মেসি-আন্তোনেলার রূপকথা: শৈশবের প্রেম থেকে গর্বিত মা-বাবা ও বিশ্বকাপ জয়ের সাক্ষী!
"সত্যিটা হলো আমি আন্তোনেলার সবকিছুই পছন্দ করি। ওর মধ্যে অনেক গুণাবলি আছে; ওর ব্যক্তিত্ব, দৈনন্দিন জীবনে ওর কাজকর্ম, সবসময়ই সুন্দর মনমানসিকতার অধিকারী, সমস্যা সমাধানের চমৎকার ক্ষমতা... এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওর বুদ্ধিমত্তা..", ২০১৯ সালে স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক মার্কার একটি সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি। গতকাল রোববার (১৮ ডিসেম্বর) এই ক্ষুদে জাদুকর বিশ্বকাপ জিতেছেন এবং নিজেকে প্রমাণ করেছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে। আর মেসির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় এই দিনটিতেও তার পাশে ছিলেন তার স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জো।
আন্তোনেলা রোকুজ্জো শুধুই মেসির স্ত্রী বা তার সন্তানদের মা নন, তিনি লিওনেল আন্দ্রেস মেসির শৈশব থেকে কিংবদন্তি ফুটবলার হয়ে ওঠার সাক্ষী। তিনি মেসির হাজারো অর্জনের, সুখ-দু;খের মুহূর্তের সাক্ষী এবং মেসির তিন সন্তানের গর্বিত মা তো বটেই! বর্তমান যুগে একজন বিশ্বখ্যাত তারকা হয়েও মেসি শুধুমাত্র আন্তোনেলাতেই আসক্ত। ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মেসিকে বলা যায় পুরোদস্তুর 'ফ্যামিলি ম্যান', ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেসি ও আন্তোনেলা।
মাত্র ৫ বছর বয়সে আন্তোনেলার সাথে প্রথম পরিচয় মেসির, দুজনেই ছিলেন আর্জেন্টিনার রোজারিওর বাসিন্দা। ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনার উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়তে হয়েছিল লিওনেল মেসিকে, কিন্তু তবুও আন্তোনেলার হাত ছাড়েননি। ২০০৫ সালে মেসি জানতে পারেন যে আন্তোনেলার প্রিয় বন্ধু গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বার্সেলোনা থেকে আর্জেন্টিনায় উড়ে যান তিনি তাকে সান্ত্বনা দিতে। এরপর থেকে আন্তোনেলার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয় মেসির।
২০০৯ সালের দিকে দুজনের সম্পর্কের খবর চাউর হয় গণমাধ্যমে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে খেলেন তরুণ মেসি, সেসময়ই আন্তোনেলাকে প্রস্তাব দেন এবং তার শৈশবের প্রেমিকাও সানন্দে রাজি হয়ে যান। মেসি তখন তারকা হওয়ার পথে, তখনও দুজনে জানতেন না একদিন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে উচ্চারিত হবে রোজারিওর সেই ছোট্ট মেসির নাম!
২০১২ সালে জন্ম নেয় মেসি-আন্তোনেলার প্রথম সন্তান থিয়াগো। ২০১৫ সালে জন্ম হয় দ্বিতীয় ছেলে মাতেও। ২০১৭ সালে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে বিয়ে করেন এই জুটি। মেসি তখন বিশ্বসেরা, দুনিয়াজুড়ে কোটি কোটি ভক্ত তার। তাদের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন পিকে, আগুয়েরোসহ, আলভেজসহ বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা সব ফুটবলাররা। ২০১৮ সালে এই জুটির তৃতীয় ছেলে সিরো জন্মগ্রহণ করে।
বার্সেলোনায় কৈশোর ও যৌবন কাটিয়ে, এত ধনী হয়েও কেন রোজারিওকে বিয়ের ভেন্যু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মেসি? মেসির সাবেক কোচ এনরিকে ডমিংগেজ সেসময় সিএনএনকে বলেছিলেন, "মেসি এই রোজারিওতে এসেছে বিয়ে করতে যাতে করে তার বার্সেলোনার বন্ধুরা তার শহরকে দেখতে পারে, জানতে পারে যে এখানেই বড় হয়েছিল মেসি... লিও আসলে এরকমই। ওর মনটা ভালোবাসা, স্মৃতি ও কৃতজ্ঞতায় ভরা। ও চাইলে বিশ্বের সেরা কোনো জায়গায় বিয়ে করতে পারতো, কিন্তু তা করেনি।"
বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবলসহ অসংখ্যা শিরোপা জেতার সৌভাগ্য হয়েছে মেসির। প্রতিটি ইভেন্টেই তার পাশে থেকে সমর্থন দিয়েছেন আন্তোনেলা। ২০১৯ সালে মার্কাকে মেসি বলেছিলেন, "আপনার যত বয়স হবে ততই শিখতে থাকবেন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা হবে, মাঠের ভেতরে ও বাইরেও। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে আমার এই তিন সন্তান আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে, আমার চিন্তাভাবনার ধরনকে বদলে দিয়েছে।"
মেসি আরও বলেছিলেন, " যদিও আমি বাসায় আন্তোনেলা ও ছেলেদের খুব বেশি সময় দিতে পারি না, কিন্তু আমি তাদের সঙ্গে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি; সেটা টিভি দেখা হোক বা খেলাধুলা করা হোক। আমরা ঘরে থেকে এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে ভালোবাসি।
বার্সেলোনার মেসি 'আর্জেন্টিনার মেসি' হয়ে উঠতে পারেননি, এই অপবাদের বোঝা বহু বছর বয়ে বেড়াতে হয়েছে মেসিকে। জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি জিততে না পারায় দেশের মানুষের অবজ্ঞার পাত্র হয়েছেন। কিন্তু তবুও হাল ছাড়েননি মেসি, স্বপ্ন দেখেছেন সবসময়; আর এই পুরো সময়টা তার পাশে ছিলেন আন্তোনেলা।
গত বছর কোপা আমেরিকা ও ফাইনালিসিমা জিতে অপবাদ ঘুচিয়েছেন মেসি। আর কাতার বিশ্বকাপে মেসি ম্যাজিকই ছিল টুর্নামেন্টের মূল আলোচনার বিষয়। গতকাল নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন মেসি। জিতেছেন বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বল, ৫টি ম্যাচসেরার পুরস্কার। আর এই কাতার বিশ্বকাপেও প্রতিটি ম্যাচে সন্তানদের নিয়ে স্টেডিয়ামে ছিলেন আন্তোনেলা।
রবিবার বিশ্বকাপ জয়ের পর ইনস্টাগ্রামে স্বামীকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন আন্তোনেলা রোকুজ্জো। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা এই পোস্টে আন্তোনেলা বলেন, "আমি ঠিক জানিনা কীভাবে শুরু করবো। আমরা তোমার জন্য প্রচণ্ড গর্ব অনুভব করি। তুমি (মেসি) শেষ পর্যন্ত লড়েছ, তুমি আমাদের শিখিয়েছো জীবনে হাল ছাড়তে নেই।" এছাড়াও বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের দীর্ঘ যাত্রায় মেসির সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে আন্তোনেলা বলেন, "অবশেষে তুমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমরা জানি তুমি এই বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য বহু বছর সংগ্রাম করেছো।"
সূত্র: ইউএসএ ম্যাগাজিন