কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে শীর্ষ স্পন্সর চীনের ব্র্যান্ডগুলো
রোববার (২০ নভেম্বর) পর্দা উঠতে চলেছে ফুটবলের শীর্ষ আসর কাতার বিশ্বকাপ ২০২২- এর। এবারের বিশ্বকাপে নেই চীনের কোনো দল। তবু দেশটির ব্যবসাগুলো স্পন্সর হিসেবে শীর্ষে রয়েছে। খবর আল জাজিরার
এবারের আসরের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক চীনের ব্র্যান্ডগুলো। এক্ষেত্রে তারা কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ডস ও বাডওয়াইজারের মতো শীর্ষ আমেরিকান কোম্পানি ও প্রথাগত স্পন্সরদের পেছনে ফেলেছে।
লন্ডন-ভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও পরামর্শক কোম্পানি– গ্লোবালডেটার তথ্যমতে, ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এবারের বিশ্বকাপ আসরের জন্য- চীনের স্পন্সররা মোট ১.৩৯৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ দেবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো দেবে ১.১ বিলিয়ন।
এটিকে বার্ষিক-ভিত্তিতে হিসাব করা হলে দেখা যায়, চীনের স্পন্সররা বছরে দেবে ২০৭ মিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তির মূল্য বছরে যথাক্রমে ১৩৪ ও ১২৯ মিলিয়ন ডলার।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ স্পন্সর হওয়ার মাধ্যমে উঠে এসেছে চীনা কোম্পানিগুলোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এতে বোঝা যাচ্ছে, চীনা ব্র্যান্ডগুলো বিদেশের বাজারে বাড়াতে চায় তাদের পরিচিত তথা পণ্যের স্বীকৃতি।
চীনের স্পন্সরদের শীর্ষে আসার ঘটনা– প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দেশটিকে ফুটবল "পাওয়ারহাউজে" পরিণত করার লক্ষ্যের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও কেবলমাত্র একবার ২০০২ সালের বিশ্বকাপে উপস্থিতি ছিল চীনা দলের। তবে এনিয়ে বেইজিংয়ের রয়েছে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এবং সে অনুসারে বিভিন্ন লক্ষ্য। এরমধ্যে রয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ফুটবল মাঠ থাকা স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ।
দেশে সুপরিচিত ও স্বীকৃত ব্র্যান্ড হলেও কাতার বিশ্বকাপের স্পন্সর চারটি চীনা ব্র্যান্ড- ওয়ান্ডা গ্রুপ, ভিভো, মেংনিউ ডেইরি ও হাইনিজের– বৈশ্বিক ভোক্তাদের কাছে পরিচিতি নেই ততোটা। তবে বৃহৎ এই উদ্যোগগুলো মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের, আর তাদের রয়েছে হাজার হাজার কর্মী।
যেমন ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ান্ডা গ্রুপের ব্যবসা প্রসারিত অনেকগুলো খাতে। আবার চীনের সবচেয়ে বড় ডেইরি পণ্য প্রস্তুতকারক মেংনিউ।
তবে দুটি কোম্পানি বেশ কয়েকবার ফরচুন ৫০০ তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ আয়ের ৫০০টি কোম্পানিকে প্রতিবছর এ তালিকায় তুলে ধরা হয়।
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক পরামর্শক ও ব্রান্ডিং বিশেষজ্ঞ মার্টিন রল আল-জাজিরাকে বলেন, 'চীনের দর্শকদের কাছেও রয়েছে ফুটবলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তাই বিশ্বকাপে স্পন্সর করা চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য দেশের ভেতর ও বাইরের- দুই বাজারের জন্যই সহায়ক ভূমিকা রাখে'।
'চীনের ব্র্যান্ডগুলি যে বৈশ্বিক পরিসরে ব্যবসা করছে- এর মাধ্যমে সে ঘটনারও শক্তিশালী ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার দিকটি চীনের দর্শকদের কাছেও তুলে ধরতে পারছে। তাছাড়া বিশ্বকাপের স্পন্সর ও বিপণন অংশীদার হতে পারে কেবল আর্থিকভাবে অতি-সক্ষম সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যান্ড। সেই কাতারে শীর্ষে থাকা চীনের ব্র্যান্ডগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষারই নিদর্শন'- যোগ করেন তিনি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞ পল টেম্পোরাল মনে করেন, দক্ষতা ও নৈপুণ্যের এ খেলার সর্বোচ্চ আসরে যুক্ত থাকার মাধ্যমে 'মেইড ইন চায়না' মানেই নিম্ন মানের এ ধরনের নেতিবাচক ধ্যানধারণাকেও ভাঙতে চাইছে চীনা কোম্পানিগুলো।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'ক্রীড়ার স্পন্সরশিপের মাধ্যমে চীনের ব্র্যান্ডগুলো বৈশ্বিক দর্শকের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং খেলার সাথে জড়িত সর্বজনীন আবেগী অভিজ্ঞতা ও ভালোবাসার সঙ্গী হওয়ার সুযোগ পায়'।
'তারা তাদের পশ্চিমা প্রতিযোগীদের থেকে শিক্ষা নিয়েছে যে, ক্রীড়ার বৈশ্বিক আসরগুলিতে স্পন্সর হওয়া বিপুল ব্যয়ের হলেও– তার মাধ্যমে ব্র্যান্ডের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ও উৎস দেশ দীর্ঘমেয়াদি সুফল লাভ করে। বৈশ্বিক আসরে যোগ দেওয়া ব্র্যান্ডগুলি সেখানে চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাতে সফল হলে তাদের বিশ্ববাজার অংশীদারিত্বও বাড়ে। এতে তাদের জাতীয় ভাবমূর্তিও (ইতিবাচকভাবে) প্রভাবিত হয়।
কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় স্পন্সর ওয়ান্ডা গ্রুপ– ফিফার আনুষ্ঠানিক সাত অংশীদারের তালিকায় রয়েছে। সর্বোচ্চ এই তালিকায় থাকা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলি হলো– কোকাকোলা, অ্যাডিডাস, হুন্দাই, কিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, কাতার এনার্জি ও ভিসা।
বেইজিং -ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী ওয়ান্ডা গ্রুপের ব্যবসা– আবাসন, বিনোদন, গণমাধ্যম, প্রস্তুতকারক শিল্প, আর্থিক সেবাসহ অনেক খাতে বিস্তৃত। গ্লোবাল ডেটার তথ্যমতে, ফিফার সাথে তারা ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের অংশীদারিত্ব চুক্তি করেছে, যার আওতায় থাকবে ২০৩০ পর্যন্ত আয়োজিত সবকটি বিশ্বকাপের আসর।
অন্যদিকে, কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স প্রস্তুতকারক কোম্পানি ভিভো চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ডংগুয়ান-ভিত্তিক উদ্যোগ। ফিফার সাথে তারা ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এর আওতায় ২০১৭ সালের কনফেডারেশন কাপ, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপও ছিল। চলতি আসরেও পড়েছে ওই চুক্তির আওতায়।
চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া প্রদেশের হোহত শহরে সদর দপ্তর মেংনিউ কোম্পানির। আর কিংদাও-ভিত্তিক ইলেক্ট্রনিক্স প্রস্তুতকারক হাইসেন্স। কোম্পানি দুটি ফিফার সাথে যথাক্রমে ৬০ ও ৩৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণন বিভাগের অধ্যাপক কার্লোস তোরেল্লি চীনের জনপ্রিয় পার্সোনাল কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডগুলোর বিষয়ে আল জাজিরাকে বলেন, 'বিদেশি ব্র্যান্ডগুলি কিনে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক চীনা কোম্পানি তাদের বৈশ্বিক উপস্থিতি জোরালো করেছে। যেমন নিজস্ব ব্র্যান্ডের প্রসারের সাথে সাথে এই কৌশল অনুসরণ করেছে লেনোভো এবং হায়ার- এর মতো ব্র্যান্ড'।
২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে যুক্ত হয় চীনের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারক ইংলি সোলার। তারাই ছিল চীন থেকে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের স্পন্সর। তবে ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আসর থেকেই নিজেদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে চীনের কোম্পানিগুলো।
এছাড়া, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ফিফার স্পন্সরশিপের দর প্রক্রিয়ায় সনি, এমিরেটস এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদেরকে বাদ দেয় ফিফা। এতে ফিফার তহবিলে যে ঘাটতি দেখা দেয়– তা পূরণে এগিয়ে আসে চীনা কোম্পানিগুলো।
২০১৬ সালে ফিফার সাথে তাদের মেগা-স্পন্সরশিপ চুক্তি সই করে ওয়ান্ডা গ্রুপ। চুক্তি সইয়ের কিছুদিন পরই কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ওয়াং জিয়ানলিন বলেন, দুর্নীতি ঘিরে ওই 'বিতর্ক' ছিল চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য এক অনবদ্য 'সুযোগ'। এর আগে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চীনা ফার্মগুলি এই টুর্নামেন্টে সমর্থন দিতে পারেনি।