ট্রাম্পের কাছে দেয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন প্রিয়া সাহা
দেশজুড়ে আলোচনা তোলার দুইদিন পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে দেয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রিয়া সাহা।
শারি নামে যে বেসরকারি এনজিও সংস্থার প্রধান নির্বাহী প্রিয়া সাহা তার ইউটিউব চ্যানেলে একজন সাংবাদিকদের কাছে প্রিয়ার সাক্ষাৎকারের একটি ভিডিও আপলোড দেয়া হয় যেখানে নিজের বক্তব্যের বিষয়ে অনড় অবস্থান জানিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্মেলনে যোগ দেয়ার পর হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া বলেছিলেন, “বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ডিজঅ্যাপিয়ার্ড (নিখোঁজ) হয়েছেন।”
ট্রাম্পের কাছে দেয়া নিজের বক্তব্যে ৩৭ মিলিয়ন বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে প্রিয়া সাহা বলেন, “ ২০০১ সালের বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ের যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু চ্যাপ্টার আছে সেখানে এই বিষয়গুলো লেখা আছে। প্রতিবছর সরকার যে সেন্সাস (আদমশুমারি) রিপোর্ট বের করে তা অনুসারে, দেশভাগের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।”
“এখন দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮০ মিলিওনের মতো। সেক্ষেত্রে জনসংখ্যা যদি একইভাবে বৃদ্ধি পেতো তাহলে যে সংখ্যা আছে এবং যে জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে হারিয়ে গেছে সেই জনসংখ্যা অর্থাৎ আমার তথ্যটা মিলে যায়।”
তিনি বলেন, “সরকারের এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত একটি গবেষণা করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৬৩২ জন করে লোক হারিয়ে যাচ্ছে। স্যারের সাথে ২০১১ সালে আমি সরাসরি কাজ করেছিলাম যার কারণে বিষয়টা সম্পর্কে আমি অবহিত।”
ডিজএপ্যিয়ার বলতে কি বুঝিয়েছেন এমন প্রশ্নের জনাবে তিনি বলেছেন, “আমি যেটা বোঝাতে চেয়েছি সেটা হলো, এই পরিমাণ লোক থাকার কথা ছিল। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি হয়েছে সেভাবে যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বৃদ্ধি পেতো অর্থাৎ ২৯ দশমিক ৭ পার্সেন্ট থাকতো তাহলে এই সংখ্যাটা (তিন কোটি ৭০ লক্ষ) হতো। কিন্তু সেটা নাই। এই যে নাই সেটাই আমি বোঝাতে চেয়েছি।”
বিশাল এই সংখ্যাটা কোথায় এবং কিভাবে হারিয়ে গেছে তা জানতে চাইলে প্রিয়া সাহা সরাসরি কোন উত্তর দেননি।
কীসের ভিত্তিতে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে’ এরকম বড় অভিযোগ করলেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইনি। আমার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। সেখানটায় ২০০৪ সালে প্রায় ৪০টা (হিন্দু) পরিবার ছিল, এখন ১৩টা পরিবার আছে।
“এই মানুষগুলো কোথায় গেল, কোথায় আছে, তা তো আপনাদের দেখার কথা বা রাষ্ট্রের দেখার কথা। সেটা আমার কাছে জানতে চাইলে কেমন হবে ব্যাপারটা? আপনারা ওই গ্রামে গেলে খুঁজে দেখে আসতে পারবেন।”
কোন সময়ের মধ্যে তার গ্রামে এই সংখ্যাটা কমেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৪ সালের পর থেকে।
তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষত পুলিশ বাহিনী পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সফলতা দেখিয়েছে। আমি যে জন্য বলেছি তা হলো, আমেরিকাও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের যাতে কোন মৌলবাদের উত্থান না ঘটে সেজন্য মার্কিন প্রশাসনও সাতে বাংলাদেশের সাথে একসাথে কাজ করে, সেজন্যই আমি কথাটা তাদের কাছে বলেছি।”
ট্রাম্পের কাছে কি বলেছেন প্রিয়া সাহা?
যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে দ্বিতীয়বারের মত আয়োজিত ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক তিন দিনের একটি সম্মেলনে যোগ দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা দেখা করে নিজ নিজ দেশের সমস্যার কথা জানান। সেখানেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ জানান বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা।
ট্রাম্পের কাছে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ আছে। আমার অনুরোধ, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি।”
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানতে চেয়েছিলেন- কারা তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, জমি কেড়ে নিয়েছে।
জবাবে প্রিয়া বলেন, তারা মুসলিম মৌলবাদী, তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।
ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যপক আলোচনা সমালোচনা তৈরি হয়। বাংলাদেশ সরকারও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
কে এই প্রিয়া সাহা?
প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক।
তিনি ‘শারি’ নামে বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় নিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত। প্রিয়া সাহা ‘দলিত কণ্ঠ’ নামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক।
পিরোজপুরের মেয়ে প্রিয়া সাহার স্বামী মলয় কুমার সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা। তাদের দুই মেয়ে পড়াশোনা করেন যুক্তরাষ্ট্রে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন প্রিয়া। থাকতেন রোকেয়া হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
তিনি ‘মহিলা ঐক্য পরিষদ’এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে গতবছর তাকে মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগঠন ‘হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন’র কর্মকর্তা জয় ক্যানসারার উদ্যোগে প্রিয়া সাহা যুক্তরাষ্ট্রে ওই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছেন।