কৃত্রিম পা সংযোজন: ফিরিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের জীবনের স্বপ্ন
পা-হারানো রোহিঙ্গা শিশু ৭ বছরের সাইফুল ইসলামের বাস বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবিরে। যেটির অবস্থান এই বাংলাদেশেরই কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে। বাস্তুচ্যুত এ শিশুর স্বপ্ন বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার।
মিয়ানমারে নিজেদের ভূমিতে থাকার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাঁ পা হারিয়েছে ছোট্ট সাইফুল। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তখন তাদের। দু’বছর আগে সাইফুল তার বাবার সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরে তাদের বাড়ির কাছের বাজারে গিয়েছিল। ফেরার পথে গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে তারা। পায়ে গুলি লাগলেও হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যায় সাইফুল। কিন্তু তার বাবা মারা যান।
রাখাইনে নির্যাতন থেকে বাঁচতে গুলি লাগার মাত্র আট দিন পর সাইফুল তার মা আয়েশা বেগম ও ছোট দু’বোন হোসনে আরা ও মিনারা বেগমের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তবে বিধি বাম! বছর খানেক পরে, কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরেই এক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয় সাইফুল। আঘাত পায় সেই বাঁ পায়েই। এবার ওর পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলতে বাধ্য হন ডাক্তাররা।
সা্ইফুলের নানা-নানি ও মামারাও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন। মা আয়েশা যখন জানতে পারেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) এক কর্মসূচির আওতায় সাইফুল তার হারানো পায়ের জায়গায় কৃত্রিম পা পেতে পারে তখন তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিও পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সাইফুল আবারও হাঁটতে পেরে কৃতজ্ঞ। সে বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায়। কারণ সে বোঝে, চিকিৎসার কল্যাণেই সে এখন হাঁটতে পারছে।
তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারলেও সে এখন সাবধানে ও ধীরে ফুটবলে লাথি দিতে শিখেছে। কুতুপালং শিবিরের পাহাড়ি পথে-প্রান্তে এখন সাইফুলের হাঁটার সঙ্গী জান্নাত। সাত বছর বয়সী এ মেয়েটিও একটি কৃত্রিম পা পেয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, কুতুপালং বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির হয়ে উঠেছে। মাত্র ১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ এলাকায় ছয় লাখের বেশি মানুষের বাস।
আইসিআরসির কর্মসূচির আরেক উপকারভোগী হলেন আলম। ১৯৯১ সালে স্থলমাইন বিস্ফোরণে হাঁটুর নিচ থেকে দু’পা উড়ে যায় তাঁর। হতভাগা সেই মানুষটিকে আবার বিপদের মুখোমুখি হতে হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। সে সময় রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আলম। তিন দিন ধরে হামাগুড়ি দিয়ে অতটুকু পথ পাড়ি দেন তিনি।
রোহিঙ্গা শিবিরে এসে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য আইসিআরসির কর্মসূচিতে মনোনীত হন আলম এবং এখন তিনি পরিবারকে কিছুটা সাহায্যও করতে পারছেন। দু’ছেলে ও এক মেয়ের জনক আলম উদ্বাস্তু শিবিরে একটি পোশাক তৈরির দোকানে সেলাই মেশিন চালান। তাতে প্রতি দিন তাঁর আয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সেলাই মেশিন চালাতে কৃত্রিম পা দুটো ভালোই সাহায্য করছে তাঁকে।
আইসিআরসির মুখপাত্র (জনসংযোগ কর্মকর্তা) রায়হান সুলতানা তমা ইউএনবিকে জানান যে, তাদের সংস্থা গত এক বছর ধরে কক্সবাজারে বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির ও তাঁবুতে কৃত্রিম অঙ্গ ও ডিভাইস সরবরাহে কাজ করছে। তারা সাইফুল, জান্নাত ও আলমকে কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যাতে তারা পুনরায় স্বাভাবিক বা যতটা সম্ভব স্বাভাবিকের কাছাকাছি জীবনে ফিরে যেতে পারেন।
আইসিআরসি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন শিবিরে বাস করা ১১৩ পঙ্গু রোহিঙ্গার জন্য কৃত্রিম পা ও হাত বা এমন অন্যান্য ডিভাইসের ব্যবস্থা করেছে।