পেলের ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: ১০০০তম গোল, ১৯৭০ বিশ্বকাপ এবং গৃহযুদ্ধ থামানো
ফুটবল কিংবদন্তি পেলে বৃহস্পতিবার মারা গিয়েছেন। বিশ্বজুড়ে ফুটবলকে জনপ্রিয় করার জন্য আর কোনো খেলোয়াড়ই অমর পেলের চেয়ে বেশি কিছু করেননি। পুরুষ বা মহিলা খেলোয়াড় মিলিয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র খেলোয়াড় তিনি। এই ফ্রি-স্কোরিং ফরোয়ার্ড নেতৃত্ব দিয়েছেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্লাবকেও। তার এই মৃত্যু বৈশ্বিক খেলার জগতে এক বিধ্বংসী শূন্যতা তৈরি করেছে। তাই গোল.কম তার অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্তগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
অভিষেকে গোল... দুবার
পেলের পেশাদার ফুটবলে অভিষেক ঘটে ১৯৫৬ সালে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে, কিংবদন্তি ফরোয়ার্ড সান্তোসের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন করিন্থিয়ানস সান্তো আন্দ্রের বিরুদ্ধে। মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি ট্রায়ালের পর সান্তোসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।
৭-১ ব্যবধানে সে ম্যাচ জিতে নেয় সান্তোস, পেলে একটি গোলও করেন। সান্তোসে কাটানো ১৮ বছরের সোনালী সময়ের সূচনা হয় এর মাধ্যমেই। তবে গোলটি যে আহামরি কিছু ছিল তা নয়। গোলকিপারের হাত থেকে ছিটকে আসা রিবাউন্ড জালে জড়িয়ে শুরু হয় ইতিহাসের।
এর পরের বছরের জুলাই মাসেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় পেলের, তাও আবার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। তখনো সান্তোসে তিনি খুব বড় নাম নন। তবে সাও পাওলোর নতুন স্টেডিয়াম তৈরিতে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচে নামানোর মতো যথেষ্ট মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন ব্রাজিলের ম্যানেজার সিলভিও পিরিলোকে। কিশোর পেলে তারপরও মারাকানার জাল খুঁজে পান, আলবিসেলেস্তেদের বিরুদ্ধে সেলেসাওদের একমাত্র গোল করেন তিনি, ব্রাজিল ম্যাচটি হারে ২-১ গোলে।
একজন সুপারস্টারের জন্ম
সুইডেনে হওয়া ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফুটবল দর্শকদের কাছে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেন পেলে। গ্রুপ পর্বে মাত্র একবার মাঠে নামার পর তার টুর্নামেন্ট শুরু হয় কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে। সেই ম্যাচেই ওয়েলসের রক্ষণ ভেদ করে ১-০ ব্যবধানের জয় নিয়ে নিজের দলের অগ্রগতি নিশ্চিত করেন।
পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ৫ ম্যাচে ৯ গোল করা জাঁ ফন্তে আর তার ফ্রান্স দলকে সেমিফাইনালে ৫-২ গোলে হারায় ব্রাজিল, পেলে হ্যাটট্রিক করে ফাইনালে নিয়ে যান হলুদ জার্সিধারীদের। এবং ফাইনাল ম্যাচেও স্বাগতিক সুইডেনকে ৫-২ ব্যবধানে হারানোর পর পেলে তার রাজমুকুটে প্রথম হীরাটি যুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্রাজিলের নাম প্রতিধ্বনিত হয়, ফুটবল পায় তার ইতিহাসের প্রথম মেগাস্টার।
মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়ন
পেলের নিরন্তর বিদেশযাত্রার কারণে কোপা আমেরিকা তেমন খেলেননি তিনি, মাত্র একবারই কোপা আমেরিকায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৯ সালের সেই টুর্নামেন্টে হয় লীগ আকারে। আর্জেন্টিনার চেয়ে ১ পয়েন্ট কম থেকে রানার্স-আপ হিসেবে ব্রাজিল টুর্নামেন্ট শেষ করলেও ৮ গোল করে জিতে নেন গোল্ডেন বুট। তবে ক্লাব পর্যায়ে মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বেশ কয়েকবার।
১৯৬২ সালে পেনারোলের বিপক্ষে কোপা লিবার্তাদোরেসের ফাইনালে দুই লেগের পর গোল সমান হলে, তৃতীয় আরেকটি প্লে-অফ ম্যাচ খেলা হয়। নিরপেক্ষ সেই এস্তাদিও মনুমেন্টালের মাঠে হাফ টাইমের ঠিক পরে তার গোলে ভর করে সান্তোস জিতে নেয় তাদের প্রথম মহাদেশীয় শিরোপা। পরের বছরও আলভিনেগ্রোরা তাদের মুকুট ধরে রাখে, বোকা জুনিয়র্সকে হারানো সেই ম্যাচেও পেলে গোল করেন।
এই দুই খেলায় জয় সান্তোসকে জায়গা করে দেয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে তাদের ইউরোপীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নামার জন্য। ১৯৬২ সালের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে বেনফিকার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেন পেলে, দুই লেগ মিলিয়ে গোল করেন ৫টি। পরের বছরও সান্তোসের শিকার হয় এসি মিলান, তার দুই গোল বাঁচিয়ে রাখে প্লে-অফ খেলার আশা, যার ওপর ভর করেই টানা দুইবার আন্তঃমহাদেশীয় শিরোপাও জিতে নেয় সান্তোস।
পরপর পাঁচ লীগ শিরোপা
১৯৬০-এর দশক জুড়ে সান্তোসের হয়ে খেলা দলটিকে তাদের ক্লাব ইতিহাসের সেরা দল হিসেবে ধরা হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ওস সান্তাস্তিকোস। এই অসাধারণ দলের শিরোপার সংখ্যা অন্তহীন, এবং তাদের আক্রমণভাগের নেতা ছিলেন পেলে।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বার লিগ শিরোপা জিতে নেয় সান্তোস, এর মধ্যে ৩টি মৌসুমেই সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন পেলে। ১৯৬২ সালে ট্রেবলও জিতে নেয় তারা, যার মধ্যে রয়েছে মহাদেশীয় কোপা লিবার্তাদোরেস, ক্যাম্পেওনাতো পাওলিস্তা এবং টাকা ব্রাসিল।
গৃহযুদ্ধ থামানো
পেলের তারকা খ্যাতি বাড়ার সাথে সাথে সান্তোস শিরোপা জয়ের চেয়ে লাভজনক আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। আধুনিক সময়ে এ ধরনের চিন্তা অনেকটা অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু ষাটের দশকে এটাই ছিল বাস্তবতা।
এরকমই এক বিদেশ ভ্রমণে সান্তাস্তিকোসরা নিজেদেরকে খুঁজে পায় নাইজেরিয়ায়, যখন তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী বায়াফ্রা রিপাবলিকানদের সাথে লড়ছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, পেলে এবং তার সতীর্থরা যখন লাগোসে ঢোকে, তখন অস্ত্রগুলো ৪৮ ঘণ্টার জন্য থেমে যায়। নাইজেরিয়ার জাতীয় দলের সাথে সান্তোসের ম্যাচটি ড্র হয় ২-২ গোলে, সান্তোসের হয়ে দুটি গোলই করেন পেলে।
প্রায় ৬০ বছর পর, এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ দাবি করে যে, যুদ্ধ আসলে দুই সপ্তাহ আগেই থেমে গিয়েছিল, আবার অনেকের মতে, ম্যাচ চলাকালীনই স্টেডিয়ামের বাইরে গুলির শব্দ শোনা যায়। পেলে নিজেও জানেন না আসলে কী হয়েছিল। কারণ প্রতি বছর তিনি তখন সান্তোসের হয়ে ১০০-র বেশি ম্যাচ খেলছিলেন।
১০০০ গোল!
তার সফরসূচির ব্যস্ততা এবং 'প্রতিযোগিতামূলক খেলা' কোনগুলোকে ধরা হবে তা নিয়ে বিতর্কের কারণে, পেলের গোলের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে ১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর, সান্তোস এবং ভাস্কো দা গামার দর্শকরা একত্র হয়ে দাঁড়িয়ে পেলেকে সম্মান জানিয়েছিলেন তার ১০০০ তম পেশাদার গোল উপলক্ষ্যে। অবিশ্বাস্যভাবে, পেলের বয়স তখনো ৩০ বছর হয়নি, যখন তিনি এই মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন।
পেলে তার বুট ঝুলিয়ে রাখার আগপর্যন্ত গোল করেছিলেন তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, তবে পেলে ২০১৫ সালে বলেছেন তিনি সবমিলিয়ে ১,২৮৩টি গোল করেছেন।
বিশ্বকাপের অমরত্ব
১৯৬২ সালে চোট খেয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়ার পর এবং ১৯৬৬ সালে আগেই বিদায় নেওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখনো কিছু করে দেখানো বাকি রয়েছে পেলের। ১৯৬৬ সালেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিশ্বকাপ খেলবেন না। তবে ১৯৬৯ সালে তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলান এবং সেলেসাওদেরকে নিয়ে বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই করতে অবদা রাখেন।
পেলে এবং ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে আলাদা একটি চলচ্চিত্রই লেখা যাবে। কী হয়নি সেখানে? ববি মুরের সাথে দ্বন্দ্ব, চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে গোল করা, উরুগুয়ের গোলরক্ষককে অপমান কররা তার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, আর বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরা তার আইকনিক ছবি। ছবিটি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়কে অমর করে রেখেছে, ৪-১ গোলে ইতালিকে হারানোর ম্যাচে গোলের ধারা শুরু হয়েছিল তার পা থেকেই।
আমেরিকায় বসবাস
আমেরিকান ফুটবলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পেলে তার ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন। প্রথমে নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে তিনি কোনোভাবেই খেলার পক্ষপাতী ছিলেন না। সান্তোসের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই ছিল যে,তিনি সত্তরএর দশকের প্রথমার্ধেও নিয়মিত বিভিন্ন প্রদর্শনী ম্যাচে নিয়মিত মাঠে নামতেন। অবশেষে, ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা উত্তর আমেরিকান সকার লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে একটি বড় অর্থের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন পেলে।
এবং তাকে সফলও বলা চলে। পেলের পর একে একে উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমান কার্লোস আলবার্তো, ববি মুর এবং ইয়োহান ক্রুয়েফ এবং ফ্রাঞ্জ ব্যাকেনবাওয়েরের মতো কিংবদন্তি ফুটবলাররা। তাদের পেশাদারি খেলোয়াড়ের গোধূলি সময়ে আটলান্টিকের এপারে স্বল্পমেয়াদী হলেও সফল হন।
১৯৭৭ সালের সেই সকার বোল টুর্নামেন্টজয়ে তার সঙ্গী ছিল আলবার্তো এবং ব্যাকেনবাওয়ের। এরপরেই পেলের আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চার এবং ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে। তাকে সম্মান জানিয়ে কসমস এবং সান্তোস একটি বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করে। ফুটবল রাজা তার বুট তুলে রাখে সারাজীবনের জন্য।