কেন আমরা এখনো ১৩ সংখ্যাটিকে এড়িয়ে যাই? অশুভ মনে করি?
১৩ কে নিছক একটি সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা না করে এটিকে কুসংস্কারের অংশ বানিয়ে ফেলেছেন অনেক মানুষ। নানা দেশেই অশুভ বা দুর্ভাগ্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় সংখ্যাটিকে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে, ভদ্র-সভ্য জাতি বলে নিজেদের নিয়ে গর্ব করা যুক্তরাজ্যের মানুষের কথাই ভাবুন। ১৩ সংখ্যাটি নিয়ে কুসংস্কারে তাদের সংস্কৃতিতে এতটাই প্রবল যে, এটি যুক্তরাজ্যে নির্মাণকাজের মতো ব্যবহারিক পেশাকেও প্রভাবিত করে।
ওয়েলস এর রাজধানী কার্ডিফের সেন্ট্রাল কোয়েতে নির্মাণাধীন একটি নতুন ভবনের ফ্লোর সংখ্যা চিহ্নিত করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ১৩ সংখ্যাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এরকম একটি আধুনিক ভবনে এরকম একটি সংখ্যাকে এড়িয়ে যাওয়া কি ইচ্ছাকৃত ভুল? নাকি কুসংস্কার?
কার্ডিফের রাস্তায় এমন ঘটনা খুব একটি বিরল নয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কার্ডিফের বিভিন্ন ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা হোটেলে সচেতনভাবেই ১৩ সংখ্যাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ ভবনের ১৩ নম্বর ফ্লোরটিকে ১২এ নাম দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আবার কেউ ১২ থেকে লাফ দিয়ে ১৪ তে চলে যান যেমনটা দেখা যায় কার্ডিফের একটি সুউচ্চ হোটেলের ক্ষেত্রে।
হোটেলটিতে ১২ নম্বর ফ্লোরের পরে ১৩ নম্বর ফ্লোরের কোন অস্তিত্বই নেই। সরাসরি ১৪ নম্বর ফ্লোর হিসেবে সেটিকে চিহ্নিত করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
এমনকি যেসব বাড়ির নম্বর ১৩, সেসব বাড়ির দাম তুলনামূলক সস্তা। এর জন্য অতীতে কাউন্সিল থেকে ১৩ নম্বর ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে কারণ লোকে নাকি ১৩ নম্বর বাড়িতে থাকতে চায় না!
ব্রিটেনে চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৪ শতাংশ মানুষ মনে করে ১৩ সংখ্যাটি অমঙ্গল বয়ে আনে। আর ৯ শতাংশ মানুষ আসলে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।
সেন্ট্রাল কোয়েতে নির্মাণাধীন ভবনটির কথায় ফিরে আসা যাক। ভবনটি শহরের কমিউটার ট্রেন স্টেশনের সাথেই অবস্থিত। প্রতিদিন ট্রেনে আসা যাওয়া করা মানুষ ভবনটিকে দেখছে, সেখানে ১৩ সংখ্যাটি যে বাদ দেওয়া হয়েছে সেটিও তাদের চোখ এড়ায়নি।
তেমনই একজন কার্ডিফের গ্রাঞ্জটাউনের সারাহ থমাস যিনি অফিস থেকে একদিন আসবার সময় বিষয়টি খেয়াল করেন। বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল থেকে গুগলে সন্ধান করে সারাহ জানতে পারেন, এমনটা আরো অনেক জায়গায় করা হচ্ছে।
সারাহ বলেন, "আমি ধরেই নিয়েছিলাম এটা কুসংস্কার। কিন্তু গুগল করে আমি জানতে পারলাম যে আরো বড় পরিসরে এমনটা করা হচ্ছে। আমার কিছু বন্ধু আমাকে এরকম ঘটনার কথা জানিয়েছে যেখানে ভবনে কিংবা লিফটের ভেতর ১৩ সংখ্যাটি ছিল না।"
লন্ডনেরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবনেও এমন কুসংস্কার লক্ষণীয়। লন্ডনের এক সময়ের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে পরিচিত ক্যানারি ওয়ার্ফ ভবনটি ১৯৯০ এর দশকে যখন নতুন করে সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করা হয় তখন সেটিতে ১৩ নম্বর ফ্লোর বাদ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ১২ নম্বর ফ্লোরের পরবর্তী ফ্লোরটিকে ১৪ নম্বর ফ্লোর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, আজও ভবনটিতে ১৩ নম্বর ফ্লোরের কোন অস্তিত্ব নেই।
লন্ডনের থেমস নদীর পাশে অবস্থিত দ্য লন্ডন আই অথবা মিলেনিয়াম হুইল নামের নাগরদোলাটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম নাগরদোলা। এটিতে করে প্রায় গোটা লন্ডন এক ঝলক দেখে নিতে পারবেন আপনি। এতে মোট ৩২ টি পড থাকার পরেও ১৩ নম্বর কোন পড নেই। বরং সেটিকে ৩৩ নম্বর পড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কেন ১৩ সংখ্যাটিকে দুর্ভাগ্য মনে করা হয়?
লোকেরা ১৩ নম্বরের সাথে দুর্ভাগ্যের সম্পর্ক থাকার পেছনে বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেন। খ্রিস্টধর্মে বলা হয়েছে, যীশুর শেষ নৈশভোজে আসা ১৩তম অতিথি জুডাস পরবর্তীতে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। নর্সদের পৌরাণিক কাহিনীতে লোকি যিনি কৌশলী দেবতা, তিনি দেবতাদের একটি নৈশভোজে ১৩তম অতিথি হিসেবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন।
১৩ সংখ্যাটির প্রতি ভয় ট্রিস্কাইডেকাফোবিয়া নামে পরিচিত। 'ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ' অর্থাৎ যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে যেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার সাথে ১৩ সংখ্যাটির সম্পর্ক থাকার জন্যও এটিকে দুর্ভাগ্যের সাথে যুক্ত করা হয়।
আধুনিক সমাজের লোকেরা এখনও ১৩ সংখ্যাটিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করে কারণ এটি তুলনামূলকভাবে একটি সাম্প্রতিক ধারণা যার সাথে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের সম্পর্ক নেই।
পৌরাণিক কাহিনি এবং লোককাহিনির একজন বিশেষজ্ঞ এবং কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ড. জুলিয়েট উড এর মতে, ১৩ সংখ্যাটির প্রতি মানুষের ভয় বিংশ শতকের গোড়ার দিকের প্রাচীন লোককাহিনী থেকে না এসে মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে আরও প্রবল হয়েছে।
তিনি মনে করেন, এই আধুনিক বিশ্বাসকে "ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ" এর মতো সিনেমার মাধ্যমে দৃঢ় করা হয়েছে এবং এটি এক ধরনের আধুনিক কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে।
এস্টেট এজেন্ট বডি প্রপার্টিমার্কের কেটি গ্রিফিন ডেভনে নিজের ব্যবসা পরিচালনা করেন। তিনি জানিয়েছেন, বাসা বা ভবনে এখনো ইচ্ছে করে ১৩ সংখ্যাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, "আমি বলব না যে সংখ্যাটি ব্যবহার করলে বাড়ির দাম কমে যাবে। কিন্তু কখনও কখনও এমনটি যাতে না হয় তার জন্য ডেভেলপাররা সংখ্যাটি বাদ দেয়।"
কিন্তু তার মানে এই নয় যে যুক্তরাজ্যের সবাই এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন। ভ্যাল অব গ্ল্যামরগানের কারমেন আবাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক কুসংস্কারের সাথে বেড়ে উঠেছেন, কিন্তু তিনি সেগুলোতে বিশ্বাস করেন না।
তিনি বলেন, "আমি ১৩ তলায় বসবাসের বিষয়ে চিন্তা করব না। যদি এটি একটি সস্তা অ্যাপার্টমেন্ট হয় তবে আমি সেখানে থাকতাম।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়