‘প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা লক্ষ্য; কোনোটাই ছিল না বাংলাদেশের’
তখনও তিন ম্যাচ বাকি, কিন্তু হারতে হারতে ততোদিনে ক্লান্ত সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ অধিনায়ক জানিয়ে দেন, এটাই বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ। ৯ ম্যাচে ২ জয়, শেষ পাঁচ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিবর্ণ পারফরম্যান্স। টানা হেরে গেছে দল, কোনো ম্যাচে ন্যূনতম লড়াইও করতে পারেনি তারা।
কী কারণে এমন ভরাডুবি? নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের পর অনেকটা 'অসহায়'- এর মতো করেই সাকিব জানান, কারণ জানা নেই তার। তবে প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল বলে তার মত। বিশ্বকাপ শেষে নাজমুল হোসেন শান্ত জানান, ব্যাটিং অর্ডারে এতো পরিবর্তন না এনেও ভালো করার সুযোগ ছিল।
বাংলাদেশের এই দুই ক্রিকেটারের সঙ্গে একমত মোহাম্মদ রফিক। তবে জাতীয় দলের সাবেক এই স্পিনার যোগ করেছেন পরিকল্পনার ঘাটতি ও লক্ষ্য স্থির না করার বিষয়গুলো। তার মতে, বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা লক্ষ্য; কোনোটাই ছিল না বাংলাদেশের। এ ছাড়াও বাংলাদেশ দলে চান্দিকা হাথুরুসিংহের ভূমিকা, বিশ্বকাপের আগে তামিম ইকবালকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কসহ আরও অনেক বিষয় নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন রফিক।
বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন
মূল্যায়ন করার কিছুই নেই, আসলে মূল্যায়ন করার জায়গাই তো নেই। খুবই খারাপ বিশ্বকাপ গেছে আমাদের। হারতেই পারে দল, এর মাঝেও ইতিবাচক অনেক কিছু থাকে। এবার তেমন কিছুই নেই বাংলাদেশের। হেরে যাওয়া একটি ম্যাচেও লড়তে পারিনি আমরা, এটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার জায়গা। ব্যাটিং ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে, পাশাপাশি বোলিংয়ে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।
ব্যর্থতার কারণ
মূল ব্যাপার হচ্ছে বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের ওই রকম প্রস্তুতি ছিল না। প্রস্তুতির কথা বিশেষ করে বলছি কারণ, এমন আসরের আগে প্রস্তুতিটা বেশি জরুরি। অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে দেখবেন বছর খানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। তাদের পরিকল্পনা থাকে, এদের নিয়ে আমরা অনুশীলন করব, এর মাঝে সিরিজ থাকলে এদের নিয়ে খেলব। কিন্তু আমাদের উল্টোটা হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে ছয় মাসে কতো খেলোয়াড়কে খেলিয়েছে বাংলাদেশ? কতো পরিবর্তন করেছে? তাহলে প্রস্তুতি বা পরিকল্পনাটা কোথায়! ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে আপনি বিশ্বকাপের খেলোয়াড় খুঁজে পাবেন? এর মধ্যে আপনি পরিবর্তন করিয়ে অন্তত ২৫-৩০ জন খেলোয়াড়কে খেলিয়েছেন।
আমাদের লক্ষ্য ছিল না বিশ্বকাপে, কোনো লক্ষ্য ছিল না। বিশ্বকাপ শব্দটাই শুধু ছিল, আর কিছু ছিল না। অংশ নিতে হবে, অংশ নিলাম; বাংলাদেশের জন্য ব্যাপারটা হয়তো এমন ছিল। অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে এমনই মনে হয়। তারা কতো আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করে। তারা পরিকল্পনায় স্থির থাকে। আশেপাশে ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কাকেই দেখেন, তারা এক বছরে কয়টা খেলোয়ার পরিবর্তন করেছে? আর বাংলাদেশ ছয় মাসে কতো পরিবর্তন করেছে..! প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা লক্ষ্য; কোনোটাই ছিল না বাংলাদেশের।
এভাবে পরিবর্তন করলে বলতে পারবেন যে প্রস্তুতি ছিল? আপনার চিন্তা থাকবে ২০জন খেলোয়াড়কে প্রস্তুত করবো, ১৫ জন স্কোয়াডে থাকবে, পাঁচজন স্ট্যান্ড বাই। বিকল্প লাগলে এখান থেকে নেওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের এমন কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। তাহলে আপনি কীভাবে চিন্তা করেছেন? ভরাডুবির প্রধান কারণ হিসেবে আমি প্রস্তুতির কথাই বলব। ম্যানেজমেন্ট এটা নিয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি। সিরিজ খেলার মতো করে ভেবেছে তারা। প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার ঘাটতির কারণেই এই ভরাডুবি। কোনো পরিকল্পনাই ছিল না।
ব্যাটিং অর্ডারে অনেক পরিবর্তনের প্রভাব
ব্যাটসম্যান হলে তার প্রস্তুতির দরকার আছে। সেটাও মানসিকভাবেও। কেউ ওপেনার হলে সে ওইভাবে প্রস্তুতি নেয়। কেউ যদি জানে সে সাতে ব্যাটিং করবে, ওই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু আপনি জানেন না কোথায় খেলবেন, এমন হলে তো পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়বেই। বাংলাদেশ এবার অনেক বেশি ওলট-পালট করেছে ব্যাটিং অর্ডারে, অবশ্যই এটার প্রভাব পড়েছে। ব্যর্থতার কারণের মধ্যে এটাকেও রাখতে হবে।
কোচিং স্টাফে পরিবর্তন
চান্দিকা হাথুরুসিংহে তো আগে কাজ করে গেছে বাংলাদেশে, সে নতুন কী করতে পারবে আর। বাংলাদেশ দলে নতুন লোক (কোচ) দরকার। নতুন কেউ এলে নতুন কৌশল নিয়ে কথা বলবে, ভিন্নভাবে কাজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পেছনে গেছে। এটার মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
অনেক সময় জেতার মাঝেও খারাপ সময় যায়, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কেউ যদি দীর্ঘদিন দল থাকে, সে আর কী দেবে! তার তো আর দেওয়ার কিছু নেই। নতুন কেউ এলে সে নতুন করে ভিন্নভাবে কিছু করার চেষ্টা করবে, নতুন পরিকল্পনা সাজাবে। ভালো ফল আনার জন্য বা দলের উন্নতির জন্য তার মধ্যে চ্যালেঞ্জ কাজ করবে। নিজের মেয়াদে পরিকল্পনা সাজাবে। কিন্তু পুরনো যা আছে, আমরা সেটা নিয়েই কাজ করছি।
বাংলাদেশ দলে হাথুরুসিংহের ভূমিকা ও তার কার্যক্রম
কোচদের এমন স্বাধীনতা একমাত্র বাংলাদেশ দলেই দেয়। সে সিনিয়র ক্রিকেটারদের একপাশ করানোর পাশাপাশি অনেক কিছুই করেছে, তার অনেক ক্ষমতা দেওয়া দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেই কেবল এটা সম্ভব। কেবল হাথুরুসিংহেই নয়, আরও অনেককেই দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ নির্বাচকের দায়িত্বও নিয়েছিল। কিন্তু সে তো টাকা কামাতে এসেছে। বিদেশিরা আসবে, চলে যাবেন; থাকব কিন্তু আমরাই, আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা। আমাদেরটা আমাদের বুঝে নিতে হবে। কিন্তু আমাদের ওই চিন্তাটা নেই। আর সে কি বিশেষ কেউ নাকি যে, দায়িত্ব নিয়েই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করে দেবে? সে যা দেওয়ার, আগের মেয়াদেই তো দিয়ে দিয়েছে। তার কাছে আপনি আর কী আশা করেন? সে যদি এত বড় কোচ হন, অন্য কোনো দেশ তাকে ডাকে না কেন? তার দেশ শ্রীলঙ্কাই তাকে বাদ দিলো কেন?
তামিম ইকবালকে ঘিরে বিতর্ক ও সাকিব আল হাসানের 'বিতর্কিত' সাক্ষাৎকার
আমি সমর্থক হিসেবে খেলা দেখি। ভেতরের খবর তো আমরা জানি না। পত্রিকা বা টিভিতে যেভাবে আসে, আমরা সেটাই জানি। এরপরও যেটা মনে হয় যে, বিসিবির দিক থেকেই সমস্যাটা। পুরো এই ঘটনার প্রভাব বিশ্বকাপে পারফরম্যান্সে পড়া অস্বাভাবিক নয়। বিসিবির সঙ্গে খেলোয়াড় থেকে সেটা খেলোয়াড়ের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরিবারের তো একজন অভিভাবক থাকে, তাকেই এসব সামলাতে হয়। এসব মিটমাট না করতে পারলে তাহলে বসার দরকার নেই ওখানে। আমরা যখন খেলেছি, কখনও তো বোর্ডের কর্মকর্তা বা খেলোয়াড়কে নিয়ে এমন নোংরা অবস্থা হয়নি। আমার জীবনে আমি দেখিনি। পুরো ঘটনার প্রভাব বিশ্বকাপে অবশ্যই পড়েছে। কারণ ক্রিকেট মানসিক খেলা। সাদা মাথায় একটা পোকা ঢুকলে আপনি কাজ করতে পারবেন না। এক মাথায় আপনি একসঙ্গে দুই কাজ করতে পারবেন না।