বেজে যায় বেলা ফুরোবার গান
সময়, এক অমোঘ আশ্চর্য সত্য। তাকে ধরে রাখা যায় না, বেঁধে রাখা যায় না। সে চলতে চলতে মনে করিয়ে দেয়, শেষের সময় চলে এসেছে! সময়কে আটকানো গেলে বোধোহয় এখন সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন ফুটবল প্রেমিরা। বিশেষ করে লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যাদের কাছে পূজনীয়। এই দুই মহারথীর বিদায়ের বিউগল যে বেজে চলেছে!
ইউরোর শেষ ষোলোর ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেও পর্তুগালকে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছিল রোনালদোর সামনে। কিন্তু স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করে বসেন সিআর সেভেন। অতিরিক্ত সময়ের বিরতিতে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় তাকে। যা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে কোটি কোটি রোনালদো ভক্তের। এরপর টাইব্রেকারে দিয়োগো কস্তার দুঃসাহসী সেই গল্প লেখা, যা রোনালদোর পেনাল্টি মিসকে বড় কিছু হতে দেয়নি।
টাইব্রেকারে ঠিকই দলের হয়ে প্রথম শট নিতে এসে ওবলাককে পরাস্ত করলেন। সেই ওবলাক, যাকে রোনালদো গুণে গুণে দিয়েছেন ঠিক আট গোল, করেছেন দুটি হ্যাটট্রিকও। ম্যাচের মধ্যে স্লোভাকিয়া গোলরক্ষক নিজের প্রতিশোধটা নিয়ে নিলেও টাইব্রেকারে আর পারেননি রোনালদোকে ঠেকাতে। বল জালে জড়াতেই সিআর সেভেন করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন পর্তুগাল সমর্থকদের দিকে।
কিন্তু রোনালদোকে ক্ষমা চাইতে হবেই বা কেন! পেনাল্টি মিস তো অহরহই করে থাকেন ফুটবলাররা, মহাগুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনেক রথী-মহারথীও কতশত মিস করেছেন। কিন্তু রোনালদোর সঙ্গে তাদের পার্থক্যই যেন এখানে। নিজেকে এমনই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন মাদেইরা থেকে উঠে আসা লোকটি যে একটি স্বাভাবিক ঘটনাকেও মেনে নিতে পারেন না তিনি। নিজের কাছে সবসময় তাকে থাকতে হবে নিখুঁত। দলকে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতে বদ্ধপরিকর তিনি। সেটি একবার না পারাতেই এই ক্ষমা ভিক্ষা।
কোপা আমেরিকার শেষ আটের ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির খেলা নিয়ে ছিল সংশয়। সব দূরে ঠেলে মাঠে তিনি নামলেন ঠিকই, কিন্তু পুরো ম্যাচেই হয়ে রইলেন নিজের ছায়া। টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচে দলের হয়ে প্রথম শটটা নিতে আসেন এলএম টেনই। ভরসার মূর্ত প্রতীক মেসি 'পানেনকা' নিতে গিয়ে বল উঠে যায় বার পর্যন্ত। আর ভয় জেগে ওঠে আর্জেন্টিনা ভক্তদের মনে, সেমি-ফাইনাল খেলা বুঝি এবার আর হচ্ছে না!
কিন্তু আর্জেন্টিনার একজন এমিলিয়ানো মার্তিনেস আছেন। যিনি বারবার দলকে উদ্ধার করেন বিপদ থেকে। প্রবল পরাক্রমে ইকুয়েডরকে ঠেকালেন মার্তিনেস। পুষিয়ে নিলেন মেসির মিস, আর্জেন্টিনাও উঠে গেলে কোপার সেমি-ফাইনালে। তবে তাতে মেসির ভূমিকা খুব সামান্যই। এবার আর্জেন্টিনাকে টেনে নিচ্ছেন দলের বাকিরা। যেন মেসির এতদিন দলকে কেবলই দিয়ে যাওয়ার প্রতিদান দিচ্ছেন মার্তিনেস-লাউতারোরা।
ব্যাপারটা এমন নয় যে মেসি-রোনালদোদের দল বিদায় নিয়েছে নিজ নিজ টুর্নামেন্ট থেকে। এখনও পর্তুগালের সামনে সুযোগ রয়েছে ইউরো জেতার, কোপার শিরোপা জিততে এখনও ফেবারিট আর্জেন্টিনাই। তাহলে মেসি-রোনালদো ভক্তদের এখনই শঙ্কিত হওয়ার কারণ কী? কারণ, ওই যে সময়! কেবলই সদ্য হওয়া জুনে ৩৭ পূর্ণ করে ৩৮ এ পা দিয়েছেন মেসি, রোনালদো তো ছুটছেন ৪০ এর দিকে। দুজনের কেউই এখন আর আগের মতো ধারালো নন, এক নিমিষে ম্যাচের ভাগ্য পালটে দেওয়া ক্ষমতাটাও যেন কমে গেছে অনেকটাই।
ভেবে দেখুন না, এই তো ১০ বছর আগেও মাঠে টগবগ করে ছুটে বেড়িয়েছেন দুজন। এই দুজনের বিপক্ষে খেলা মানেই ছিল প্রতিপক্ষের জন্য অশনি সংকেত। যাকেই সামনে পেয়েছেন, ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছেন দুজনে। করে দেখিয়েছেন এমন সব কাণ্ড, যা ফুটবল মাঠে দেখতে পাওয়া যাবে তা ভাবেননি অনেকেই। বছর পাঁচেক আগের কথাই চিন্তা করলেও দেখা যাবে, দুজনই ইউরোপের ফুটবলে ত্রাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন মধ্য ত্রিশেও। কিন্তু এখন? সেই সুদিন যে আর নেই। সময়ের ফেরে একজন আছেন সৌদি আরবে, আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে।
ইউরোপের ফুটবলে এখন আর তাদের নাম শোনা যায় না, এসেছে নতুন নতুন তারারা। ফুটবলের ধরনটাও বদলে গেছে বেশ। কিন্তু মেসি-রোনালদোর অর্জন আর কীর্তি তো মুছে ফেলার নয়। যতদিন ফুটবল থাকবে, ততদিন এ দুজনের নাম উচ্চারিত হবে সর্বকালের সেরা দুই খেলোয়াড় হিসেবেই।
চলতি ইউরোতে চার ম্যাচ খেলে এখনও গোলের দেখা পাননি রোনালদো। কোপাতে মেসি খেলেছেন তিন ম্যাচ, গোল নেই একটিও। স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে রোনালদোর পেনাল্টি মিস কিংবা ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির টাইব্রেকার শটে গোল করতে না পারায় তাদের দলের ক্ষতি হয়নি ঠিকই, কিন্তু এই দুটি ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে- সময় যে ফুরিয়ে এলো! মেসি-রোনালদো দুজনই হয়তো কোপা-ইউরো জিতবেন, হয়তো কেউই জিতবেন না। আবার একজন জিতবেন, একজন জিতবেন না, এমনটিও ঘটতে পারে। ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, তাতে সময় যে আর ফিরে আসবে না! দুজনের কেউই ফিরে পাবেন না সেই অত্যাশ্চর্য প্রদীপ, যা তারা ঘষলেই বেরিয়ে আসতো সমাধান।
এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। দুজনই কবে বলে উঠবেন- 'এবার তবে আসি'।