‘আমাকে যখনই অধিনায়কত্ব দিক, আমি প্রস্তুত আছি’
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই তিনি তারকা। বলা হতো, বাংলাদেশের আগামী সাকিব আল হাসান হবেন মেহেদী হাসান মিরাজ। অল্প বয়সেই নেতৃত্বে বলীয়ান বাংলাদেশের ডানহাতি এই অলরাউন্ডার এখন জাতীয় দলের যেকোনো ফরম্যাটেই 'অটো চয়েজ'। ২০১৬ সালে হইচই ফেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু করা মিরাজ জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেছেন আট বছর। নিজেকে নিয়ে দলের অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবিচল থাকা ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার। যখনই দেওয়া হোক এই গুরুদায়িত্ব, প্রস্তুত থাকবেন মিরাজ।
ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ে টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলা মিরাজ উন্নতি করেছেন টি-টোয়েন্টিতেও। বিসিবির বর্তমান কেন্দ্রীর চুক্তির তিন ফরম্যাটেই জায়গা হয়েছে তার। চলমান বিপিএলে ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলা মিরাজ ১৫৪.৫৪ স্ট্রাইক রেটে ১১৯ রান করেছেন, ৬.৮০ ইকোনমিতে উইকেট নিয়েছেন ১০টি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলে নিজের ভূমিকা, অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবনা, অলরাউন্ডার রূপে ফিরে আসা, পাওয়ার হিটিং, স্পিনার হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের অবস্থানসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: লিগ পর্ব পেরিয়ে প্লেঅফ, এখানে এলিমিনেটর জিতে ফাইনালে দৌড়ে টিকে আছে আপনাদের দল। সব মিলিয়ে কেমন লাগছে বিপএল?
মেহেদী হাসান মিরাজ: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো লাগছে। প্রথম দিকে আমাদের অবস্থা খারাপ ছিল। প্রথম চার ম্যাচে মাত্র একটা জিতি। পরে নিয়মিত জিতেছি আমরা। এলিমিনেটর জিতলাম, আরেকটা ম্যাচ জিততে পারলে ফাইনাল। আর দুটি ম্যাচ জিতে পারলে চ্যাম্পিয়ন। এখন প্রতিটা ম্যাচই চ্যালেঞ্জিং।
টিবিএস: ৯ ইনিংসে ১১৯ রান ও ১১ ইনিংসে ১০ উইকেট, নিজের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট?
মিরাজ: ব্যাটিংয়ে আরও একটু ভালো করলে ভালো হতো। দুই-তিনটি ম্যাচে উপরে সুযোগ পেয়েছিলাম, সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। এ ছাড়া পরের দিকে ব্যাটিং করেছি, পরের দিকে নেমে বড় রান করার সুযোগ থাকে না। কারণ বল থাকে কম। ওখানে দলের প্রয়োজনে অল্প বলে ১০, ২০, ৩০ রান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম দুই-তিনটা ইনিংস খেলেছি, এটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। খুলনার বিপক্ষে ১৫ বলে ৩১ রান করে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলকে জিতিয়েছি। এই অবদানগুলো ভালো লেগেছে। বোলিং নিয়ে আমি অনেক খুশি। কারণ, টি-টোয়েন্টিতে আমি যেভাবে বোলিং করতে যাচ্ছি, সেভাবে হচ্ছে। হয়তো বেশি উইকেট পাইনি, প্রায় ম্যাচের সমান উইকেট পেয়েছি। কিন্তু ইকোনমির দিক থেকে দেখে নিজের কাছে ভালো লাগছে। আর টি-টোয়েন্টিতে বোলিংয়ে আমার মাইন্ড সেটআপ এখন ভালো, এই জন্য ভালো লাগছে।
টিবিএস: ব্যাটিং নিয়ে আফসোস থাকলেও বোলিং নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট। দলের চাওয়া কি পূরণ হচ্ছে আপনার কাছ থেকে?
মিরাজ: দল যেভাবে চাচ্ছে, আমি সে রকম চেষ্টা করছি। আমি সাত নম্বরে ব্যাটিং করছি, দল চাচ্ছে ওখানে নেমে যেন ১০ বলে ২০-২৫ রান করতে পারি। এমন গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলা আবার বোলিংয়ে ২-১ উইকেট নেওয়া, দলের চাওয়া এমনই থাকে। দলের প্রয়োজনে খেলছি, যতোটুকু চাচ্ছে, শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। খুশি আছে দল আমাকে নিয়ে।
টিবিএস: শুরুতে বড় স্কোর গড়েও হেরেছে বরিশাল, ওই সময়ে ঠিক কোথায় সমস্যা হচ্ছিল?
মিরাজ: ওই সময়ে আমরা কিন্তু বড় রানই করেছি প্রায় সব ম্যাচে। ব্যাটসম্যানদের সসস্যা নয়, তখন আমাদের সমস্যা ছিল বোলার। কারণ আমাদের ডেথ বোলার ছিল না, পেস বোলিং বিভাগ ওই রকম শক্তিশালী ছিল না। এই জন্য সমস্যা হয়েছে। আমাদের এমনও হয়েছে, ৪ ওভারে আমরা ৬৫ রান দিয়েছি। ওই সময়ে ডেথ বোলিং খুব খারাপ ছিল, আমাদের ডেথ বোলার ছিল না। এখন দুজন বোলার আসায় আমাদের শেষের চার ওভারে চিন্তা নেই। সাইফউদ্দিন ফেরায় ডেথ বোলিং অনেক শক্ত হয়েছে। ওবেদ ম্যাকয় থাকাতেও ডেথ বোলিং ভালো হয়েছে। আমরা স্থানীয় যারা আছি, তাইজুল ভাই ভালো করছেন, পাশাপাশি আমি সাপোর্ট দিচ্ছি। যেই খেলছে, অবদান রাখছে। তবে আমার কাছে মনে হয়, সাইফউদ্দিন ফেরায় আমাদের দলের পেস বোলিং বিভাগটা অনেক ভালো হয়েছে, ভারসাম্য এসেছে।
টিবিএস: এক ম্যাচে আপনি বলেছিলেন, মাঝের ব্যাটিংয়ের কারণে হেরেছেন। আপনার বক্তব্যে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
মিরাজ: প্রতিক্রিয়া ছিল না, আমরা সবাই জানি নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে। আমাদের ওপর দলের প্রত্যাশা আছে, আমাদের দলে বিগ বাজেটের খেলোয়াড় আছে। সবাই অভিজ্ঞ, তাই রেপুটেশনের জন্য হলেও খারাপ লাগে যে, যদি আমরা দেখি জিততে পারছি না, প্রথম দিকে টানা হারছি, ভালো খেলছি না। এটা রেপুটেশনের জন্য অনেক খারাপ, কারণ সবাই অভিজ্ঞ, অনেক দিন সার্ভিস দেওয়া খেলোয়াড়। বিপিএলে সম্ভবত আমাদের দলটা সবচেয়ে অভিজ্ঞ। প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগছিল, এখন ঠিক আছে। এখন একটা অবস্থায় চলে এসেছে, সবাই সবার ভূমিকা ভালোভাবে বোঝে। এখন শুধু ভালো খেলেটা গুরুত্বপূর্ণ।
টিবিএস: আর একটা ম্যাচ জিতলেই ফাইনাল, কতোটা আশাবাদী?
মিরাজ: অনেক আগে থেকেই ফাইনাল খেলার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আমি এই স্বপ্ন দেখি। এটা আমি অনেক আগে থেকেই বলছিলাম। যখন টানা তিন ম্যাচ হেরেছি, চার ম্যাচে একটি জিতেছি, তখনই আমি বলতাম, 'এই দল ফাইনাল খেলবে। আমাদের সেই সামর্থ্য আছে।' এসব নিয়ে দলের সবার সঙ্গে কথা বলতাম। ফাইনাল খেলার সামর্থ্য আমাদের আছে। সবারই দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা চ্যাম্পিয়ন হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
টিবিএস: আপনাদের অধিনায়ক তামিম ইকবাল বলেছিলেন, এবারের বিপিএলে আপনাকে অধিনায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কতোটা শিখতে পেরেছেন?
মিরাজ: মাঠে প্রতিনিয়ত দেখি, শিখি। চাপের মুহূর্তে কীভাবে সামলাতে হয়। এসব দেখছি, শিখছি। ভালো লাগে। দলে তামিম ভাই, মুশফিক ভাই আছেন, তারা দল পরিচালনা করছেন। রিয়াদ ভাই আছেন, তিনি সাপোর্ট দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে তাদের সমন্বয় খুব ভালো লাগছে, দেখছি। যতো খেলব, যতো দেখব, ততো শিখব।
টিবিএস: বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
মিরাজ: জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার স্বপ্ন সবাই দেখে, কে না দেখে! সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে নেতৃত্ব দেবে। তবে ক্রিকেট বোর্ড যেটা ভালো মনে করে, তারা সেটাই করবে। আমাদের মধ্য থেকে নেতা তৈরি হচ্ছে, এটা ইতিবাচক দিক। শান্তকে (নাজমুল হোসেন শান্ত) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ওর জন্য অনেক শুভ কামনা। ও আমার বন্ধু, সতীর্থ; আমরা বয়সভিত্তিকে একসঙ্গে খেলেছি। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে, আমাদের লক্ষ্য থাকবে আমরা যেন একটা দল তৈরি করতে পারি, যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের বড় ভাইরা দীর্ঘদিন দলকে সেবা দিয়েছেন, একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন। তো শান্ত, লিটন, মুস্তাফিজ, আমরা যারা আছি; আমাদের দায়িত্ব বাংলাদেশকে আরেকটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। সবার সহযোগিতা না পেলে একজন অধিনায়কের জন্য অনেক কঠিন হয়। শান্ত অধিনায়ক হয়েছে, আমরা যদি ওকে সমর্থন করি, ওর জন্য সহজ হবে। আর দিনশেষে আমরা তো দেশের জন্যই খেলছি। দলে একজনই অধিনায়ক হয়, দায়িত্ব অনেক বেশি থাকে। হারলে খারাপ লাগে, অনেক কিছু সামলাতে হয়। ওই সময়ে সমর্থন দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। সবাই সমর্থন দিলে দলের কাছে সবাই অধিনায়ক হতে পারে।
টিবিএস: বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আপনার নেতৃত্বে খেলেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপর আপনি জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে নিজের অবস্থান পোক্ত করে নেন। এমন জায়গা তৈরি করতে শান্তকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। পারফরম্যান্সের কারণে অনেক সমালোচনা, ট্রল হজম করতে হয়েছে তাকে। সময়ের পালাবদলে শান্ত এখন তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের অধিনায়ক। নেতৃত্বের এই জায়গাটি আপনারও হতে পারতো কিনা?
মিরাজ: এটা আসলে পুরোপুরি বোর্ডের ব্যাপার, তাদের সিদ্ধান্ত। তারা যেটা ভালো মনে করে, সেটাই করে। আমি অনূর্ধ্ব-১৫, ১৭, ১৯ পর্যায়ে অধিনায়কত্ব করেছি। সব পর্যায়েই ভালো করার চেষ্টা করেছি আমি। শেষ কয়েকটি সিরিজে শান্ত ভালো করেছে, বিশ্বকাপে করেছে, নিউজিল্যান্ডেও ভালো করেছে; এ কারণে হয়তো বোর্ড শান্তকে যোগ্য মনে করেছে, তাই দিয়েছে। আমরা খেলোয়াড়, দেশের জন্য খেলি। মাঠে একজন অধিনায়ক থাকতে হয়, এটা ঠিক করে ক্রিকেট বোর্ড। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কখনও এমন সুযোগ আসে (অধিনায়কত্ব), তখন দেখা যাবে। এখন এসব নিয়ে চিন্তা করছি না।
টিবিএস: নেতৃত্ব পাওয়ার আগে কয়েক দফায় শান্ত বলেছেন, বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত তিনি। একই দায়িত্ব পালনে আপনি কতোটা প্রস্তুত?
মিরাজ: একজন নতুন খেলোয়াড়কে হঠাৎ করে আপনি জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব দিতে পারবেন না। অভিজ্ঞ হলে বা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারলে অধিনায়কত্ব পাওয়া যায়। আমি আট বছর জাতীয় দলে খেলেছি, আমি সব সময় চেষ্টা করেছি দেশের হয়ে ভালো খেলার। চেষ্টা করেছি নিজেকে তৈরি করার। আট বছর যেহেতু খেলেছি, অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও হয়েছে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অধিনায়কত্ব করেছি, অভিজ্ঞতা আছে আমার। আমাকে যখনই অধিনায়কত্ব দেবে, আমি প্রস্তুত আছি। হঠাৎ দিয়ে দিলে আমি প্রস্তুত থাকব না, এমন না। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছি, জাতীয় দলে আট বছর খেলেছি, তো যখন সময় আসবে, আমার মনে হয় আমি খুব ভালোভাবে প্রস্তুত থাকব। যখনই দিক, আমি প্রস্তুত থাকব। প্রথম দিকে দিলে অনেক কঠিন হতো। দুই-এক বছর পর আমাকে দায়িত্ব দিলে সেটা আমার জন্য কঠিন হতো, চাপ হতো। মনে হয় না সেভাবে মানিয়ে নিতে পারতাম। এখন তো অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখন দিলে আমি সামলাতে পারব।
টিবিএস: অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় পর্যন্ত অলরাউন্ডার থাকলেও জাতীয় দলে বোলার হয়ে উঠেছিলেন। আবার অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে সময় লেগেছে আপনার। অলরাউন্ডার রূপে ফেরার লড়াইটা কেমন ছিল?
মিরাজ: ২০১৬ সালে আমার অভিষেক হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার ৬ মাস পরে আমার অভিষেক। অনূ-১৯ আর জাতীয় দলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। আমি একটা ব্যাপার অনুধাবন করেছি যে, আমি যদি 'এ' দল বা হাই পারফরম্যান্সে খেলতাম, আরও দুই-এক বছর খেলে পাকাপোক্তভাবে ব্যাটিং করতাম, তখন আমি ব্যাটিং বুঝতে পারতাম। সত্যি বলতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুর দিকে আমি যখন ব্যাটিং করি, তখন আমি অনেক কিছুই বুঝতাম না। কারণ আমার ওই অভিজ্ঞতা ছিল না। অনূ-১৯ আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আকাশ-পাতালের মতো। হঠাৎ করে জাতীয় দলে আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। বোলার হিসেবে মানিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে কঠিন। এ জন্য আমার মনে হয় বয়সভিত্তিক পার করে অনেক পাকাপোক্ত হয়ে জাতীয় এলে তার জন্য সহজ হয়। যেটা তাওহিদ হৃদয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। সে অনূ-১৯ এর পর দুই-এক বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেছে, বিপিএলে পারফর্ম করেছে, তারপর জাতীয় দলে এসেছে। ওর জন্য সহজ হয়েছে, জাতীয় দলে পারফর্ম করছে। প্রতিটা ব্যাটসম্যানের এভাবে তৈরি হয়ে আসাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রস্তুত হয়ে জাতীয় দলে আসতে পারিনি। তখন বোলার হিসেবে আমার অভিষেক হয়, বোলার হিসেবেই সবাই আমাকে বিবেচনা করেছে, বোলার বলেছে। তখন নিজের কাছেও মনে হয়েছে, 'আমি হয়তো বোলার, আমি ব্যাটিং করতে পারি না।' এরপর দিনে দিনে উন্নতি করার চেষ্টা করেছি। চিন্তা করেছি, শুধু বোলিং নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। যেহেতু আমি ব্যাটিং পারি, তাহলে এটা নিয়ে কাজ করলে আমার জন্য সহজ হবে। মনে হয়েছে, আমি যদি দুটিতেই ভালো করতে পারি, জাতীয় দলে আমার পথটা সহজ হবে। এরপর কাজ করা শুরু করি।
টিবিএস: ব্যাটিং নিয়ে কীভাবে কাজ করেছেন, কোন কোন জায়গায় কাজ করেছেন?
মিরাজ: ব্যাটিং নিয়ে আমার প্রায় সব জায়গাতেই কাজ করতে হয়েছে। গত তিন-চার বছরের ব্যাটিং নিয়ে আমি খুশি। যতোটুকু অবদান রাখতে পেরেছি, এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। কষ্টের ফল আমি পেয়েছি, পাচ্ছি।
টিবিএস: পাওয়ার হিটিং নিয়ে কাজ করেছেন আপনি। কার সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?
মিরাজ: পাওয়ার হিটিংয়ে ব্যাটসম্যানের ভারসাম্য রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শটই থাকে, এখানে পুলটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি পুলে একটু দুর্বল ছিলাম। আমি কাজ করেছি এটা নিয়ে, ওই জোনে বল পেলে এখন আমি সুন্দরভাবে ছক্কা মারতে পারি। আগে হয়তো আউট হয়ে যেতাম। এটার জন্য অনেক অনুশীলন করতে হয়েছে। বল থ্রো করে, মেশিনে সেট করে অনুশীলন করেছি। এটা অল্প সময়ে সম্ভব হয়নি। বিপিএলের আগে আমি বাবুল স্যারের (মিজানুর রহমান বাবুল, ফরচুন বরিশালের কোচ) সাথে পাওয়ার হিটিং নিয়ে কাজ করেছি। স্যার আমাকে বেশ কিছু ব্যাপারে দেখিয়ে দিয়েছেন। ভালো লেগেছিল স্যারের টেকনিকগুলো।
টিবিএস: বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকজন পাওয়ার হিটিং করতে পারেন। বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন পাওয়ার হিটিং করতে পারেন না?
মিরাজ: বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা পারেন না, এমন নয়। পাওয়ার হিটিং করতে পারা ব্যাটসম্যান আছে আমাদের। তাওহিদ হৃদয় বড় বড় ছক্কা মারতে পারে। এটায় উন্নতি করতে আমাদের টেকনিক উন্নত করতে হবে। কীভাবে পাওয়ার জেনারেট করতে হয়, সেটা জানতে হবে। স্কিলের ছোট ছোট জায়গা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের খেলোয়াড়দের হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে কাজ করাতে হবে। আমাদের দেশি কয়েকজন কোচের মধ্যে এই গুণ আছে যে, তারা আমাদের খেলোয়াড়দের শেখাতে পারেন। তারা সময় নিয়ে কাজ করলে পাওয়ার হিটিংয়ে উন্নতি হবে। বিশেষ করে সোহেল স্যার (সোহেল ইসলাম) আমাদের কয়েকজন ব্যাটসম্যান নিয়ে কাজ করেছেন আমি যতোটুকু জানি। হৃদয়, শান্তসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে কাজ করেছেন। উন্নতি হয়েছে তাদের।
টিবিএস: গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বা এর আগে থেকে আপনার ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সমর্থ বলে আপনার কাছে দলের বেশি চাওয়া? এটাকে চাপ হিসেবে দেখেন নাকি উপভোগ করেন?
মিরাজ: আমাকে যখনই যেখানে খেলতে বলা হয়েছে, আমি রাজি হয়েছি। আমি যদি না করতাম, তাহলে কিন্তু জোর করে আমার ওপর চাপিয়ে দিতো না। আমি কাউকে দোষ দিবো না। যখন আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, আমি রাজি হয়েছি, বলেছি 'আমি রাজি আছি'। আমি নিজে থেকে বলেছি, তাই সুযোগটা আমাকে করে দেওয়া হয়েছে। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি বলে আমাকে নিয়ে সবার আস্থা বেড়েছে যে, আমাকে যেকোনো জায়গায় খেলাতে পারবে। আমাকে সমর্থ মনে করেছে। এখানে ইতিবাচক, নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, উপরে ব্যাটিং করে আমি রান করি, এটা দলের জন্য ভালো। নেতিবাচক দিক হচ্ছে, জেনুইন ব্যাটসম্যানকেও ব্যাটিং করতে হবে আট নম্বরে বা শেষের দিকে। বিশ্বকাপে এমন গেছে। এশিয়া কাপে আমি সেঞ্চুরি করার ফলে এসব সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচসহ দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে রান করেছি। হয়তো এ কারণে দলের আস্থা ছিল যে, আমি উপরে ব্যাটিং করলে ভালো হবে।
টিবিএস: নির্দিষ্ট ব্যাটিং অর্ডার না দিয়ে এভাবে পরিবর্তন করিয়ে খেলালে ব্যাটসম্যানের কি মনোযোগ নষ্ট হয়, আত্মবিশ্বাসে টান পড়ে? কখনও এমন অনুভব করেছেন?
মিরাজ: কোচ, অধিনায়ক কখনই দলের খারাপ চান না। তারা অবশ্যই ভালো চান। দলের প্রয়োজনে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটিং করানো হয়েছে। এটা দলের ভালোর জন্যই করেছেন। অনেক সময় ক্ষতি হয় খেলোয়াড়ের, কিন্তু আমরাও তো বলি দল আগে। দলের ফলের জন্য অনেক সময় ত্যাগ করতে হয়, সবাইকেই। তবে হ্যাঁ, একটা চাপ তো কাজ করেই। সবাই এটা মানিয়ে নিতে পারে না। যেহেতু আমি এটা করে এসেছি, তাই সবাই হয়তো আমাকেই বেছে নিতে বলে।
টিবিএস: টেস্ট দিয়ে শুরু, পরে ওয়ানডে দলে; এখন আপনি টি-টোয়েন্টিতেও নিয়মিত। তিন ফরম্যাটেই জায়গা শক্ত করে নেওয়ার সফরটা কেমন ছিল, নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছেন?
মিরাজ: টেস্ট দিয়ে আমার শুরু, তখন আমার লক্ষ্য ছিল পারফরম্যান্স দিয়ে কীভাবে টেস্ট দলে জায়গা শক্ত করা যায়। তিনটা জায়গায় একসঙ্গে অবস্থান তৈরি করা সম্ভব না। আর এই যুগে সেটা আরও কঠিন। আগে যেটা হতো, এক ফরম্যাটে ভালো খেললে বাকি দুই ফরম্যাটেও হয়তো কারও কারও সুযোগ হতো। এখন তেমন না, আলাদা আলাদা ভূমিকায় ক্রিকেটারকে খেলানো হয়। এমনকি দলই তো আলাদা আলাদা হয়। পারফর্ম করেও দলে জায়গা হচ্ছে না, এমনও হয়। পাঁচ উইকেট পেলেও ভাবতে পারবেন না যে আপনার জায়গা ঠিক আছে। পরের দুই ম্যাচে খারাপ করলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয় জায়গা শক্ত করা নিয়ে। এটা ভালো দিক, প্রতিযোগিতা থাকে। শুরুতে টেস্ট দলে অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছি, কখনও চিন্তা করিনি ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি খেলতে হবে। পরিকল্পনা ছিল টেস্টে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব, তবে আমাকে যেন কেউ টেস্ট খেলোয়াড় না বলেন। যেন টেস্টের সিল না দিয়ে দেয় গায়ে, ওয়ানডেতেও যেন ভালো খেলতে পারি। এটাও মাথায় ছিল। যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন আমার মাথায় এটা কাজ করেছে যে, আমাকে যেন টেস্ট বোলার না বলা হয়। এটা আমি কখনও চাইনি, ওভাবে আমি আমার মেন্টাল সেটআপ দিয়েছি। একইভাবে টি-টোয়েন্টিতেও ভালো করার চেষ্টা করেছি। যদিও বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি, তবে সেরা চেষ্টাই করেছি। এখানেও একই মাইন্ড সেটআট ছিল। আর ক্রিকেটে এটা জরুরি, ক্রিকেট তো এমনই খেলা। মাথা যেভাবে বলবে, আপনার শরীর সেভাবে সাড়া দেবে।
টিবিএস: আধুনিক ক্রিকেটে স্পিনার হিসেবে নিজের অবস্থান কোথায় দেখেন?
মিরাজ: আমি রিস্ট স্পিনার নই, হয়তো বোলিংয়ে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই, আমি হয়তো দুসরা করতে পারি না। আমার যে সীমাবদ্ধ স্কিল আছে, আমি এটার মধ্যেই থাকার চেষ্টা করি। আমি আমার সামর্থ্য সম্পর্কে জানি। এটা আমার শক্তি ও বিশ্বাসের জায়গা। আমি জানি, কতোটুকু করলে আমার জন্য ভালো হবে বা কতোটুকু পারব। আমি সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে অনেক কিছু করার চেষ্টা করি না। পারব না, এমন কিছু করার চেষ্টা করি না। আমি যে ফরম্যাটেই খেলি না কেন, আত্মবিশ্বাস জরুরি। উত্থান-পতন থাকেই, পারফরম্যান্স খারাপ-ভালো থাকবে। তবে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি যে, বোলিংয়ে নিজের সামর্থ্যের পুরোটা যেন দিতে পারি। অনেক সময় হয় না, সেটা ঠিক আছে। কারণ আমি তো চেষ্টা করেছি। সব সময়ই আমি আমার সামর্থ্যের মধ্যে থেকে পারফর্ম করার চেষ্টা করি।