২২ হলো না ৯২, পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড
মোহাম্মদ ওয়াসিমের ফুল লেংন্থের ডেলিভারিটি মিড উইকেট দিয়ে পাঠিয়ে ১ রান রান পূর্ণ করলেন বেন স্টোকস। এই রানের দাপট এতোটা যে, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এমসিজি) গ্যালারিতে হাজির হওয়া ৮০ হাজার ৪৬২ দর্শকের বেশিরভাগ দর্শককে স্তব্ধ করে দিলো। হ্যাঁ, এই বেশিরভাগ দর্শক পাকিস্তানের সমর্থক। ওই একটি রানই যে ব্যবধান গড়ে দিলো, উড়লো ইংল্যান্ডের বিজয় কেতন। ২০২২ হলো না ১৯৯২, কিংবদন্তি ইমরানের খানের পাশে বসলো না বাবর আজমের নাম। দারুণ এক জয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতে নিলো ইংলিশরা।
রোববার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জিতলো জস বাটলারের ইংল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলো ক্রিকটের জনক দেশটি। এর আগে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো সংক্ষিপ্তম ফরম্যাটের এই বিশ্ব আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা পাকিস্তান ব্যাট হাতে দাপট দেখাতে পারেনি। টুর্নামেন্ট ও ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতা স্যাম কারান, আদিল রশিদদের শাসন হজম করতে হয় তাদের। অন্যদের ব্যর্থতার দিনেও দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে দলকে লড়াইয়ের পুঁজি এনে দেন অধিনায়ক বাবর আজম, শান মাসুদ ও শাদাব খান। ৮ উইকেটে ১৩৭ রান তোলে পাকিস্তান। জবাবে শুরুতে বাটলারের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের পর বেন স্টোকসের দায়িত্বশীল ব্যাটিং, শেষে মারকুটে ব্যাটিংয়ে এগিয়ে দেন মঈন আলী। ১৯ ওভারে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড।
পাকিস্তানের এবারের মিশন ছিল ইমরান খানের ৯২ বিশ্বকাপ যাত্রার মতো। ফাইনাল পর্যন্ত ভিন্ন সময়ের দল দুটির পথচলা ছিল প্রায় একই। ১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতোই এবারও ধুঁকেছে পাকিস্তান। এমসিজিতে প্রথম ম্যাচে হেরেছিল ইমরানের দল, এবার বাবর আজমের দলও একই ভেন্যুতে হার দিয়ে আসর শুরু করে। ৯২ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের শেষ ৩টি ম্যাচে জেতে পাকিস্তান। এবার তারা শেষ তিনটি ম্যাচ জিতে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করেছে।
৩০ বছর আগের সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের শেষ দিনে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত হয় পাকিস্তানের। এবারও একইভাবে শেষ দিনে শেষ চারের টিকেট কাটেন বাবররা। ইমরান খানের সেই পাকিস্তান সেমিতে নিউজিল্যান্ডকে হারায়, এবারও একই প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে পাকিস্তান। ফাইনালে এমসিজিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা উচিয়ে ধরেন ইমরান খান। একই ভেন্যু ও প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বাবর সেটা করে দেখাতে পারলেন না।
অনেক মিলের কারণে ৯২ বিশ্বকাপ ফিরে আসার কথা ছিল সবার মুখে মুখে। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররাও জানান, তাদের অনুপ্রেরণা সেই বিশ্বকাপই। অপেক্ষা ছিল কেবল একটি মিলের। কিন্তু স্টোকস দেখালেন বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না, ইতিহাস লিখতে হয়। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ ওভারে টানা চার ছক্কা হজম করে যে দুঃখের স্মৃতির সঙ্গে বসবাস করে আসছিলেন ইংলিশ এই অলরাউন্ডার, সেই স্মৃতির পাতা এবার তিনি ঢাকলেন দলকে দারুণ এক জয় উপহার দিয়ে।
লক্ষ্য বড় ছিল না, ২০ ওভারের ধুন্ধুমার ক্রিকেটে ১৩৮ রান আর এমন কী! কিন্তু বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় রান রেটের ব্যাপারটিও মাথায় নিয়ে মাঠে নামে ইংল্যান্ড। শুরুটা তাই তেড়েফুঁড়ে করার চেষ্টা করেন দুই ইংলিশ ওপেনার জস বাটলার ও অ্যালেক্স হেলস। যদিও এই জুটির পথচলা দীর্ঘ হয়নি। পাকিস্তান পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদির করা ইনিংসের প্রথম ওভারের শেষ বলে উপড়ে যায় হেলসের স্টাম্প।
অবশ্য এই চাপ কাটিয়ে উঠতেও সময় নেয়নি ইংলিশরা। দ্বিতীয় উইকেটে ফিল সল্টকে সঙ্গে নিয়ে দাপুটে ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন অধিনায়ক জস বাটলার। দলীয় ৩২ রানে এই জুটি ভাঙেন পাকিস্তানের আরেক পেসার হারিস রউফ। মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ৯ বলে ২টি চারে ১০ রান করেন ফিল সল্ট।
উইকেট হারালেও বাটলারের ব্যাটিংয়ে সেটার প্রভাব পড়েনি, ইংলিশ অধিনায়ক শুরুর মতোই খুনে মেজাজেই ব্যাট চালাতে থাকেন। তবে তার ব্যাটিং ঝড় আর বেশি সময় চলতে দেননি হারিস রউফ। ষষ্ঠ ওভারে দারুণ এক ডেলিভারিতে বাটলারকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন পাকিস্তানের ডানহাতি এই পেসার। এর আগে ১৭ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৬ রানের ইনিংস খেলেন বাটলার।
উইকেটের চাপ সামলাতে দেখেশুনে ব্যাটিং শুরু করেন বেন স্টোকস ও হ্যারি ব্রুকস। এই জুটি থেকে ৪২ বলে ৩৯ রান পায় ইংল্যান্ড। হ্যারি ব্রুককে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন পাকিস্তানের লেগ স্পিনার শাদাব খান। ২৩ বলে একটি চারে ২০ রান করেন ব্রুক। তার বিদায়ে চাপ বাড়ার বদলে পথ সহজ হয় ইংল্যান্ডের। উইকেটে গিয়েই দারুণ ব্যাটিংয়ে চাপ কমিয়ে নিয়ে আসতে থাকেন মঈন আলী, অন প্রান্তে স্টোকসও তো ছিলেনই।
নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বল-রানের ব্যবধান ধরে রাখলেও ১৬তম ওভারে গিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় পাকিস্তান। এই ওভারের প্রথম বল করেই চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন শাহিন আফ্রিদি। তার ওভার পূরণ করতে যাওয়া ইফতিখার আহমেদকে শেষ দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন স্টোকস। পরের ওভারের প্রথম দুই বলে আবার টানা দুই চার মারেন মঈন, শেষ বলে মারেন আরেকটি চার। এই দুই ওভারে ব্যবধান ঘুচিয়ে জয়ের সুবাস নিতে শুরু করে ইংল্যান্ড।
শেষ ১২ বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন দাঁড়ায় ৭ রান, এমন সময়ে আউট হন মঈন। ১২ বলে ৩টি চারে ২০ রান করেন ইংলিশ এই অলরাউন্ডার। এরপর লিয়াম লিভিংস্টোনকে নিয়ে জয় তুলে নেওয়ার বাকি কাজটুকু সারেন স্টোকস। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ৪৯ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৫২ রানে অপরাজিত থাকেন। পাকিস্তানের হারিস রউফ ৪ ওভারে ২৩ রানে ২টি উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান শাহিন আফ্রিদি, শাদাব খান ও মোহাম্মদ ওয়াসিম।
এর আগে ব্যাটিং করা পাকিস্তান সাবধানী শুরু করে, দুই ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান ও বাবর আজম দ্রুততার সঙ্গে রান তুলতে পারেননি। তাই সাবধানী শুরু করেও বিশেষ উপকার হয়নি দলটির। পঞ্চম ওভারে আঘাত হানেন টুর্নামেন্টজুড়ে চোখ ধাঁধানো বোলিং করা স্যাম কারান। ১৪ বলে একটি ছক্কায় ১৫ রান করা রিজওয়ানকে ফিরিয়ে দেন ইংলিশ তরুণ এই পেসার।
২৯ রানে প্রথম উইকেট হারানো পাকিস্তানের বিপদ বাড়ে অষ্টম ওভারে। ধীর মেজাজে ব্যাট চালাতে থাকা মোহাম্মদ হারিসকে ফিরিয়ে দেন ইংলিশ লেগ স্পিনার আদিল রশিদ। ২১ বছর বয়সী পাকিস্তানি এই ব্যাটসম্যান ১২ বলে ৮ রান করে সাজঘরে ফেরেন। দলীয় ৪৫ রান থেকে দলের হাল ধরেন বাবর ও শান মাসুদ।
এই জুটি থেকে ২৪ বলে ৩৯ রান পায় পাকিস্তান, এ সময়ে বাড়ে রান তোলার গতিও। চাপ কাটিয়ে পাকিস্তানের পথচলা যখন ছন্দময়, তখনই স্পিন ছোবল হানেন আদিল। এবার তার শিকার পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর। ওয়ানডে মেজাজে খেলতে থাকা তারকা এই ব্যাটসম্যান ২৮ বলে ২টি চারে ৩২ রান করে আউট হন।
বাবরের বিদায়ে বিপাকেই পড়তে হয় পাকিস্তানকে। পরের ওভারেই ইফতিখার আহমেদকে হারায় তারা। ৬ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি তিনি। দ্রুত দুই উইকেট হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানের রান তোলার গতি কমে যায়। শান মাসুদ এক পাশ আগলে রানচাকা সচল রাখলেও উইকেটে থিতু হতে সময় লেগে যায় শাদাব খানের।
১১ ওভারে ৮৪ রান তোলা পাকিস্তান ১০০ রান পূর্ণ করে ১৪.৩ ওভারে। শতরান পেরিয়ে শানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শাদাবও দ্রুত ব্যাট চালাতে শুরু করেন। এই জুটিতে ছন্দেই এগোচ্ছিল বাবরের দল। কিন্তু সেই ছন্দে লাগাম টানেন স্যাম কারান, ফিরিয়ে দেন শান মাসুদকে। তার বিদায়ে ভাঙে ৩৬ রানের জুটি। ফেরার আগে ২৮ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ইনিংস সেরা ৩৮ রান করেন তিনি।
পরের ওভারে শাদাব খানও ফিরলে পাকিস্তানের রান তোলার গতি আবারও কমে যায়। কিছুটা সময় দরকে পথ দেখানো পাকিস্তানের এই অলরাউন্ডার ১৪ বলে ২টি চারে ২০ রান করেন। শেষ দিকে কেউ পারেননি রান তুলতে, উল্টো শুরু হয় আসা যাওয়ার মিছিল। অসাধারণ বোলিং করা কারান ৪ ওভারে মাত্র ১২ রানে ৩ উইকেট নেন। ২টি করে উইকেট নেন আদিল রশিদ ও ক্রিস জর্ডান। বেন স্টোকসের শিকার ১ উইকেট।