ডেঙ্গুতে স্কুলগামী শিশুরাই বেশি ঝুঁকিতে
রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী শশী (১১)। ১ তারিখ রাতে জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। পরদিন রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। শশীর সুস্থ্য হতে আরো কয়েকদিন লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
সাত দিন ধরে জ্বরে ভুগছে ওয়ারির ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড স্কুলের কেজি টু’র শিক্ষার্থী আরিয়ান (৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেঙ্গু সেলের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছে।
শশীর মা কান্তা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাসায় মশারি টানানো হয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় বাসা সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখছি। আমার এলাকায় এখন পর্যন্ত কোন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়ানি। স্কুলেই শশীকে মশা কামড় দিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
একই কথা বলেন আরিয়ানের মা ফারজানা বেগম। তিনি বলেন, বাসায় থাকা কোনো মশা কামড় দিলে পরিবারের অন্য কারও না কারও ডেঙ্গু হতো। তাতো হয়নি। বাসায় বাচ্চাদের যত্নে রাখা হয় কিন্তু স্কুলের ভিতরে মশা আছে কিনা তাতো আমরা জানি না।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। সব বয়সী মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে। তবে শিশুদের মধ্যে শশী আরিয়ানের মত স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের হারই বেশি।
অভিভাবকদের দাবি স্কুল থেকেই মশার কামড় খাচ্ছে শিশুরা। এডিস মশা ধ্বংসে স্কুল কিংবা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা নেই। এজন্য অনেক অভিভাবকই স্কুল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট কিঙ্কর ঘোষ চলতি বছরের মে মাস থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৪৮৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ওপর গবেষণা চালান।
তাতে দেখা গেছে, ৬ থেকে ১১ বছরের বেশি বয়সী শিশুরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তাদের সংখ্যা ২৫৬ জন বা ৫৩ শতাংশ।
৩ থেকে ৫ বছর বয়সী ১৪৭ শিশু আক্রান্ত হয়েছে। এই হার ৩০ শতাংশ। ১ থেকে ২ বছর বয়সী শিশু ৫৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। তাদের হার ১১শতাংশ। এক বছরের নিচে ২৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। এই হার ৬ শতাংশ। ৬ থেকে ১১ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীরাই স্কুলে যায়।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত তিন হাজার মানুষের ওপর বয়সভিত্তিক একটি পর্যালোচনা করেছে।
সেখানে দেখা গেছে, শূন্য থেকে ১ বছর বয়সী ৯১ জন, ১ থেকে ৫ বছর বয়সী ১৫২ জন, ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী ৫৭১ জন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আইইডিসিআর এর তথ্যও বলছে স্কুলগামীদের মধ্যেই ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এডিস মশা সাধারণতা দিনের বেলায় কামড়ায়। শিশুরা দিনের বেলা স্কুলে থাকে তাই সেখানেই তারা হয়তো মশার কামড় খাচ্ছে।
বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হওয়ার কারণেই তারা বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছে বলে জানান ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যাওয়ায় তাদের প্রেসার, পাল্স খুঁজে পাওয়া যায় না। কিডনি, লিভার ফেইলিউর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি।
২ আগস্ট ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রাইয়ান সরকার (১২) । এর আগে ২৮ জুলাই ডেঙ্গুতে মারা যায় জারিফা জাহান (৯) নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে অন্তত পাঁচজন স্কুল শিক্ষার্থী মারা গেছে।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় বাড়িতে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। সবাই বাসা ও আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি জমে থাকলে এডিস মশার প্রজনন বাড়বে। তাই সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় স্কুলগুলো সচেতনামূলক কার্যক্রম ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষিকা সাহিদা সুমি।
তিনি বলেন, স্কুলে নিজেদের উদ্যোগে মশার স্প্রে করা হচ্ছে। এছাড়া স্কুলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঢাকা উত্তরের প্রতিটি স্কুলের প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, সচিব, স্কাউট প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করে প্রতিটি স্কুল নিজেদের ব্যবস্থাপনায় পরিষ্কার করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্কুলের ভেতর অন্যদের পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। প্রতিটি স্কুলে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রত্যেকের কাছে সচেতনামূলক ভিডিও পাঠানো হয়েছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতে ঈদের ছুটি এগিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনিতেই আগামী পরশু (৮ আগস্ট) থেকে রাজধানীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে।
এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ৩৪৮ জন
প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৭ হাজার ৯৬৮ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৩৪৮ জন। আগস্ট মাসের ছয় দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৫১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২৯ হাজার ৯১২ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ২৩ জন। তবে বেসরকারি তথ্য বলছে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়েছে।