বিশ্বকাপের মঞ্চে ফ্রান্স বনাম মরক্কো, ২ দেশের ১১০ বছরের ইতিহাস
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে একসময় ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা মরক্কো। সবকিছুর প্রথম বলে একটা কথা আছে! শত বছরের ইতিহাস থাকলেও বৈশ্বিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় এই প্রথমবার মুখোমুখি হবে দেশ দুটি। অতীতে কেবল প্রীতি ম্যাচ এবং প্রদর্শনী ম্যাচের জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল দু'দলকে।
কাতারের আল বায়াত স্টেডিয়ামে এই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ সময় আজ রাত একটা শুরু হবে এমবাপ্পে-হাকিমিদের লড়াই। দল দুটির মধ্যে লড়াইয়ের ইতিহাস না থাকলেও, দেশ দুটির রয়েছে এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস। বর্তমানও সেই জটিলতার সাথে একই সূত্রে গাঁথা। খবর আল জাজিরা'র।
ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড ইকনমিকস স্টাডিজ-এর হিসাবমতে, বর্তমানে ফ্রান্সে মরোক্কান বংশোদ্ভূত অধিবাসীর সংখ্যা সাত লাখ ৮০ হাজার। এ সংখ্যাই বলে দেয়, দুই দেশবাসীর মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ভিসা বিরোধের ফলে এ যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে।
মূলত ভিসা সংক্রান্ত নানা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করায় এমন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। ভিসা প্রক্রিয়াকে জটিল করা এসব নিয়ম জারি করেছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার। আজকের ম্যাচ দেখতে কাতারে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে থাকতে পারেন তিনি।
আফ্রিকান দেশ মরক্কোর জন্য এটিই প্রথম বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। কাজেই ম্যাচ জিতে নিজেদেরই রেকর্ড ভাঙার সুযোগ রয়েছে তাদের। তবে এতেও যদি অনুপ্রেরণা না আসে, মরক্কোর খেলোয়াড়দের এক শতাব্দী পুরোনো ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই হবে।
মরক্কোতে ফরাসি উপনিবেশ
১৯১২ সালে মরক্কোর সুলতান আবদুল হাফিজের সঙ্গে ফেজ চুক্তি (ট্রিটি অব ফেজ) স্বাক্ষর করে ফ্রান্স। এ চুক্তির মধ্য দিয়েই মরক্কোকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ফরাসি 'আশ্রিত ভূখণ্ড' বানানো হয়। এর পরের বছরগুলোতে ফ্রাস সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে বসে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৪০ হাজার মরোক্কান নাগরিককে জোরপূর্বক ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছিল ফ্রান্স। এটিসহ আরও নানা কারণে মরক্কোতে উপনিবেশবিরোধী চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ আরও শক্ত ভিত পেয়ে যায়। এসময় ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো একে একে স্বাধীনতা অর্জন করছিল।
তারই মধ্যে একটি ছিল মরক্কো। ১৯৪৪ সালে তৎকালীন নবগঠিত ইস্তিকলাল পার্টি মরক্কোর স্বাধীনতার ঘোষণা জারি করে।
এরপর ১৯৫২ সালে কাসাব্লাঙ্কাতে এক উপনিবেশবিরোধী বিদ্রোহ সংঘটিত হয় যেটি দমন করতে ফরাসি কর্তৃপক্ষ সহিংস পন্থা অবলম্বন করে। একসময় তৎকালীন ফরাসি কর্তৃপক্ষ মরক্কোর কমিউনিস্ট ও ইস্তিকলাল পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং সুলতান মোহাম্মদ পঞ্চমকে মাদাগাস্কারে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
ফরাসি উপনিবেশকারীদের এমন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত সুলতানকে দেশে ফেরার অনুমতি দিতে বাধ্য হয় ফ্রান্স।
১৯৫৫ সালের ১৮ নভেম্বর সুলতান মোহাম্মদ মরক্কোর স্বাধীনতার ঘোষণা করেন; এবং এর পরের বছরের মার্চ মাসে ফরাসি প্রদত্ত 'আশ্রিত ভূখণ্ডের' তকমা বাতিল করেন।
ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্তি
স্বাধীনতার পর উপনিবেশবাদী ফরাসি প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরক্কো একাধিক অভ্যন্তরীণ নীতি বাস্তবায়ন করে। একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে ফ্রান্সের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতি বেছে নেয় দেশটি।
১৯৭৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় হাসান একাধিক অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক আইন প্রণয়ন করেন। বেসরকারি খাতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে এই নতুন আইনের আওতায় দেশটিতে থাকা অর্ধেকের বেশি বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানকে মরক্কোর মালিকানায় নেওয়া হয়, যার মধ্যে আগে বেশিরভাগই ছিল ফরাসি মালিকানাধীন।
৮০'র দশকে সুলতান দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় 'আরবায়ন নীতি' প্রয়োগ করেন। এর অধীনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা ফরাসি থেকে আরবিতে পরিবর্তন করা হয়। তবে ৩০ বছর পর, এ নীতি কিছুটা সংশোধন করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষায় গণিত, বিজ্ঞান এবং পদার্থবিদ্যা শিক্ষাদান পুনরায় চালু করা হয়।
উপনিবেশের তিক্ত ইতিহাস সত্ত্বেও, ফ্রান্স মরক্কোর প্রাথমিক বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে রয়ে যায়। ফলে উভয় দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
এর অংশ হিসেবে দু'দেশের মধ্যে বহুবার কূটনৈতিক সাক্ষাৎও হয়েছে। ২০০৭ সালে মরক্কোর দ্রুত-গতির ট্রেন পরিষেবা ঘিরে আল বোরাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখতে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি মরক্কো সফর করেন। এই ট্রেন পরিষেবা প্রকল্পে ফ্রান্সের অর্থায়ন ছিল ৫১ শতাংশ।
এর দুই মাস পর দুই দেশের জাতীয় দলের একটি প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে ২-২ গোলে ড্র হয়।
ফ্রান্স-মরক্কোর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এতটাও সরল নয়। ২০১৪ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে শুরু করে। সেবছর প্যারিস কর্তৃপক্ষ ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়নের অভিযোগে মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আবদেললতিফ হামৌচিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করে। এর ফলে মরক্কো ফ্রান্সের সঙ্গে বিচারিক সহযোগিতা স্থগিত করে। এই কূটনৈতিক উত্তেজনা কিছুটা নিরসন হয় এক বছর পর এবং দেশ দুটি পুনরায় সহযোগিতায় ফিরে।
২০১৮ সালে রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ মরক্কোর টাঙ্গিয়ার এবং রাজধানী রাবাতের মধ্যে দ্রুতগতির রেলওয়ে সংযোগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
জটিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
নানা টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে দেশ দুটির সম্পর্ক। পশ্চিম সাহারায় দীর্ঘদিন ধরে পলিসারিও ফ্রন্টের নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী মরক্কোর কাছ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে অঞ্চলটিকে মরক্কো নিজের অংশ বলে যে দাবি করলে সেটির প্রতি সমর্থন জানান ম্যাক্রোঁ।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশটির স্বায়ত্তশাসনের এই পরিকল্পনায় সমর্থন দেন ম্যাক্রোঁ। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-এর অধীনেও এ সমর্থন বলবৎ আছে।
তবে দুই দেশের মাঝে ছোটখাটো নানা বিরোধ রয়েই যায়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের হার ৫০ শতাংশ এবং তিউনিশিয়ার নাগরিকদের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা হবে।
উত্তর আফ্রিকার এই তিন দেশের সরকার ফ্রান্সে আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করায় এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় ফরাসি সরকার।
মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের বৌরিতা এই পদক্ষেপকে 'অযৌক্তিক' বলে উল্লেখ করেন।
বৌরিতা বলেন, তিনি ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত মরোক্কানদের ৪০০টি কনস্যুলার নথি প্রকাশ করেছিলেন। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে পুনরায় প্রবেশের জন্য বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাদের ফেরত নেওয়া হয়নি। এটাকে 'ফ্রান্সের সমস্যা' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এত ডামডোলের পরও এটা পরিষ্কার যে, উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব স্বীকার করে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে রাবাত সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে ম্যাক্রোঁর। কিন্তু তার আগেই দুই দেশের ফুটবল দল একটি ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে আজ। ইতিহাস যদি পথপ্রদর্শক হয়, তাহলে বলা বাহুল্য, উভয় দলের জন্য এই খেলা সহজ হবে না।