বিপিএলের দলগুলো ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারেনি কেন
আইপিএলের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, চেন্নাই সুপার কিংস, কলকাতা নাইট রাইডার্স অথবা বিগ ব্যাশের মেলবোর্ন রেনেগেডস, ব্রিসবেন হিট, সিডনি সিক্সার্স; প্রতিটা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলই একেকটি ব্র্যান্ড। ফুটবল ক্লাবগুলোর মতো ক্রিকেট আঙিনায় স্বদর্পে পথচলা তাদের। ক্লাবগুলোর বাজারমূল্যও আকাশছোঁয়া। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট হয়েও দীর্ঘ ১২ বছরে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) থেকে সেভাবে কোনো ব্র্যান্ড দাঁড়ায়নি। উল্লেখ করার মতো নাম কেবল দুটি; কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স বা রংপুর রাইডার্স। বাকি দলগুলো আসরটিতে যেন অতিথি, তাদের বাজারমূল্য গড়পড়তা মানের। তাই হাতে হাতে ঘোরে দলগুলোর মালিকানা, বারবার বদলে যায় নাম।
অথচ বিদেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ, ক্রিকেটার কিনতে অর্থের ঝনঝনানি, চ্যাম্পিয়নশিপ প্রাইজমানি, সম্প্রচারের মান; সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া লিগ বিপিএল। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম আসর দিয়ে তাক লাকিয়ে দেয় আয়োজকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজি সত্ত্ব পাওয়ার লড়াই, ক্রিকেটারদের নিলাম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও ছিল বিশ্ব মানের।
কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে মানে ভাটা পড়েছে, রং হারিয়েছে বিপিএল। ১০টি আসর ও এক যুগ পরও বিপিএল পড়ে আছে সেই তিমিরেই। ১২ বছরেও বড় হতে পারেনি বিপিএল, বড় হয়ে ওঠেনি অংশ নেওয়া দলগুলোও। উল্টো ফিক্সিংয়ের থাবায় বন্ধ থেকেছে আসরটি, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বকেয়াসহ নানা বিতর্কে জড়িয়েছে বিপিএলের নাম।
দলগুলোর ব্র্যান্ড না হয়ে ওঠার অন্যতম এবং প্রধানতম কারণ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় অংশ নেওয়া দলগুলো দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা সাজাতে পারে না। অনেকেই মালিকানা কিনলেও পরের বছরই বিপিএল ছেড়ে গেছে। পরের বছর অন্য মালিকানায় অন্য নামে এসেছে পুরনো সেই দলটিই।
বিপিএলে নিজেদের শুরুর আসর থেকে এখন পর্যন্ত নাম বদল করেনি কেবল দুটি দল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ও রংপুর রাইরার্স। মালিকানার বদলে বাকি দলগুলোর নাম একাধিকবার পাল্টেছে। ২০২৩ সালে তিন বছর মেয়াদী চুক্তি করা হলেও সেটা পরিকল্পনার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকই।
সিলেট দলটির কথাই বলা যাক। প্রথম আসরে তারা সিলেট রয়্যালস নামে খেলে। পরেরবার এই নাম থাকলেও হাত বদলে তৃতীয় আসরে দলটির নাম হয়ে যায় সিলেট সুপার স্টার্স। পরেরবার সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানাই নেয়নি কেউ। সর্বশেষ আসরে সিলেট স্ট্রাইকার্স নামে খেলা দলটি মাঝে খেলেছে সিলেট সিক্সার্স, সিলেট থান্ডার, সিলেট সানরাইজার্স নামে।
বারবার নাম বদলেছে ঢাকার। দলটি বিপিএলে খেলেছে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, ঢাকা প্লাটুন, দুর্দান্ত ঢাকা নামে। দুরন্ত রাজশাহী পরবর্তীতে হয় রাজশাহী রয়্যালস, শেষ দুই আসরে রাজশাহী ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রিই হয়নি। একইভাবে বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামের নামও পাল্টেছে একাধিকবার।
প্রতিবারই নামের পরিবর্তন হয়েছে মালিকানা বদলের কারণে। মালিকানার বদলে নাম বদল, তাই প্রতিবারই নতুন দল। এ কারণেই বিপিএলে ব্র্যান্ড গড়ে ওঠেনি বলে মনে করেন স্থানীয় দুই প্রবীণ কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও সারওয়ার ইমরান। বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের সাবেক কোচ ও বিকেএসপির সাবেক প্রধান ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একেবারে দাঁড়ায়নি, সেটা বলব না। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স, রংপুর রাইডার্স ব্র্যান্ড। তবে দল অনুযায়ী সংখ্যাটা কম। আমরা তো এখনও কোনো দলকে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারিনি। প্রতিটা দলই জানে এ বছরই তার শেষ বছর, পরের বছর আবার নতুন করে চুক্তি করতে হয়। পরের বছর চুক্তি হবে কিনা, এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও থাকতে হয় অনেক সময়। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ, পরিকল্পনা সাজিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না।'
'বছরব্যাপী কার্যক্রম করার কোনো সুযোগ নেই, নিজের দল বা টুর্নামেন্টকে প্রমোট করার সুযোগ নেই। 'অনেক সুযোগ নেই'-এর মধ্য দিয়েই কিন্তু দলগুলোকে খেলতে হচ্ছে। ব্র্যান্ড না দাঁড়ানোর এটা অবশ্যই বড় কারণ। আর্থিক মডেলও কারণ হতে পারে, তবে মূল কারণ নয়। আমরা যদি দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিতে নিয়ে আসতে পারি, দলগুলো নিজেদের স্বার্থে তাদের গোছানোর চেষ্টা করবে। বিনিয়োগ করবে যে আমি পাঁচ বছর পরে এমন একটি জায়গায় যেতে চাই। তেমন হলে শুরু থেকেই দল গড়া, সুযোগ-সুবিধা, ম্যানেজমেন্ট গড়ে তোলার ব্যাপার থাকে। এখন সেভাবে গড়ে ওঠার চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না। প্রতিষ্ঠিত দলকে বলতে শুনি, সামনের বছর থেকে আর থাকবো না।' যোগ করেন তিনি।
লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে ধারণা নেই নাজমুল আবেদীনের। তার মতে, নিশ্চয়ই কোথাও সমস্যা আছে। পৌঢ় এই কোচ বলেন, 'দলের দিক থেকে যেভাবে ইনভলভমেন্ট থাকা দরকার, সেভাবে তারা করতে পারছে না। জানি না, লম্বা চুক্তি না হওয়ার কারণ কী, বাধা কী। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে, যে কারণে বোর্ড হয়তো পারছে না। তবে এটা না করলে কিন্তু ব্র্যান্ড পাওয়া যাবে না। হোম-অ্যাওয়ে ম্যাচ, ভালো উইকেট, খেলোয়াড় আনা; এসব বিষয় সমাধান করা যায়।
'কিন্তু ওই জায়গাটা যদি আমরা সমাধান না করতে পারি, ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলো অনুপ্রাণিত হবে না, আমরা ব্র্যান্ড পাবো না। মালিকানা ও নাম বদলে এটা সম্ভব হচ্ছে না। পরের বছর খেলবে, সেই নিশ্চয়তাই নেই। প্রায় প্রতি বছরই দল যায়, নতুন দল আসে। তাহলে ব্র্যান্ড হবে কীভাবে। এক বছরে ব্র্যান্ড হয় না, সময় লাগে। বিসিবি এটাকে ব্র্যান্ড করতে পারবে না, দলগুলোকেই ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে হবে।'
সারওয়ার ইমরানের ব্যাখ্যাও এমনই। তিনিও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বললেন, 'ছয় বছরের জন্য চুক্তি, স্থায়ী দল; এমন কিছু তো বিপিএলে এখনও হয়নি। প্রতি বছরই মালিকানা বদলায়। এক আসরে সিলেট বা রাজশাহীর এক নাম, পরের আসরে আরেক নাম। ভিন্ন ভিন্ন নামে খেলে দলগুলো। সবটাই মালিকানা বদলের কারণে। একই মালিকানার অধীনে থাকা কোনো দলের কিন্তু নাম কখনও পাল্টায়নি। যে কারণে কুমিল্লা আর রংপুর কিন্তু কিছুটা ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে, কারণ একই মালিকানা আছে। তো এই যে দ্রুত মালিকানা বদল, সঙ্গে নাম বদল; এসব কারণে বিপিএলের দলগুলো ব্যান্ড হয়ে উঠতে পারছে না। দীর্ঘমেয়াদে চুক্তি না করাটা মূল কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়। মালিকানা এক থাকলে নাম বদলাতো না, তখন এমনিতেই ব্র্যান্ড হয়ে উঠতো দলগুলো।'
বিপিএলের মালিকানা বদলের মতো ক্রিকেটারদের ঠিকানাও বারবার বদলায়। মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস বা রোহিত শর্মার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মতো কিছু গড়ে ওঠেনি বিপিএলে। এটার ব্যাখ্যায় নাজমুল আবেদীন বলেন, 'বিপিএলে একেবারে দেখা যায় না, তেমন নয়। তবে হ্যাঁ, এক দলে দীর্ঘদিন খেলা ক্রিকেটারের সংখ্যা একেবারে কম। নতুন দল এলে তাদের তো ক্রিকেটার ধরে রাখার কিছু নেই, তারা নতুন দল, নতুন খেলোয়াড় নিয়ে খেলে। এটার কারণও একই।'
'দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না থাকার কারণে অনেক কিছুই সম্ভব হচ্ছে না। একজন খেলোয়াড় একটা দলে লম্বা সময় খেললে দলের সঙ্গে তার যে সম্পর্কটা তৈরি হয়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ভালো খেলা বা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বারবার নতুন দল এলে এটা হবে না, আবার এক দল এক আসর খেলে বাদ দিলে তাদের খেলোয়াড় ধরে রাখার সুযোগ থাকবে না। নতুনরা এসে নতুন করে সাজাবে। সব মিলিয়ে সমস্যার মূলে ওই একটা বিষয়ই।' বলেন তিনি।
সারওয়ার ইমরানের মতও একই রকম, তবে তিনি পারফরম্যান্সকেও কারণ মনে করেন, 'দলগুলোর সঙ্গে লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি হলে তারা নিশ্চিত হতে পারে যে, এতো বছরের জন্য আছি। তখন তারা সেভাবে পরিকল্পনা, প্রস্তুতি নিতে পারে। খেলোয়াড় ধরে রাখার ক্ষেত্রেও তাই। কোন খেলোয়াড়কে মূলত দল ধরে রাখে, যারা ভালো খেলে। পারফর্ম না করলে অনেককেই ছেড়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি না থাকার প্রভাব তো আছে, তবে পারফরম্যান্সটা অন্যতম কারণ। কেউ যদি দারুণ খেলে তাকে ক্লাব ধরে রাখতেই চাইবে। ব্যতিক্রমও থাকে, তবে ধরে রাখার চেষ্টাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করা হয়। আবার একটা দল এক বছর খেলেই বিপিএল ছাড়ে, নতুন মালিক এসে তো তাদের মতো করে ভাববে না। তারা নতুন শুরু করবে, নতুন পরিকল্পনায়।'