কেন কোহলিকে বরখাস্ত করেছে বিসিসিআই? কী ঘটেছিল অন্তরালে?
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন, এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে নিজের ইচ্ছায় অধিনায়কত্ব ছাড়েননি এই তারকা ব্যাটসম্যান।
স্বেচ্ছায় অধিনায়কত্ব ছাড়ার জন্য শুরুতে কোহলিকে ৪৮ ঘণ্টায় সময় বেঁধে দিয়েছিল ভারত ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিসিসিআই। কিন্তু ৪৯তম ঘণ্টাতেও কোহলির পদত্যাগপত্র না আসলে তাকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয় সৌরভ গাঙ্গুলীর বোর্ড।
কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের সর্বকালের সেরাদের একজনের সঙ্গে হুট করে কীভাবে এরকম পাল্টা-পাল্টি অবস্থানে আসলো বিসিসিআই? সামনে পদচ্যুত কোহলির সঙ্গেই বা কীভাবে মানিয়ে নিবে ভারত দল?
২০১৭ সালে ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির কাছ থেকে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের দায়িত্ব বুঝে নেন কোহলি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দলকে তিনটি ভিন্ন আইসিসি শিরোপা জেতানো ধোনির উত্তরসূরি হওয়াটা এমনিতেও সহজ হওয়ার কথা ছিল না।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে, কোহলির মতো উত্থান আর কোনো ক্রিকেটারেরই হয়নি। রানের ফুলঝুরির সঙ্গে মাঠের কৌশল ও আগ্রাসন দিয়ে পুরো ভারতের মন জয় করে নেওয়া কোহলি এক সময় তিন ফরম্যাটেই দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, এই দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়েই তাই এগুচ্ছিল বিসিসিআই। এবং এ পরিকল্পনাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ধোনি নিজে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দুদিন পর পরই বিতর্কে জড়ানো কোহলিকে একসময় অধিনায়কের দায়ভারটা বুঝাতে শুরু করেন ধোনি। খেলা-বহির্ভূত আগ্রাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও ড্রেসিং রুমে নিজেকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ধোনির কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি সাহায্য ও পরামর্শ পান কোহলি।
ধোনি অধিনায়ক থাকার সময়েই শুরু হয় কাপ্তান কোহলির যাত্রা। ধোনি যুগের শেষ কয়েক বছরে কম গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোয় কোহলিকে অধিনায়ক করে দল পাঠাতে শুরু করে বিসিসিআই।
এরপর কোহলিকে একজন স্বতন্ত্র অধিনায়ক হিসেবে সুসজ্জিত করে বিশ্বকাপের আগে দুই বছর সময় রেখে ২০১৭ সালে অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান ধোনি।
গত পাঁচ বছরে ওয়ানডেতে কোহলির অধীনে খেলা ৯৫টি ম্যাচের ৬৫টিতেই জিতেছে ভারত, জয়ের হার ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর টি-টোয়েন্টিতে ৫০ ম্যাচের মধ্যে জিতেছে ৩০টিতে।
একদিনের ক্রিকেটে ন্যুনতম ৫০ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা ক্রিকেটারদের মধ্যে কোহলির চেয়ে ভালো জয়ের হার দেখেছেন মাত্র তিনজন। সেই তিনজন হচ্ছেন কিংবদন্তি ক্লাইভ লয়েড, রিকি পন্টিং ও হ্যান্সি ক্রনিয়ে।
ব্যাটসম্যান হিসেবে কোহলির রেকর্ড আরও উজ্জ্বল। ওয়ানডে অধিনায়ক থাকাকালে ৭২.৬৫ গড়ে মোট ৫৪৪৯ রান করেছেন এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। ইতিহাসের যেকোনো অধিনায়কের জন্যই সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় এটি।
কিন্তু এরপরও কেন কোহলিকে ভরসা করতে পারছে না ভারত?
সমস্যা ঠিক জয়-পরাজয়ের অনুপাতে না। ২০১৭ সালে তিন ফরম্যাটেই ভারতের অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর দুই বছরের মধ্যেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেন কোহলি। সেসময় বিসিসিআইয়ের কর্তা পদে অধিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট মনোনীত প্রশাসক কমিটিও মেনে নেয় অধিনায়কের প্রায় সকল দাবিই।
কিন্তু ২০১৯ সালে আবার বিসিসিআইয়ে ফিরে আসেন চিরাচরিত প্রশাসকরা, সভাপতি হয়ে ফিরেন সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। এর সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করে কোহলির ক্ষমতাও।
এদিকে, ভারতের ড্রেসিং রুমে কখনই একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না কোহলি। অধিনায়ক হওয়ার পর সতীর্থদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার অনেক চেষ্টা করলেও তার ম্যান-ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা তেমন বাড়েনি।
গত সেপ্টেম্বরে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) এক প্রতিবেদনে উঠে আসে কীভাবে ড্রেসিং রুমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন কোহলি। পিটিআইকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ভারতীয় ক্রিকেটার বলেন, "বিরাটের সবচেয়ে বড় ঝামেলা হচ্ছে আস্থার সমস্যা। তিনি সবাইকে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করতে বলেন, কিন্তু (সতীর্থদের সঙ্গে) নিজের যোগাযোগের অভাবেই তিনি অধিনায়ক হিসেবে আস্থা হারিয়েছেন।"
টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে ভারতীয় ড্রেসিং রুমের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোহলির সময়ে এক-দুই ম্যাচ বাজে খেললেই খেলোয়াড়েরা দলে তাদের অবস্থান নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যেত।
অধিনায়কত্বের শুরুর দিকে ছন্দে থাকা খেলোয়াড়দের বাহবা দেওয়ার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন কোহলি। তবে ছন্দহীন খেলোয়াড়দের দিকে কখনোই তেমন মনোযোগ দিতেন না তিনি।
বিসিসিআইয়ের পাইপলাইনে অসংখ্য প্রতিভাবান ক্রিকেটার মজুদ থাকায় এজন্য কখনোই ঠিক ভুগতে হয়নি ভারতের। কিন্তু এই মনোভাবের জন্য ড্রেসিং রুমে ক্রমেই আস্থা হারিয়েছেন কোহলি।
কুলদীপ যাদবের প্রতি কোহলির আচরণ বাজে নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা যাদবকে গত বছরের শুরুর দিকে দল থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কোহলি, তেমন কোনো কারণ না দেখিয়েই।
দল থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়া কুলদীপ পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমি মাহি (ধোনি) ভাইকে মিস করি। সে সবসময় সাহায্য করত আমাদের। আমি সবসময় অনুভব করেছি যে প্রতিটি বোলারের একজন সঙ্গী প্রয়োজন যে অন্য প্রান্ত থেকে সাহায্য করবে। মাহি ভাই যখন ছিলেন তখন আমি আর চাহাল একসঙ্গে বল করতাম। মাহি ভাই চলে যাওয়ার পর চাহাল আর আমি একসঙ্গে এক ম্যাচও খেলিনি। তিনি চলে যাওয়ার পর হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচ খেলেছি আমি।"
অধিনায়কত্বের দায়িত্বে কোহলির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল হয়তো এই ধোনিই। মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রায় মহাপুরুষ-সুলভ উপস্থিতির অধিকারী সাবেক অধিনায়কের পদাঙ্ককে অনুসরণ করা যে চাট্টিখানি কথা না।
অধিনায়ক থাকাকালে ধোনির হোটেল রুম তার সতীর্থদের জন্য সবসময় খোলা থাকত। কেউ চাইলে যেকোনো সময় রুমে ঢুকে রুম সার্ভিস অর্ডার করতে পারত, প্লে স্টেশনে গেম খেলতে পারত, কিংবা অধিনায়কের সঙ্গে আড্ডায় বসতে পারত।
বলা বাহুল্য, দলের সবার সঙ্গে বন্ধনটা গাঢ় করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ধোনি।
কিন্তু কোহলির ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটে। নেতৃত্ব পাওয়ার পর একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। যে কারণে জুনিয়র ক্রিকেটার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করার মতো একজন "বড় ভাই" খুঁজতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে সেই "বড় ভাই" চরিত্রটি হয়ে উঠেন রোহিত শর্মা।
জানা যায়, দলের ছন্দ হারিয়ে ফেলা ক্রিকেটারদেরও সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি হয়ে উঠেন শর্মা। পুরো সিরিজে বাজে খেলেছে বা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, খাবারের টেবিলে এমন সতীর্থদের পাশে গিয়ে বসতেন এই ওপেনার। এই বসার অর্থ একটিই। সেই সতীর্থকে জানানো, "চিন্তা নেই, কেউ না থাকলেও আমি আছি।"
বিসিসিআই যে নতুন অধিনায়ককে হিসেবে শর্মাকে দায়িত্ব দিবে, সেটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু "বড়ভাই" শর্মার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হবে, অধিনায়কত্ব-পরবর্তী কোহলিকে দলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সাহায্য করা। সদা হাস্যোজ্জল ও মিশুক মানসিকতার রোহিত শর্মার চেয়ে এই দায়িত্বে আর কাউকে বেশি ভরসা হয়তো করতে পারত না বিসিসিআই।
সামনের দিনগুলোতে আর আগের মতো অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়তো থাকবেন না কোহলি। তার কণ্ঠস্বর নিশ্চিতভাবেই মূল্য পাবে না আগের মতো।
তবে সেটা হয়তো ঠিক খারাপ সংবাদ না কোহলির জন্য। দুই বছরের বেশি সময় ধরে ওয়ানডেতে শতকের দেখা পাওয়া কোহলি এখন আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন নিজের ব্যাটিংয়ের দিকে।
আর পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই একের পর এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসা এই আধুনিক কিংবদন্তি তার অধিনায়কত্ব-পরবর্তী সময়ে ড্রেসিং রুমে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জটাও যে নিবেন খেলোয়াড়ি মানসিকতা থেকে, সেটাও বলে যায়।