‘জুয়েলের বাঁচার অনেক ইচ্ছা ছিল’
দুই-একটি বছর নয়; সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকও পেরিয়ে যায় অপেক্ষায়। সুরাইয়া খানম চৌধুরীর অপেক্ষা শেষ হয় না। ছোট ভাইয়ের জন্য বড় বোনের এই অপেক্ষা শেষ হয়নি আজও। ফিরে আসেননি ঢাকার দুর্ধর্ষ ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন বাংলাদেশের এই সূর্য সন্তান।
হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগে শহীদ জুয়েলের জীবন ছিল ক্লাইমেক্সে ভরপুর। কখনও হাতে ক্রিকেট ব্যাট তো কখনও মেশিন গান। প্রিয় মাতৃভূমিকে হায়নাদের হাত থেকে মুক্ত করতে ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাইফেল-মেশিন গান। আজ এই শহর তো কাল আরেক শহরে। কিন্তু শেষ যে শহরে গেছেন শহীদ জুয়েল, সেখান থেকে ফেরেন না কেউ-ই। ফেরেননি তিনিও।
৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে বড় বোন সুরাইয়া খানমের। পিঠাপিঠি হওয়ায় হাজারও স্মৃতি, যে স্মৃতি শান্তিতে ঘুমোতে দেয় না তাকে। আর ১৬ই ডিসেম্বর এলে হুহু করে কেঁদে ওঠে সুরাইয়া খানমের বুক। বিজয় দিবসের রঙিন উৎসব তাকেও ছোঁয়, কিন্তু মনের কোথায় চলতে থাকে ভাই হারানোর আর্তনাদ।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে ছোট ভাই জুয়েলের অনেক স্মৃতি নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন সুরাইয়া খানম। তার মুখ থেকেই শহীদ জুয়েলের জীবনের বিভিন্ন বাঁকের গল্প শোনা যাক।
শহীদ জুয়েলের ছেলেবেলা:
আমি আর জুয়েল পিঠাপিঠি ছিলাম। আমার পর ওর জন্ম। ও আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ছিল। এক সাথে থাকতাম, খেলতাম আবার মারামারিও করতাম। ছোটবেলা থেকেই জুয়েল ক্রিকেট খেলতো। এটাই ওর প্রাণ ছিল মনে হয়। হরতাল হলে বাইরে যেতে পারতো না, তখন বাসার সামনে (টিকাটুলিতে যেখানে আমাদের বাসা ছিল) ব্যাটিং করতো। আমাকে বলতো বোলিং করতে। আমি ভালো বোলিং করতে পারতাম না। ও খেলতো, খেলাটাই ওর কাছে সবকিছু ছিল। মোহামেডান, আজাদ বয়েজ ক্লাবে খেলেছে ও। পড়ালেখার চেয়ে খেলার প্রতিই ওর বেশি টান বেশি ছিল।
ও ছোট বেলায় অনেক দুষ্টু ছিল। কিন্তু বড় হয়ে শান্ত হয়ে যায়। হাটখোলাতে একটা বাবুল বিস্কুট কোম্পানি ছিল। আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবী মেশিনের মধ্যে হাত দিয়েছে, এমন সময় মেশিন চালু করে দেয় জুয়েল। আমার বান্ধবীর একটা আঙুল পুরো থেতলে গিয়েছিল। এখনও সেলাইয়ের চিহ্ন আছে। অনেক দুষ্টু ছিল জুয়েল। ওর নামে পাড়া থেকে অনেক অভিযোগ আসতো। একদিন কোন মেয়েকে কামড় দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নাইন-টেনে উঠে ও এমন শান্ত হলো, আমি ওকে এমন কখনও দেখিনি। বাইরে থাকতো, খেলাধুলা নিয়েই বেশি থাকতো। ও অনেক সৌখিন ছিল। টিপটপ থাকতো। অনেক জুতা ছিল ওর, শুধু জাতা কিনতো। শার্ট, প্যান্ট, হাতের ব্রেসলেট কিনতো। কিন্তু জীবন আর কতদিনের জীবন হলো! যখন সৌখিনতা করবে, তখন তো চলে যেতে হলো।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ:
যুদ্ধের সময় ও ভারত চলে যায়, ওখানেই ট্রেনিং করে। এরপর ঢাকায় এসে অনেকগুলো অপারেশন করে। প্রথম যখন ও ঢাকায় ফিরে বাড়িতে আসে, আমরা ওকে কেউ চিনতে পারিনি। লুঙ্গি পরা, দাড়ি হয়ে গেছে। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ (অস্ত্রসহ)। ও বেশি বাসায় থাকতো না। হয়তো মানা ছিল। মাঝে মধ্যে আসতো। অপারেশন করতো আবার ভারত চলে যেত, আবার আসতো; এভাবে গেছে।
শহীদ জুয়েলের অংশ নেওয়া অপারেশন:
ফার্মগেটে যে অপারেশনটা হয় সেটায় জুয়েল ছিল। সেই অপারেশনে ৯-১০ জনের মতো পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। এরপর ও যখন বাসায় আসে, কেমন যেন হয়ে গেছিলো। সে সময় আমরা বোনরা বাসায় ছিলাম। ও ভেবেছে যে 'আর্মিদের মেরেছি বাসায় রেইড পড়বে।' আমাদের বাসাটা একটু ভিতরে ছিল, কিন্তু ও ভাবছিল ওরা তো বের করবেই। শুধু বলছিল আমাদের বোনদের দেশে পাঠিয়ে দাও, দেশে পাঠিয়ে দাও। আমরা গ্রামে (বিক্রমপুর) চলেও গিয়েছিলাম (বোনরা)।
ওই প্রথম ওকে একটু অন্যরকম দেখেছিলাম। এরপর ও যে খাটে ঘুমাতো সেখানে দেখি একটু উঁচু উঁচু। উঠিয়ে দেখি অস্ত্র। আরেকবার সে অনেকগুলো অস্ত্র নিয়ে আসে। আমাদের বাসায় অনেকগুলো ঘর ছিল, মাঝে যে ঘরটা ছিল সেখানে আমার বাবা-মা সারারাত পাহারা দিয়েছে (অস্ত্রগুলোকে)। এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
শহীদ জুয়েলকে যেভাবে ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী:
আলমদের বাসা ছিল ইস্কাটনে, ওখানে ছিল জুয়েল। ওখান থেকে বের হয়েছে এটা বলে যে, 'অনেকদিন আম্মার সঙ্গে দেখা হয় না, একটু দেখা করে আসি।' এটা বলে সে আবার আজাদদের বাসায় গেছে মগবাজারে। ওখানে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো। ওইখানে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়, তখন আজাদের মা ওদের ওখানে থেকে যেতে বলে। ওইদিন ওরা সেখানে ফ্লোরিং করে থেকে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে। তখন রাজাকাররা খবর পেয়ে রেইড দিয়ে ওকে-ওদের ধরে নিয়ে যায়। এটা আগস্ট মাসে ছিল।
যেভাবে খবর পায় জুয়েলের পরিবার:
জুয়েলকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাতে রাখা হতো, সকাল ১০টার দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। এমপি হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে ওদের নির্যাতন করা হতো কথা বের করার জন্য। একদিন ভোরের দিকে ক্যাপ্টেন রোকসানার (প্লেন চালাতেন যিনি) বাবা রমনা থানায় গিয়ে ওকে দেখতে পায়। তখন জুয়েল বলে আমার বাবাকে একটু খবর দেবেন, আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে এসে উনি আমার বাবাকে খবর দেন। আব্বা অনেক চেষ্টা করেছেন ওকে ছাড়ানোর জন্য, অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছেন, কিন্তু পারেনি।
দূর থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন সুরাইয়া খানম:
ওকে হানাদার বাহিনী ধরার পর খুব অস্থির লাগছিলো আমার। যেহেতু পিঠাপিঠি ভাই-বোন ছিলাম একটা টেলিপ্যাথিও কাজ করে। অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার তখন বিয়ে হয়েছে, একটা বাচ্চা আছে। গ্রাম থেকে লঞ্চে করে আসা যায়। আমার এক মামা আছে, আমি তাকে বললাম যে আমাকে লঞ্চে উঠিয়ে দিতে বা ঢাকায় দিয়ে আসতে। তখন সে আমাকে বলে যে এই গন্ডগোলের মধ্যে ঢাকা যাওয়া যাবে না। তখন আমি বলি আমাদের লঞ্চে উঠিয়ে দিতে। এরপর আমরা ঢাকা আসি।
বাসায় এসে দেখি মা-বাবা কান্নাকাটি করছেন। বাবা কাঁদতেও পারছেন না ভালোভাবে। কারণ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, কাঁদলে আশেপাশে মানুষ আছে, এটাও তো জানাতে পারছে না। আব্বা প্রতিদিন সকাল বেলা উঠে রমনা থানায় যেতেন। সেখানে বাঙালি পুলিশরা জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতেন। ওর বাঁচার অনেক ইচ্ছা ছিল। আব্বাকে বলেছিল যে, চেষ্টা করেন আমাকে বাচাঁতে পারেন কিনা। আব্বা চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি।
জুয়েলের ক্রিকেটস্বপ্ন:
ওর সব সময় ইচ্ছা ছিলো বড় ক্রিকেটার হওয়ার। মাঝে মধ্যে সে করাচিতে গিয়েও খেলেছে। ওর ইচ্ছা ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার কিন্তু তখন বাংলাদেশিদের এতো সুযোগ দিতো না। সে সময় পাকিস্তানিরাই খেলতো। ও ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিল। ভালো খেলতো, অনেক ভালো খেলতো। করাচিতে যখন খেলেছে, সেখানেও অনেক ভালো খেলেছে। সে সময় করাচির উর্দু পেপারগুলো আমদের বাসায় ছিল, ওখানে ওকে নিয়ে লেখা হয়েছিল।
জুয়েলের অনেক আশা ছিল। যখন ওর হাতে গ্রেনেড ফেটে যায় (আশুগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের অপারেশনে) তখন ও আলমদের বাসায় ছিল। সেখানে ডাক্তার দেখতো ওকে। সেখানে চিকিৎসা হয়েছে ওর। সে তখন ডাক্তারকে বলতো, 'আমার হাতটা যে এমন হয়ে গেল, আমি কি আর জীবনে খেলতে পারব না!' ওই যুদ্ধের সময়ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে ভাবতো ও। ক্রিকেট আসলে ওর রক্তে মিশে গিয়েছিল।
জুয়েলকে নিয়ে বোনের গর্ব:
ভাই হারানোর ব্যথা তো আছেই। কিন্তু জুয়েলকে নিয়ে অনেক গর্ব হয়। কারণ গত ছেলে-মেয়েই তো ছিল, সবাই তো যুদ্ধে যায়নি। আমার ভাই গিয়েছিল। দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিয়েছে ও, এরচেয়ে গর্বের আর কিছু নেই। আজীবন গর্ববোধ করি। যেমন দুঃখ পাই, তেমন গর্ববোধও করি।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না সুরাইয়া খানমের:
আমার মনে হতো জুয়েল ফিরে আসবে। একেক জনের কাছ থেকে একেক কথা শুনে এমন মনে হতো। মনে হতো ওদের পাকিস্তান নিয়ে গেছে, হয়তো অনেকদিন পর দেশে ফিরে আসতে পারে। এমন একটা ভাবনা আমার মধ্যে কাজ করতো। মনে হতো হঠাৎ করে চলে আসবে, মাঝেমধ্যে স্বপ্নেও দেখতাম যে ও ফিরে এসেছে। অনেক জায়গাতে খুঁজেছি ওকে, কিন্তু পাইনি। ওর দেহও পাইনি। যে কারণে বিশ্বাস হতো না ও মারা গেছে। মনে হতো ফিরে আসবে।