স্টেডিয়ামের বাইরে যেভাবে বিশ্বকাপ দেখছেন কাতারে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা
দোহার ক্রিকেট স্টেডিয়ামের বাইরে সমবেত হাজার হাজার লোক। লোকসমাগমের জনপ্রিয় এ স্থানে আছে বিভিন্ন খাবার ও পানীয়ের স্টল, ফুটবল পিচ আর ভলিবল কোর্ট। এখানে বড় স্ক্রিনে দেখানো হয় বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ। হাফ-টাইমে স্ক্রিনে হিন্দি সিনেমার নাচগানই চলে বেশি। দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে
দোহার এশিয়ান টাউনে অবস্থিত 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যান জোন' প্রবাসী শ্রমিকদের বিনোদন বা কেনাকাটার অত্যাবশ্যকীয় কেন্দ্র। তাদের নেই বিলাসবহুল শপিংমলের পণ্য বা বিনোদন সুবিধা লাভের সাধ্য। তাই 'ফ্যান জোন'টাই তাদের জন্য মলের শূন্যস্থান পূরণ করছে।
কাতারের জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ, কিন্তু সবাই নয় নাগরিক। অধিবাসীদের সবচেয়ে বড় অংশই অস্থায়ী বা বিদেশি শ্রমিক, যারা বেশ স্বল্প-মজুরিতে কাজ করে। সে তুলনায়, কাতারি নাগরিক মাত্র ৩ লাখ ৮০ হাজার। এক কথায়, প্রবাসী শ্রমিকেরাই সেদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এশিয়ান টাউন কম খরচে কেনাকাটা ও অবসর কাটানোর সীমিত হলেও– কিছু সুযোগসুবিধা দেয়। এটি 'লেবার সিটি'র কাছে অবস্থিত। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতার যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে, তাদের শ্রমিকদের থাকার জন্য ২০১৫ সালে লেবার সিটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমজীবী এখানে বসবাস করেন।
দোহার এই এলাকায় শ্রমিকের বসতি সারি সারি। বিশ্বকাপকে সম্ভব করে তুলতে সবচেয়ে বড় অবদান তাদেরই। কিন্তু, এ আসরের ভেন্যুতে অংশগ্রহণের সাধ্য নেই তাদের । দোহার প্রাণকেন্দ্রে যেখানে বিশ্বকাপ আয়োজন চলছে, সেখানে যেতে হলে লাগে 'হায়া কার্ড'। কারো কাছে ম্যাচের টিকিট আছে কিনা– তার ওপর ভিত্তি করে হায়া কার্ডের নিবন্ধন ও ইস্যু করা হয়। বলাইবাহুল্য, বিশ্বকাপ ম্যাচের টিকেট কেনাটা স্বল্প-মজুরির শ্রমিকের কাছে বড় অপব্যয়। তাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে দেশে থাকা আপনজন। তাই হায়া কার্ডহীনদের দোহার ঝলমলে আয়োজনও ঘুরে দেখা হয় না।
দ্য অ্যাথলেটিক প্রবাসী শ্রমিকদের বরাত দিয়ে এসব কথা জানায়। তাদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে অসুবিধার ভয়ে নাম গোপন রাখার শর্তে কথা বলেন।
প্রথম দেখায়, অনেকদিক থেকেই প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন কিছুটা সহজ করারই উদ্যোগ মনে হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যান জোনকে। এখানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, কেনিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দরিদ্র মানুষের একসাথে বসবাস। এই প্রবাসে দারুণ সম্প্রীতি তাদের। একসাথে খেলাধুলা, গল্প করেই দৈনিক ক্লান্তি লাঘবের চেষ্টা চলে।
এশিয়ান টাউনে অনেক সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বলে উপস্থিতি ফিফার ব্রান্ডিংয়ের। এরমধ্যে একটি বার্তায় শ্রমিকদের ধন্যবাদ-জ্ঞাপন করে লেখা হয়েছে– "সবসেরা ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনকে সম্ভব করে তুলতে আপনারা যে অবদান রেখেছেন– তাকে ধন্যবাদ জানাই'।
রুঢ় বাস্তবতা হলো– এশিয়ার দরিদ্র দেশের শ্রমিকদের জন্য ইউরোপ না মধ্যপ্রাচ্য, জীবন সহজ নয় কোথাও। কেনিয়ার এক শ্রমিক দ্য অ্যাথলেটিককে বলেন, 'অনেক আশা নিয়ে কাতারে এসেছিলাম। আরও অনেক সুযোগসুবিধা পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু, বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমরা মাসে ১ হাজার কাতারি রিয়াল (২৭৫ ডলার) বেতন পাই। আর খাবারের জন্য পাই ৩০০ রিয়াল ( ৮২ ডলার)'। শ্রমিকদের বাসস্থানের কাছেই তাদের খাবার সরবরাহ কেন্দ্র। খাবার খরচ পাওয়ামাত্রই সেখানে দিয়ে দিতে হয়।
নিয়োগ সংস্থাগুলোর ধোঁকাবাজিও কম নয়। কেনিয়ার এসব শ্রমিক জানান, তাদের দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলো বলেছিল, কাতারে এসে অনায়সে মাসে ৫০০-৬০০ ডলার বেতন পাওয়া যাবে। তাই এখানে আসতে উৎসাহ জাগে তাদের। এজন্য ধারকর্য করে হলেও এক লাখ কেনিয় শিলিং বা ৮১৮ ডলার দিতে হয় এজেন্সিকে। কিন্তু, এখানে এসে উপলদ্ধি করেন বাস্তবতা ভিন্ন।
নাম না প্রকাশের শর্তে কেনীয় ওই শ্রমিক বলেন, 'এখানে আসতে আমাদের প্রায় সবাই কমবেশি ধারকর্য করেছে। বাড়িতে সে দেনার টাকা কিস্তিতে পাঠাই, পরিবারের খরচাও দিতে হয়। সবশেষে আমাদের হাতে কিছুই থাকে না। খুবই অসহায়বোধ হয়। বাস্তবতা হলো, আমার আরও অর্থ দরকার, কারণ নিজের ও পরিবারের জীবন উন্নত করতেই তো এদেশে এসেছি'।
দ্য অ্যাথলেটিকের প্রতিবেদক ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিবাসী। তার কাছে ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে চান অনেক প্রবাসী শ্রমিক। তাদের কাছে স্বর্গরাজ্য দ্বীপদেশটি। সেখানে সহজে ভিসা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জানতেও কৌতুহল ছিল তাদের।
গাড়িতে করে দোহার এই এলাকাটিতে যেতে লাগে মিনিট ২৫। এখানে কাতারি নাগরিকরা কমই বসবাস করে। সে তুলনায়, বিদেশি দর্শক ও সমর্থকরা দোহা গিয়ে কাতারিদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রাই দেখেন।
এখানে অধিবাসীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি খুবই সীমিত। তবে সবাই কম-বেতনেরও নয়। কেউ কেউ আছেন ভারত থেকে আসা আইটি টেকনিশিয়ান। তাদের উপার্জনটাও বেশি। এদের অনেকেই বিশ্বকাপের কয়েকটি ম্যাচ সরাসরি দেখার কথাও জানান।
কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজকরা অবশ্য দাবি করতেই পারেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যান জোন তাদের একটি আন্তরিক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বিশ্বকাপ আয়োজনে অপরিসীম ত্যাগ-স্বীকার করা শ্রমিকদের বিনোদনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। ফুটবলের প্রতি তাদের ভালোবাসাকেও দেওয়া হচ্ছে স্বীকৃতি। তবে এটাও সত্যি, অবকাঠামো নির্মাণকাজে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। তাদের স্বজন ও পরিবারের জন্যও কিছু করাটা জরুরি ছিল।
প্রবাসী শ্রমিকদের বসবাসের এলাকা বিশ্বকাপের চাকচিক্যের মধ্যে গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে সেভাবে আসেনি। এখানে সাংবাদিকদের আনাগোনাও নেই তেমন। সবাই ছুটছেন বিশ্বকাপের মিডিয়া সেন্টারগুলিতে। দোহার প্রাণকেন্দ্রের ফ্যান জোনগুলোই নিয়েই যত আলোচনা।
একই শহরে এত ভেদাভেদ সহজেই চোখে পড়ার মতো। মূলত একারণেই, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশ থেকে আসা স্বল্প-মজুরির শ্রমিকেরা মূল আয়োজন থেকে বাদ পড়েছেন। তবে বৈষম্য শুধু কাতারে ব্যাপক একথা বলাও হবে অনুচিত। মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই এই পরিস্থিতি।
উগান্ডার একজন শ্রমিক হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে আছেন। এতে যুক্ত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা। ওইসব দেশেও একই রকম পরিবেশ বলে জানান তিনি।
ফ্যান জোনে আসা আরেক উগান্ডার শ্রমিক ওই গ্রুপে চ্যাট করছিলেন ফুটবল নিয়ে। ক্লাব ফুটবলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থক তিনি। সেই সুবাদে বিশ্বকাপে সমর্থন দিচ্ছেন ইংল্যান্ডকে।
দেশের আট বছরের এক কন্যাশিশু আছে তার। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অর্থায়ন ও হিসাবরক্ষণ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নেবেন। কিন্তু, সে সুযোগ কই। প্রতিমাসেই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। দোহায় তিনবছর কাটিয়েও জীবনের এই বাস্তবতাকে এড়ানোর সুযোগ পাননি। খরচ বাঁচাতে আরও তিনজনের সাথে ছোট্ট এক ভাড়া ঘরে থাকছেন।
বিশ্বকাপের পর কাতারে প্রবাস জীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চান দ্য অ্যাথলেটিকের প্রতিবেদক। জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, 'এখানে জীবনে উন্নতি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। অন্তত আমার কাছে তা মনে হয়নি। ভালো ভালো চাকরিগুলো দক্ষ কর্মী আর কাতারি নাগরিকদের জন্যই সংরক্ষিত'।
তিনি ব্যঙ্গ করেই বলেন, 'বিদেশি পর্যটকরাও আমাদের এড়িয়ে চলেন। আসলে আমাদের মতো গরিব মানুষকে দেখারই বা কী আছে'।
এভাবেই বিশ্বকাপ আয়োজনে ত্যাগ-তিতিক্ষা যাদের অপরিসীম– তারা নিভৃতেই রয়ে যাচ্ছে।