‘লিমোজিনে চড়ে ডিনারে গিয়েছিলাম’
১৮ জুন, ২০০৫; গগণ বিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ছিল কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন্স। ও যেন বিশ্বজয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দুর্দোন্ড প্রতাপে বিশ্ব শাসন করা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ইংলিশদের মাটিতে বিজয় নিশান উড়িয়েছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। ১৫ বছর আগে আজকের এ দিনে উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ।
রিকি পন্টিংয়ের সেই দলে কে ছিলেন না! অ্যাডাম গিলক্রিস্ট থেকে শুরু করে ম্যাথু হেইডেন, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইকেল ক্লার্ক, মাইকেল হাসিরা ছিলেন ব্যাটিং সামলানোর দায়িত্বে। বোলিংয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পি, মাইকেল ক্যাচপ্রোইচ, ব্র্যাড হগরা। সেই দলটি হার মেনেছিল মোহাম্মদ আশরাফুল নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণ তুর্কির কাছে।
যাদের খেলা দেখে বেড়ে ওঠা, সেই ম্যাকগ্রা, গিলেস্পিদের বোলিংয়ের বিপক্ষে ১০০ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন আশরাফুল। টানা দুইবারের অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে পুরো দেশকে ভাসিয়েছিলেন আনন্দ বন্যায়। ১৫ বছর পর সেই ১৮ জুনে স্মৃতিময় ম্যাচ নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক। তার মুখে শোনা যাক অস্ট্রেলিয়া জয়ের গল্প-
মোহাম্মদ আশরাফুল: ওটাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের একমাত্র জয়। আর তো জয় নেই। ওই সময় অস্ট্রেলিয়া দল ছিল অন্যরকম, অপ্রতিরোধ্য। ওই দলকে আমরা হারাবো এটা কেউ কল্পনাই করেনি। অস্ট্রেলিয়াকে হারাবে বাংলাদেশ, এটা কেউ চিন্তাতেও আনেনি সে সময়। ওই ম্যাচের পর আমরা বিশ্বকাপ খেলেছি, কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছি। কিন্তু ওই জয়ের সঙ্গে তুলনা হয় না।
ওটা স্পেশাল একটা উপলক্ষ। ওই অস্ট্রেলিয়া দল অসাধারণ ছিল। রিকি পন্টিংয়ের দলটা কীভাবে রাজত্ব করেছে, সেটা আমরা সবাই দেখেছি। তো ওই রকম দলের বিপক্ষে আমি ১০০ করেছি, দল জিতেছে, এরচেয়ে ভালো লাগার আর কি!
জয়ের দিকে থেকে ওই ম্যাচটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয়। এরচেয়ে বড় দল ছিল না তখন। আমার ক্যারিয়ারে অত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে আমি আর খেলিনি। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে ছিল সে সময়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো এত বড় দল ছিল না তারা।
আমি ভাগ্যবান যে, ইনিংসের শুরুটা দারুণভাবে করতে পেরেছিলাম। শুরুতেই তিনটা চার মেরে দিই। পুল, সুইপ, কভার ড্রাইভে চার মেরে ফেলি। তারপর আসলে আমি যেভাবে চেয়েছি, যেটা চিন্তা করেছি, ওইভাবেই সব হয়েছে। ব্যাটিংয়ে নামার পর পুরো সময়টা আমার ছিল।
সুমন (হাবিবুল বাশার) ভাইয়ের সাথে আমার একটা জুটি হয়েছিল। ১৩০ রানের ওই জুটিই আমাদের জয়ের পথে নিয়ে যায়। সে সময় সুমন ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলাম, ম্যাচ কীভাবে জেতা যায়। তো উনি উনার ব্যাটিং আর আমি আমার মতো ব্যাটিং করছিলাম। প্রতিটা ওভারেই আমি ক্যালকুলেটিভ ঝুঁকি নিচ্ছিলাম, বাউন্ডারি মারছিলাম। আমাদের রান রেট কখনই ১০-১২ তে যায়নি, ৮ পর্যন্ত উঠেছিল।
তখন তো আসলে ২০০ রান করা মানেই জিতে যাওয়া। আর অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে আমরা ২৫০ করে জিতেছি। এখন যেমন সাড়ে তিনশ করেও নিরাপদ থাকা যায় না। কিন্তু আড়াই'শ মানে তখন অনেক রান। সেটাও ওই অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে। শেষ ২০ ওভার আমাদের ৮ করে দরকার ছিল। তারপরও আল্লাহর রহমত ছিল, হয়ে গেছে।
ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, হগ; এমন সব বোলারদের মোকাবিলা করার ১০০ করার বিরাট তৃপ্তি। কারণ বড়ই হয়েছি তাদের খেলা দেখে। তাদের খেলা টিভিতে সব সময় দেখেছি। ওদের পুরো দলটাই লেজেন্ড দিয়ে ভরা ছিল। ম্যাকগ্রা, হেইডেন, পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিন, ক্লার্ক, হাসি, গিলেস্পি। সবাই প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়, তাদের বিপক্ষে ১০০ করে ম্যাচ জিতিয়েছি, এটা অন্যরকম এক অনুভূতি।
দারুণ এক অনুভূতি, অন্যরকম উদযাপন ছিল। কারণ আমাদের টেস্ট সিরিজ ভালো যায়নি, প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ উইকেটে হেরেছিলাম। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছি, ঘোর লাগা এক অনুভূতি কাজ করছিল। আমাদের দল, দেশের মানুষ, সবার জন্য ওই দিন স্মরণীয় দিন।
বিশেষ তেমন উদযাপন ছিল না। তবে লিমোজিনে চড়ে ডিনারে গিয়েছিলাম। আমরা পুরো দলই লিমোজিনে চড়ে ডিনারে গিয়েছিলাম। প্রবাসী বাঙালিরা দুটি লিমোজিন গাড়ি পাঠিয়েছিল। ওই গাড়িতে করে ডিনারে গিয়েছিলাম। আবার ওই গাড়িতে করেই হোটেলে ফিরে আসি।
ওইরকম দলের বিপক্ষে ১০০ করে দলকে জেতানো সত্যিই স্পেশাল। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। দলের খেলোয়াড়, নির্বাচকরা খুবই খুশি ছিলেন। ফারুক ভাই নির্বাচক ছিলেন। উনি টেস্ট সিরিজে ওখানে ছিলেন। আসার আগে উনি বলেছিলেন, 'অন্তত একটা ৫০ করিস।' কিন্তু আমাকে নিয়ে উনার সেই ধারণা ছিল যে, আমি যেদিন খেলব, যেকোনো দলের বিপক্ষে ম্যাচ জেতাতে পারব।
এই ইনিংসটা আমার খুব প্রিয়। যদিও আমি দক্ষিণ আফ্রিকার (২০০৭ বিশ্বকাপ, ৮৩ বলে ৮৭) বিপক্ষে খেলা ইনিংসটাকে এক নম্বর বলি সব সময়। ওটায় আমি সেঞ্চুরি করতে পারিনি। তবু মনে হয় ওটা আমার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। আমার বড় সবগুলো ইনিংসই আমার খুব পছন্দের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইনিংসটা আমি সেরা তিনে রাখব।
ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে আমার শুরুটা ভালো ছিল না। প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ০ রানে আউট হয়ে যাই। কিন্তু পরের তিন ম্যাচে আমি রান করি। ১০০, ৯৪ এবং ৫৮, টানা তিন ম্যাচে রান করি। তেমন কোনো কষ্ট হয়নি রানে ফিরতে। চেষ্টা করেছি, আল্লাহর রহমতে হয়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই জয়টা অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড়ভাবে অবদান রেখেছে। আমরা যে বড় দলকে হারাতে পারি, সেই বিশ্বাসটা ওখান থেকেই সবার মধ্যে তৈরি হয়। এই বিশ্বাসটা থাকা জরুরী। না হলে বড় দলের বিপক্ষে লড়াই করতে পারবেন না। খেলার আগেই ম্যাচ হেরে যেতে হবে আপনাকে। সেদিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়টা আত্মবিশ্বাসের বিশাল ভান্ডার ছিল আমাদের সবার জন্য।