবন্দরটি নাকি পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখনও ভাবতে পারি না, আমি, অতটুকু একটি মেয়ে কেমন করে বাসা থেকে পায়ে হেঁটে ফার্মগেট হয়ে বিমানবন্দর দেখতে গিয়েছিলাম?
সারাটা পথে কাচের টুকরা, ছড়ানো-ছিটানো গোলাবারুদ, ভাঙা গাড়ি, পোড়া ও ভাঙা বাড়িঘর দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও, আমাদের পুরানো বিমানবন্দরের ধ্বংসস্তূপ দেখতে। একটি বিধ্বস্ত জনপদ দিয়ে আমরা পথ হেঁটেছি, পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম বিমানবিধ্বংসী গোলার খালি খোলসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী স্মৃতি ও গভীর ভালবাসা আজও বহন করে চলেছি মনের ভেতরে। আমি বিশ্বাস করি মুক্তিযুদ্ধ আমার পরিচয়।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক