৩২১ রানও যথেষ্ট হলো না, জাঙ্গু কীর্তিতে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
আফিফ হোসেন ধ্রুবর ডেলভারিটি সজোরে হাঁকিয়েই হেলমেট খোলা শুরু করলেন আমির জাঙ্গু। ব্যাটের আওয়াজেই যেন তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, বাতাসে ভেসে বল সীমানা ছাড়া হবে। এই যে আত্মবিশ্বাস, সেটা তিনি তার পুরো ইনিংস ধরেই দেখিয়েছেন। জাঙ্গুর বিশ্বাস ভাঙেনি, তিনি হেলমেট খুলতে খুলতেই বল আফিফের মাথার উপর দিয়ে সীমানা ছাড়া, আরও একটি ছক্কা। যে ছক্কায় ৯৪ থেকে ১০০ ছুঁয়ে ফেলেন জাঙ্গু, অভিষেকেই দুর্বার ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি করে ক্রিকেট ইতিহাসে খোদাই করে নেন নিজের নামটি। এর কয়েক মুহূর্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলে নেয় ঐতিহাসিক এক জয়।
বৃহস্পতিবার সেন্ট কিটসের ওয়ার্নার পার্কে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ৪ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এই হারে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলো মেহেদী হাসান মিরাজের দল। ৩ বছর ৯ মাস পর তেতো এই স্বাদ নিতে হলো বাংলাদেশকে। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ড সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০ বছর পর ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ হলো বাংলাদেশ, সর্বশেষ হয় ২০১৪ সালে।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ অগোছালো শুরু করলেও সৌম্য সরকার ও মেহেদী হাসান মিরাজের জুটিতে ঠিক পথে ফেরে। এরপর ইনিংসের বাকি অংশে চলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও জাকের আলীর দাপট। ষষ্ঠ উইকেটে রেকর্ড জুটি গড়াসহ শেষ ১০ ওভারে ১০৫ রান তোলেন তারা। এই চার জনের হাফ সেঞ্চুরি ৫ উইকেটে ৩২১ রান তোলে বাংলাদেশ। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং করে এটাই তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, সব মিলিয়ে দ্বিতীয় সেরা। এই মাঠের সর্বোচ্চ এবং দেশের বাইরে এটা বাংলাদেশের সপ্তম সর্বোচ্চ সংগ্রহ।
এই রান তাড়া করে জিততে রেকর্ড গড়তে হতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এই মাঠের সর্বোচ্চ রান তাড়া ২৯৫, এই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেই সফল রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে স্বাগতিকরা। আজ সেটার সীমানা আরও বাড়িয়ে নিলো ক্যারিবীয়রা। বড় লক্ষ্য তাড়ায় বাজে শুরুর পরও কেসি কার্টি ও নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি করা জাঙ্গুর ঝলমলে ব্যাটিংয়ে ২৫ বল হাতে রেখেই রোমাঞ্চকর জয় তুলে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই মাঠে এটা তাদের সর্বোচ্চ রান তাড়া, সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে তৃতীয় সফল রান তাড়া।
বড় লক্ষ্য তাড়ায় দাপুটে শুরুর চেষ্টা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ওভারে নাসুম আহমেদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন ব্র্যান্ড কিং। এই ওভারের ৪ চার ও এক ছয় ১.৫ ওভারে ১৯ রান যোগ হয় স্বাগতিকদের স্কোরকার্ডে। যদিও এই ওভারের শেষ বলেই আসে উইকেট। নাসুমের করা শেষ বলে রান নিতে গিয়ে রান আউট হন ১০ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ১৫ রান করা কিং। এই চাপ কাটিয়ে ওঠার আগেই চতুর্থ ওভারে স্টাম্প উপড়ে আলিক আথানেজকে ফেরান নাসুম।
২৮ রানে দুই উইকেট হারিয়ে ক্যারিবীয়রা যখন দিশাহীন, তখন আঘাত হানেন প্রায় এক বছর পর ওয়ানডে খেলতে নামা হাসান মাহমুদ। তার বলে উইকেটের পেছনে ধেরা পড়েন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক শেই হোপ। ৩১ রানে ৩ উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন কেসি কার্টি ও প্রথম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করে দলকে জেতানো শারফেন রাদারফোর্ড। ৭.৪ ওভারে বৃষ্টি হানা দেয়, খেলা বন্ধ থাকে ৩০ মিনিটের মতো। ফিরে একই ছন্দে ব্যাটিং শুরু করেন কার্টি ও রাদারফোর্ড।
চতুর্থ উইকেটে জুটি গড়ে এগোতে থাকেন এ দুজন। যদিও তাদের জুটি বেশি বড় হতে দেননি তাসকিন আহমেদ। সিরিজ সেরা রাদারফোর্ডকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন ডানহাতি এই পেসার। এর আগে কার্টির সঙ্গে ৫৭ বলে ৫৫ রানের জুটি গড়েন ৩৩ বলে ৫টি চারে ৩০ রান করা রাদারফোর্ড। কার্টির সঙ্গে যোগ দিয়ে পঞ্চম উইকেটে জুটি গড়ে তোলেন অভিষিক্ত আমির জাঙ্গু। মুহূর্তেই এ দুজন ম্যাচের আবহ পাল্টে দেন, দারুণ ব্যাটিংয়ে বড় করতে থাকেন জুটির রান।
রান তোলার গতি, ম্যাচের অবস্থা মাথায় রেখে দায়িত্বশীল ব্যাটিং করতে থাকেন এ দুজন। তাদের সামনে বাংলাদেশের কোনো বোলারই বাধার দেয়াল তুলতে পারছিলেন না। ১১৫ বলে ১৩২ রানের জুটি গড়েন কার্টি-জাঙ্গু, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে তাদের সেরা জুটি, সব মিলিয়ে দশম। এই জুটিতে ঠিক পথে থেকেই জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এমন সময়ে ব্রেকথ্রু এনে দেন রিশাদ হোসেন। বাংলাদেশের লেগ স্পিনার ফিরিয়ে দেন ৮৮ বলে ১০টি চার ও ২টি ছক্কায় ৯৫ রানের দুর্বার ইনিংস খেলা কার্টিকে। এটা তার পঞ্চম ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরি।
এরপর রস্টন চেসকেও ফেরান রিশাদ, নিজের বলে নিজেই ক্যাচ নিয়ে তাকে ফেরান তিনি। ১৭ বলে ১২ রান করেন ক্যারিবীয় এই অলরাউন্ডার। এরপর আবারও জুটি, ম্যাচসেরা জাঙ্গুর সঙ্গে যোগ দিয়ে দারুণ ব্যাটিং শুরু করেন গুডাকেশ মোটি। এই জুটি আর ভাঙতে পারেনি বাংলাদেশ। খুনে ব্যাটিংয়ে ৫৩ বলে ৯১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান এ দুজন। অভিষেক রাঙানো জাঙ্গু ৮৩ বলে ৬টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১০৪ রানে অপরাজিত থাকেন।
১৯৭৮ সালে ডেসমন্ড হেইন্সের পর ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে অভিষেকে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়লেন ২৭ বছর বয়সী জাঙ্গু। যদিও ব্যক্তিগত ৬১ রানে ফিরে যেতে পারতেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান, কিন্তু রিশাদের বলে তার তোলা ক্যাচ নিতে পারেননি বদলি ফিল্ডার পারভেজ হোসেন ইমন। জাঙ্গুর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা মোটি ৩১ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় ৪৪ রানে অপরাজিত থাকেন। বাংলাদেশের লেগ স্পিনার রিশাদ ২টি উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান হাসান, নাসুম ও তাসকিন।
এর আগে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। আগের দুই ম্যাচের মতো আজ রানের দেখা পাননি তানজিদ হাসান তামিম, দলীয় ৯ রানে ফিরে যান তিনি। এই ওভারে আরও চাপ বাড়ে বাংলাদেশের, ফিরে যান লিটন কুমার দাসও। লম্বা সময় ধরে রান খরায় ভোগা এই ব্যাটসম্যানও তানজিদের মতো শূন্য রানে আউট হন। এ নিয়ে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ২১ ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরিহীন থাকলেন লিটন।
চলতি সিরিজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তিন ওয়ানডেতে তার রান ৬। প্রথম ওয়ানডেতে ৭২ বলে ২ রান করা উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান দ্বিতীয় ম্যাচে ১৯ বলে করেন ৪ রান। আজ দ্বিতীয় বলেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। ৯ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন দিকহারা। এখান থেকে হাল ধরেন আগের দুই ম্যাচে অনুজ্জ্বল থেকে যাওয়া সৌম্য ও মিরাজ।
চাপ সামলে দ্রুততার সঙ্গেই উইকেটে থিতু হয়ে যান এ দুজন। শুরুতেই ধীর-স্থির ব্যাটিং করলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত রান তোলায় মনে দেন সৌম্য ও মিরাজ। একটা সময়ে গিয়ে দাপুটে ব্যাটিং করতে থাকা বাংলাদেশের এই দুই ব্যাটসম্যান। তৃতীয় উইকেটে ১২৭ বলে ১৩৬ রানের জুটি গড়েন সৌম-মিরাজ। যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি।
তৃতীয় উইকেটে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা জুটি, বিদেশের মাটিতেও তাই। এই ফরম্যাটে ৫ ইনিংস পর হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া সৌম্য ৭৩ বলে ৬টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৭৩ রান করেন। ওয়ানডেতে এটা তার ত্রয়োদশ হাফ সেঞ্চুরি। দলকে ১৪০ ছাড়িয়ে দিয়ে আউট হন সৌম্য। তার বিদায়ের পর আরও কিছুটা সময় উইকেটে থাকেন অধিনায়ক মিরাজ।
উইকেটে থিতু হয়ে দারুণ ছন্দময় ব্যাটিং করে যাওয়া মিরাজকে হতাশ হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয়। ৭০ এর ঘরে আউট হওয়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান রান আউটে কাটা পড়েন। এর আগে ৭৩ বলে ৮টি চার ও ২টি ছক্কায় ৭৭ রান করেন তিনি। ওয়ানডেতে এটা তার ষষ্ঠ হাফ সেঞ্চুরি। পরের ওভারে থামেন আফিফ হোসেন ধ্রুবও। আগের দুই ম্যাচের মতো আজও সাবলীল শুরু করেন তিনি, কিন্তু আজও ইনিংস বড় করতে পারেননি তিনি। ১৫ রান করে ফিরে যান বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।
বাংলাদেশের ইনিংসের বাকি অংশ রাঙিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ ও জাকের। দ্রুত দুই উইকেট হারানোর চাপ সামলে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেন এ দুজন। শেষ ১০ ওভারে ১০৫ রান তোলেন দুজন। ১১৭ বলে ১৫০ রানের জুটি গড়েন তারা, যা ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সেরা। জুটিতে বেশি অবদান দুর্বার ইনিংস খেলা মাহমুদউল্লাহর। একটা সময়ে ক্যারিবীয় বোলারদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩২তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান ৬৩ বলে ৭টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৮৪ রানে অপরাজিত থাকেন।
৪ ছক্কায় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক হয়ে গেছেন তিনি, ছাড়িয়ে গেছেন তামিম ইকবালকে। মাহমুদউল্লাহর ছক্কা এখন ১০৭টি, তামিমের ১০৩টি। চলতি সিরিজের তিন ম্যাচেই হাফ সেঞ্চুরি করলেন মাহমুদউল্লাহ, সেন্ট কিটসে পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি। ৫৭ বলে ৫টি চার ও ২টি ছক্কায় হার না মানা ৬২ রান করেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া জাকের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার আলজারি জোসেফ ১০ ওভারে ৪৩ রানে ২টি উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান গুডাকেশ মোটি ও শারফেন রাদারফোর্ড।