কাতার বিশ্বকাপ জিতলেই মেসি, ম্যারাডোনা ও পেলের সঙ্গে 'সর্বকালের সেরা'র তর্কে নাম লেখাবেন এমবাপ্পে!
বয়স মাত্র ২৩ বছর। এরই মধ্যে টক্কর দিচ্ছেন লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো তারকাদের সঙ্গে। এমনকি ইতোমধ্যেই একটি বিশ্বকাপ জেতাও হয়ে গেছে ফ্রান্স জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপ্পের। আর রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারাতে পারলে টানা দুইবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পাবে ফ্রান্স এবং একই সাথে সর্বকালের সেরাদের লড়াইয়ে শামিল হবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে!
বিখ্যাত আমেরিকান বক্সার মাইক টাইসন যেমনটা বলেছিলেন- "মুখে ঘুষি খাওয়ার আগপর্যন্ত সবারই কোনো না কোনো পরিকল্পনা থাকে।" এমবাপ্পের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই; অন্তত প্রতিপক্ষ দলের যেসব ফুটবলাররা তার মুখোমুখি হয়েছেন তাদের এমনটাই ভাষ্য। কারণ এমবাপ্পের দুর্দান্ত গতির সামনে টিকে থাকা যাবে কিনা তা তার সামনে না পড়া পর্যন্ত সঠিকভাবে বোঝার উপায়ই নেই!
"আমি টিভিতে তাকে দেখেছি, তার কথা শুনেছি। কিন্তু তাকে দেখা আর মাঠে তাকে মোকাবিলা করার মধ্যে বিশাল পার্থক্য। মাঠে নামলেই সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সে যেন এক বিশেষ স্থলচর!", বলছিলেন পোলিশ মিডফিল্ডার পিটর জেলিনস্কি। কাতার বিশ্বকাপের নক-আউট পর্বে তার দলকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে ফ্রান্স, যার মধ্যে দুটি গোল ছিল কিলিয়ান এমবাপ্পের।
এমবাপ্পেকে থামানোর পরিকল্পনা করতে বাদ রাখেননি পোলিশ ডিফেন্ডার ম্যাটি ক্যাশও। তরুণ ফরাসি তারকাকে বাধা দেওয়ার সব রকম হোমওয়ার্ক করে এসেও কাজ হয়নি।
"আমি ম্যাচের আগে পুরো বিকালটা কাটিয়েছি এমবাপ্পের খেলার ভিডিও দেখে এবং আমি জানতাম তাকে বাধা দেওয়ার পরীক্ষাটা বেশ কঠিন হবে। তার পায়ে যখন বল যায়, বল থামায় এবং আবার বল নিয়ে দৌড়ায়, আমার দেখা সবচেয়ে দ্রুতগতির ফুটবলার সে। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার ভিডিও দেখছি, অথচ মাঠের খেলায় সে আমার পায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে প্রায়! এটাই পার্থক্য", বলেন ম্যাটি ক্যাশ।
তাই নক-আউট পর্বে ফ্রান্সের কাছে হেরে যাওয়ার পরেও যে ম্যাটি ক্যাশ এমবাপ্পের জার্সি সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। সেই জার্সি নিয়ে তিনি রেখেছেন হোটেল রুমে লিওনেল মেসির জার্সির পাশে, যেটি গ্রুপ পর্বের ম্যাচেই মেসির কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
ম্যাটি ক্যাশ যেসব তারকাদের জার্সি সংগ্রহ করছেন এবং কেন সেগুলো তার কাছে মূল্যবান তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। তিনি বরঙ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে পারেন যে একই বিশ্বকাপে তিনি ফুটবলের দুই মহানায়কের বিপক্ষে খেলেছেন। কারণ এ ধরনের সুযোগ বারবার আসে না।
কেন মেসি ও এমবাপ্পের নাম পাশাপাশি রেখে বলা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক পাঠকের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছর বয়সে কিলিয়ান এমবাপ্পে যা কিছু অর্জন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন তা অগ্রাহ্য করার সুযোগ কিন্তু নেই। আর রবিবার বিশ্বকাপের মহারণে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়াবেন দুজনে, যদিও দুজনেই খেলেন একই ক্লাব পিএসজিতে।
বক্সার মাইক টাইসন কখনো হেভিওয়েট শিরোপার লড়াইয়ে মোহাম্মদ আলীর মুখোমুখি হননি। লেব্রন জেমস কখনো এনবিএ ফাইনালে মাইকেল জর্ডানের মুখোমুখি হননি। কিন্তু ফুটবলে হিসাবটা আলাদা; এবার বিশ্বকাপের ফাইনালে লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পেকে মুখোমুখি হতেই হবে। আর সে কারণেই এটি ফুটবলের একটি ঐতিহাসিক ম্যাচ হয়ে থাকবে।
আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসিকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, টুর্নামেন্টে এরই মধ্যে নিজেকে সেরা প্রমাণ করে ফেলেছেন তিনি। আরও অনেক বছর ধরেই তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তকমা দিয়ে দিয়েছেন বহু ফুটবলবোদ্ধা। কিন্তু বয়সের হিসেবে এমবাপ্পে কোনো অংশেই কম যান না। এমবাপ্পের ঝুলিতে রয়েছে বিশ্বকাপ জয়ের অর্জন যা মেসি এখনও পাননি।
মাত্র ২৩ বছর বয়সেই যদি এমবাপ্পে আবারও একটি বিশ্বকাপ জেতেন তাহলে তা তৈরি করবে অনেক নতুন রেকর্ড। হ্যাঁ, এখানে কিংবদন্তী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার পেলের রেকর্ডের কথাই বলা হচ্ছে! ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে এমবাপ্পের বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর, তখনই তিনি পেলের পর একমাত্র টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেছিলেন। ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারানোর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এমবাপ্পের উদ্দেশ্যে পেলে লিখেছিলেন, "ওয়েলকাম টু দ্য ক্লাব'।
এদিকে কাতারে এমবাপ্পের মোট বিশ্বকাপ গোলসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯-এ। এত অল্প বয়সে বিশ্বকাপে নয় গোল আর কেউই করতে পারেননি। এমবাপ্পে যদি ফিট থাকেন তাহলে মিরোস্লাভ ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ড ভাঙতে তার খুব বেশি সময় লাগবে না। অন্তত আরও দুটি বিশ্বকাপ তো খেলতেই পারবেন এই পিএসজি ফরোয়ার্ড। ২০৩০ সালে এমবাপ্পের বয়স হবে মাত্র ৩১ বছর, তাই ২৩ বছর বয়সী এমবাপ্পের অর্জন যে কারো ঈর্ষান্বিত হওয়ার মতো।
ইতোমধ্যেই এমবাপ্পের বিশ্বকাপ গোল সংখ্যা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর (৮) চেয়ে বেশি এবং মেসির (১১) চেয়ে দুটি কম। তবে এমবাপ্পে কখনো কখনো তার অহং বোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননা বলে নিজের ক্যারিয়ারে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নাও নিতে পারেন বলে অনেকের আশঙ্কা।
ব্রাজিলিয়ান তারকা দানি আলভেজ তো বলেই ফেলেছেন, তার সাবেক পিএসজি সতীর্থ(এমবাপ্পে) নাকি এখনও জানেন দলীয় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার মানে কি। গ্যাজেত্তা দেল্লো স্পোর্টকে দানি বলেছিলেন, "এমবাপ্পে এমন একজন বড় খেলোয়াড় যে কিনা এখনো বুঝতে পারেনি যে তার সঙ্গে যারা আক্রমণভাগে খেলে তারা তার চাইতেও বড় খেলোয়াড়। একজন গ্রেট ফুটবলারকে অবশ্যই তার সতীর্থদের সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে হবে, কারণ সতীর্থরাই আপনার যোগ্যতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।"
তবে ফ্রান্স জাতীয় দলের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে এমবাপ্পেই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় তারকা। সেই সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপে বেশ ভালো ফর্মে রয়েছে অলিভিয়ের জিরু, যিনি আক্রমণভাগে এমবাপ্পের পারফেক্ট সঙ্গী হয়েছেন। অন্যদিকে, আতোঁয়া গ্রিজমানও ফরোয়ার্ড হিসেবে খুব একটা ডিফেন্সিভ মার্কিং এর শিকার হচ্ছেন না। আবার, ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশমও কখনোই স্বীকার করতে চান না যে এমবাপ্পে স্বার্থপর খেলোয়াড়।
কাতার বিশ্বকাপেই গণমাধ্যমে প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে দেশম বলেছিলেন, "এমবাপ্পের ফিটনেস তো ঠিকঠাকই আছে, তাই আমাদের সেই দিকটা দেখার প্রয়োজন নেই। তাহলে কি আপনি বলছেন যে ওর ইগোকে (অহং বোধ) আমার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে? আর আপনারা সে সম্পর্কে কিইবা জানেন? আমি জানি, আপনি না। কিলিয়ানের মধ্যে বড় ধরনের কোনো অহংকারবোধ নেই। সে আমাদের দলের একজন প্রধান খেলোয়াড়, কিন্তু তবুও সে দলীয় খেলোয়াড়। অবশ্যই সে একজন তারকা, কিন্তু এখন আর তার বয়স ১৮ বছর না। এখন সে আগের চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ।"
আর দেশমের মূল তুরুপের তাস, এমবাপ্পের মনোযোগ যে শুধুই বিশ্বকাপ জয়ের দিকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এমবাপ্পে নিজেই এই টুর্নামেন্ট চলার সময় স্বীকার করেছেন যে বিশ্বকাপ জেতা তার কাছে 'নেশা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশ্বকাপের জন্যই পুরো মৌসুম তিনি নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন।
এমনকি গ্রুপ পর্বে ম্যাচ শেষে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি, যাতে করে বাইরের কারো কথায় তিনি মনোযোগ না হারিয়ে ফেলেন।
"এটা গণমাধ্যমের বা মানুষের বিরুদ্ধে কিছুই না। আমি শুধু এই প্রতিযোগিতার দিকে শতভাগ মনোযোগ রাখতে চেয়েছিলাম। অন্য কোনোকিছুতে শক্তি অপচয় করতে চাইনি।" এমবাপ্পের এমন কথাবার্তায় যে যাই মনে করুক না কেন, আখেরে তা তার নিজের এবং ফ্রান্সের উপকারেই এসেছে।
ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম যে তার দলের এই রত্নটিকে নিয়ে দারুণ খুশি সেটিও তার কথায়ই প্রমাণিত। তিনি বলেছেন, "আমি জানতাম কিলিয়ান এবারের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত হয়েই আসবে। এটা তার প্রতিযোগিতা।"
গ্রুপ পর্ব থেকে এখন পর্যন্ত দেশমের কথার সত্যতা মাঠেই প্রমাণ করেছেন এমবাপ্পে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, আর্জেন্টিনা দল থেকে লিওনেল মেসিই এমবাপ্পের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবেন।
তবে আপাতত বিশ্বকাপের মঞ্চ দুই বিখ্যাত তারকার দ্বৈরথের জন্য প্রস্তুত। আর আগামীকাল কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ট্রফির পাশাপাশি গোল্ডেন বুট এবং গোল্ডেন বলের দাবিদার কে, সেটিও নিশ্চিত হয়ে যাবে।
আগামীকাল আর্জেন্টিনা জিতলে মেসির জন্য 'সর্বকালের সেরা'র বিতর্কের অবসান ঘটবে। আর যদি ফ্রান্স জিতে, তাহলে এই বিতর্কে একজন দাবিদার হিসেবে নাম লেখাবেন ২৩ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে।
সূত্র: গোল