ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পার্থক্যের গ্যাঁড়াকলে আটকা নতুন ক্রিকেটাররা
ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুরি বইয়ে দেওয়া কিংবা মুড়ি মুরকির মতো উইকেট নেওয়া; এমন পারফরম্যান্সে স্বাভাবিকভাবেই ডাক মেলে বাংলাদেশ জাতীয় দলে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আলো ছড়ালেও পড়ে ডাক। কিন্তু সেই ক্রিকেটারই বিশ্ব আঙিনায় গিয়ে চুপসে যান, হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। দলে জায়গা পোক্ত করতে লড়াই করতে হয় বছরের পর বছর। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর কেউ কেউ টিকে যান দলে, কেউ আবার পা হড়কে পতিত হন নিকষ কালো অন্ধকারে। তবে স্বপ্নদুয়ারে পা ফেলে দিক হারানো ক্রিকেটারের সংখ্যাই বেশি।
দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ দলে ডাক পাওয়া এমন অনেক ক্রিকেটারই আছেন, যাদের পথচলা কয়েক ম্যাচেই থেমে গেছে। আবার অনেক সুযোগ পেয়েও নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি, বাংলাদেশ দলে এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা এখনও কম নয়। নতুন ক্রিকেটার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া তো দূরের কথা, কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভরসার পাত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটার। তাদের থেকে যে পারফরম্যান্স মেলে, ধারাবাহিক নয় বলে সেটাকে 'দায়িত্ব পালন' বলতে নারাজ বেশিরভাগ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ।
সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজার মতো হাতেগোণা কয়েকজন ছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটার দলে জায়গা পোক্ত করতে সময় নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর করে। লিটন কুমার দাস, নাজমুল হোসেন শান্তর মতো সম্ভাবনাময় ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে সাত-আট বছর ধরে খেলার পরও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, এখনও দায়িত্ব নেওয়া শিখে ওঠেননি তারা। আবার সম্ভাবনার ঝলমলে বাতি জ্বেলে জাতীয় দলে পা রাখা সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকারদের মতো ক্রিকেটাররা তো এক প্রকার হারিয়েই গেছেন।
বেশিরভাগ টুর্নামেন্টে এখনও বাংলাদেশের ভরসা অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাই, কদিন আগে পর্দা নামা বিশ্বকাপই তার বড় প্রমাণ। চরম হতাশার বিশ্ব আসরে একমাত্র মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বলার মতো পারফরম্যান্স করেছেন। ৮ ম্যাচে একটি করে সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরিসহ ৫৪.৬৬ গড়ে ৩২৮ রান করা অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। লিটন ও শান্ত যে যথাক্রমে দুই ও তিন নম্বরে আছেন, সেটা বাকিদের অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সের কারণে। মাহমুদউল্লাহ ছাড়া বাংলাদেশের কেউই ৩২- এর বেশি গড়ে রান করতে পারেননি। বল হাতে অভিজ্ঞ কেউ পথ দেখাতে পারেননি, বিবর্ণ থেকে গেছেন বাকি সবাই। মাত্র দুই জয়ে বিশ্বকাপ শেষ করে বাংলাদেশ।
বছরের পর বছর জাতীয় দলের হয়ে পথ চলেও 'নতুন' বা 'তরুণ'- এর ট্যাগ গায়ে জড়িয়ে খেলে যাওয়া ক্রিকেটাররা দায়িত্ব নিতে পারেন না কেন? বাংলাদেশ ক্রিকেটে ধাঁধার মতো এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। বিষয়টি নিয়ে টিবিএসের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের দুই প্রবীণ কোচ সারওয়ার ইমরান ও নাজমুল আবেদীন ফাহিম। জাতীয় দলে নতুন ক্রিকেটারদের দায়িত্ব না নিতে পারার কারণ হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটের দৈন্যদশার কথা জানিয়েছেন তারা। মানের দিক থেকে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে যে ব্যবধান, সেটার কারণেই জাতীয় দলে থিতু হতে ক্রিকেটারদের লম্বা লেগে যায় বলে মত তাদের।
অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করাসহ বিভিন্ন মেয়াদে জাতীয় দল ও ঘরোয়া ক্লাবগুলোতে কোচিং করানো সারওয়ার ইমরান বলেন, 'ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে ক্রিকেটার তৈরি হয়। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান খুবই নিচের দিকে, আম্পায়ারিংয়ের মান খারাপ। অনেক কিছুই খারাপ। ঘরোয়া ক্রিকেট কীভাবে হয়, আমরা জানি। আমাদের জাতীয় লিগ হয় এভাবে যে, নির্বাচকরা ঠিক করে দেন ও এই দলে খেলবে, এ ওই দলে খেলবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০০ রানও হয় না সহজে চারদিনের খেলায়। এই ব্যাপারগুলো দেখতে হবে।'
'ভারত বা অস্ট্রেলিয়ায় একজন ক্রিকেটার অনূর্ধ্ব-১৯ এর পরে দুই-তিন বছর অনূ-২০ খেলে, ওখানে অনেক রান করে। কয়েকশ চারদিন, কয়েকশ একদিনের ম্যাচ খেলে কয়েক বছরে। তারপরে ওরা জাতীয় দলে জায়গা পায়। আমাদের এখানে সরাসরি অনূ-১৯ থেকে আসছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের অনেক গ্যাপ। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গ্যাপ অল্প বা অস্ট্রেলিয়ায় কোনো গ্যাপই নেই। আমাদের এখানে অনেক গ্যাপ, সেই জন্য জাতীয় দলে গিয়ে আমাদের ক্রিকেটারদের তিন-চার বছর লেগে যায় সেট হতে। কেউ পারে সেট হতে, আবার কেউ পারে না।' যোগ করেন তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে শক্ত ভিত্তি পান না বলেই জাতীয় দলে গিয়ে ক্রিকেটারদের ধুঁকতে হয় জানিয়ে সারওয়ার আরও বলেন, 'ভিত্তিটা শক্ত নিয়ে যায় না আমাদের ক্রিকেটাররা। এই জায়গাটা ঠিক করতে হবে। আমাদের ক্যাম্প হয়, বগুড়া বা কোথাও যায়, নিজেরা নিজেরা অনুশীলন ম্যাচ খেলে, তারপর ক্যাম্প শেষ। এভাবে তো হয় না। আমাদের যখন টাকা ছিল না, তখন অনূ-১৯, এইচপি দল বিদেশ সফর করতো। এখন অনেক টাকা, এখন কেন হয় না এগুলো! ২০০৪-০৫ এ আমাদের এইচপি দল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া গেছে, অনূ-১৯ দল শ্রীলঙ্কায় সফর করেছে। এখন আমাদের এসব নেই।'
দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা ও বিকেএসপির সাবেক প্রধান ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীনের মতও এমন, তবে ক্রিকেটারদের দায়ও দেখেন তিনি। চেষ্টার ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের স্ট্যান্ডার্ডের ওপর নির্ভর করবে আমি নিজেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারব। তারপর যখন কঠিন স্কুলের যাব, সেটা তো চ্যালেঞ্জ হবেই। এর পাশাপাশি আমার মনে হয়, নিজে থেকেও দায়িত্ব নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। একজন ক্রিকেটার কী স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন অনুযায়ী তাকে কোথায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে, সেটাও তার বোঝা উচিত। সেখানকার জন্য নিজেকে আলাদা করে কীভাবে প্রস্তুত করবে, সেটাও দেখা উচিত।'
নিজেকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে উদাহরণ হিসেবে টানলেন নাজমুল আবেদীন। বললেন, 'আমরা মাহমুদউল্লাহর উদাহরণ দিতে পারি, বিশ্বকাপের আগে সে ছয় মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি। সে সারা জীবন যে ক্রিকেট খেলে এসেছে, এখন কিন্তু সেই ক্রিকেট খেলছে না। তার খেলার মধ্যে অনেক উন্নতি এসেছে। যেভাবে স্ট্রোক প্লে করছে, গিয়েই ব্যাটে-বলে হচ্ছে, এগুলো আগে এমন ছিল না। অনেক সময় নিয়ে খেলতো সে। তো নিজে থেকে চেষ্টা করেছে বলেই এই পরিবর্তন এসেছে এবং ক্যারিয়ারের একদম শেষে এসে ও এটা করতে পেরেছে। কারণ ওর মধ্যে সেই চেষ্টাটা ছিল।'
'কী স্বপ্ন দেখি' এটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন। এ পথে বিসিবি ঠিকভাবে ক্রিকেটারদের স্বপ্ন দেখাতে পারছে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'জাতীয় দলে জায়গা পাওয়াটাই অনেকের কাছে শেষ কথা হয়ে যায়। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়, কাজটা আসলে শুরু হওয়া। এরপর যে পরীক্ষাটা দিতে হবে, সেটার প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা সচেষ্ট না। আমরা অনেকে সন্তুষ্ট হয়ে যাই, এটা একটা বড় কারণ। আর স্বপ্ন দেখানোটা ম্যানেজমেন্টের কাজ। স্বপ্ন দেখানো এবং সেসব পূরণ করার জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখা তাদের কাজ। শুধু স্বপ্ন দেখালেই হবে না, স্বপ্ন দেখতে গেলে ক্রিকেটারকে আনুসঙ্গিক যা করতে হবে, সেই পরিবেশ তৈরি করে দেওয়াই ম্যানেজমেন্টের কাজ। ১০ জন থেকে দুই জনের মধ্যে যদি স্বপ্নের বীজটা বোনা যায়, তারাই কিন্তু বেরিয়ে আসবে। কতো বড় স্বপ্ন দেখে, সেটার ওপর নির্ভর করে সে কতোদূরে যাবে।'