গণআন্দোলনের পর কীভাবে চলছে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় তলায় কোনো এক খেলার অভিভাবক সংস্থার অফিস। সংস্থার চেয়ে এসব অফিস ফেডারেশন নামে বেশি পরিচিত। এক রুমের অফিসটির দরজা খুলে ঢুকতেই একজনের দেখা মিললো, কম্পিউটারে কাজ করছেন তিনি। অন্যের ফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনে নজর ধরে রাখা 'অনৈতিক' মনে হলেও সঙ্গত কারণেই চোখ আটকে গেল। উপস্থিতির প্রশ্নে সেভাবে সাড়া দিচ্ছিলেন না তিনি, বাধ্য হয়েই তার কাজে চোখ রাখতে হলো। ফেডারেশনটিতে উপস্থিত একমাত্র ব্যক্তিটি যে কাজ করছিলেন, সেটা খেলা বা ফেডারেশন সংশ্লিষ্ট নয়। নিজের কোম্পানির তৈরিকৃত কাপড়ের বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল বাছাই করছিলেন তিনি।
এটাকে নিতান্তই একটা ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গবন্ধু-হকি স্টেডিয়াম পাড়ার বেশিরভাগ ফেডারেশনের বর্তমান চিত্র এমন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এক সঙ্গে ৪২টি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটি ভেঙে দেওয়াসহ সভাপতিকে অব্যহতি দেওয়া হয়, এর আগে আরও তিনটি ফেডারেশনের প্রধানকে অপাসারণ করা হয়। অ্যাডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে, যে দায়িত্বটি পড়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটির ওপর।
গত ১০ সেপ্টেম্বর সভাপতিদের অব্যাহতি দেওয়া হলেও ৯টি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি চূড়ান্ত হয় গত ১৪ নভেম্বর। যদিও কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে বেশ আগে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় সার্চ কমিটি। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত করতে সময় লেগে যায় প্রায় তিন সপ্তাহ। এর বাইরে বাকি ফেডারেশনগুলো অভিভাবকহীন, কার্যক্রম না থাকায় অফিসে হাজির হওয়াটাই যেন তাদের একমাত্র কাজ।
অ্যাডহক কমিটি পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা কয়েকটি ফেডারেশন ঘুরে দেখা গেছে, উপরের সারির কর্মকর্তারা নিয়মিত অফিস করছেন না। যারা অফিসে হাজিরা দিচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই এক্সিকিউটিভ ও অফিস সহকারী পর্যায়ের। অফিস কক্ষ খোলাটাই একমাত্র কাজে পরিণত হয়েছে কিছু কিছু ফেডারেশনের ক্ষেত্রে।
সভাপতিহীন এসব ফেডারেশনগুলোতে এখনও সাধারণ সম্পাদক পদটি বহাল। যদিও সাধারণ সম্পাদকের পদটিতে থাকা বেশিরভাগ কর্মকর্তাই অফিস-বিমুখ। আপাতত কোনো খেলা নেই, তাই নেই কার্যক্রমও। এ কারণে সাধারণ সম্পাদকরা মাঝে মাঝে অফিসে আসেন বলে জানান এক ফেডারেশন কর্মকর্তা। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকেও এই মুহূর্তে কোনো নির্দেশনা নেই।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এক ফেডারেশনের কর্মকর্তা বলেন, 'আমার কাছে আপাতত যে নির্দেশনা, সেটা হলো অফিসে আসা। এসে কী করবো, সেই নির্দেশনা আমাকে দেওয়া হয়নি। আপাতত কোনো খেলা নেই আমাদের। আর খেলা না থাকলে সাধারণত কাজও থাকে না। সামনে কোনো খেলা বা টুর্নামেন্ট থাকলেও কাজ করতে হয়। কিন্তু এমন কিছুও নেই। সাধারণ সম্পাদক সাহেব মাঝে মধ্যে আসেন, তবে উনারও কোনো কাজ থাকে না। কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। আগামীতে কবে খেলা বা কী কার্যক্রম, এ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।'
অ্যাডহক কমিটি ও তদবিরের অভিযোগ
৯টি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি দেওয়া হয়েছে। ফেডারেশনগুলো হচ্ছে; হকি, অ্যাথলেটিকস, দাবা, কাবাডি, ব্রিজ, স্কোয়াশ, টেনিস, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার ও বাস্কেটবল। ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের পথে নেওয়া এই পদক্ষেপটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অ্যাডহক কমিটির জন্য প্রস্তাব করা সার্চ কমিটির তালিকায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করেছে, তা থেকে ৮০ ভাগ রাখা হয়েছে। ২০ ভাগে এসেছে পরিবর্তন। ব্রিজ ও কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি পড়ে যে নাম দুটি সার্চ কমিটি দিয়েছিল, মন্ত্রণালয় থেকে সেটা পরিবর্তন করা হয়েছে। সার্চ কমিটির প্রস্তাব করা একজন সাধারণ সম্পাদকের নাম কাটা গেছে।
অ্যাডহক কমিটির সদস্য নির্বাচনে তদবির করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সার্চ কমিটির এক সদস্য টিবিএসকে বলেন, 'দায়িত্ব পাওয়ার পর এটা ছিল আমাদের প্রধানতম কাজ, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করেছি। অনেক কিছু বিবেচনায় এনে যাচাই-বাছাই করে আমরা নাম সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু কয়েকটি ফেডারেশনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়, এমনকি নাম বাদও দেয়া হয়। কমিটিতে নাম দেওয়ার জন্য তদবির পর্যন্তও হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গন সংঙ্কারের জন্য এই সার্চ কমিটি, তাদের প্রস্তাবে ভিন্নতা আসাটা ভালো কোনো অভিজ্ঞতা নয়।'
এমন অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) সচিব আমিনুল ইসলাম। সার্চ কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কেই কোনো ধারণা নেই বলে জানান তিনি। গত জানুয়ারিতে এনএসসির সচিবের দায়িত্ব পাওয়া আমিনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমার তো এগুলো জানা নেই। সার্চ কমিটি কী জমা দিয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। কী অভিযোগ জমা পড়েছে, সেটাও আমার জানা নেই।' বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাড়া দেননি।
বাকি থাকা ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি ও আর্থিক জবাবদিহিতা
বাকি থাকা ফেডারেশনগুলোর মধ্যে ১০টির অ্যাডহক কমিটি শিগগিরই দেওয়া হবে। শনিবার সভায় বসার কথা সার্চ কমিটির, এখানে ১০টি অ্যাডহক কমিটির জন্য নাম চূড়ান্ত করা হবে। এরপর ধাপে ধাপে বাকি ফেডারেশনগুলোর অ্যাডহক কমিটি দেওয়া হবে। কমিটি করা হচ্ছে ১৫ থেকে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট, যেখানে আগের কমিটির ৬৫ ভাগ কর্মকর্তাকে রাখার সুপার করছে সার্চ কমিটি। বাকি থাকা ফেডারেশনগুলোর অ্যাডহক কমিটির সদস্য বাছাইয়ে হস্তক্ষেপ বা নাম পরিবর্তন করার মতো বিষয় থাকবে না বলে আশাবাদী সার্চ কমিটির সদস্যরা।
সব ফেডারেশনের কাছে প্রতি বছরের আর্থিক হিসাব চাওয়া হয়েছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়য়ের পক্ষ থেকে। এ বিষয়টি এবং কমিটি গঠন নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতা নিয়ে কিছুদিন আগে ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেছেন, 'বিভিন্ন কমিটি নিয়ে যে অভিযোগ আছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেখানে স্থবিরতা আছে, সেখানে নতুন কমিটি করে সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা ফেডারেশনগুলোকে প্রতি বছরের হিসাব দিতে বলেছি। আপনারা (সাংবাদিকরা) ফেডারেশনগুলোকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন।'
সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ৩৬টি ফেডারেশন হিসাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে এসব ফেডারেশনে বরাদ্দ বন্ধ রেখেছে এনএসসি। এ বিষয়ে এনএসসির সচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, 'আমরা ফেডারেশনগুলোকে মনে কররিয়ে দিয়েছি যে, বিগত বছরের প্রতিবেদনটা পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এনএসসিতে পাঠাতে হয়। ৩৬টি ফেডারেশন নির্ধারিত সময়ে হিসাবটা দেয়নি। তো মাননীয় চেয়ারম্যান স্যারের অনুমতিক্রমে আমরা এসব ফেডারেশনের ক্ষেত্রে ফান্ড রিলিজটা আপাতত বন্ধ রেখেছি। কেউ হয়তো ঠিক সময়ে দেয়নি, কেউ হয়তো আরেকটি রিপোর্ট দেয়নি; কয়েকটি কারণ মিলিয়ে আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
এক সঙ্গে ৪২টি ফেডারেশনের সভাপতিকে অপসারণ করার বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের নতুন সরকার ৮ আগস্ট সপথ নেয়। আমাদের উপদেষ্টা স্যার দায়িত্ব নেন ১০ আগস্ট। ১২ আগস্ট আমরা সব ফেডারেশনকে চিঠি দিই এটা জানতে চেয়ে যে, কোন কোন ফেডারেশনের সভাপতি উপস্থিত বা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত আছেন, তা জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। বলেছিলাম ১৪ আগস্ট বিকাল ৩টার মধ্যে প্রতিবেদন এলে সে অনুযায়ী তথ্য প্রস্তুত করবো। আর এর মধ্যে না এলে ধরে নিবো তারা অনুপস্থিত। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৭টি ফেডারেশন চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের সভাপতি উপস্থিত। ১৯টি জানায় তাদের প্রধান অনুপস্থিত। বাকি ফেডারেশনগুলো কোনো তথ্য দেয়নি। তথ্য না দেওয়া সমীচীন নয়। আর দেয়নি মানে অনুপস্থিত। তাদের ফান্ড রিলিজও আমরা বন্ধ রেখেছি।'