স্মৃতির মিনারে শব্দ-আলোয় বিধৃত হোক জাতীয় ইতিহাসের দিনগুলো
গমগমে শব্দ আর সে সাথে আলোর কাজ। ধারা বর্ণনা বা সঙ্গীতের সাথে মিল রেখে কখনো চলমান কখন স্থির চিত্রের গতিময় উপস্থিতি। চোখের সামনে তুলে হচ্ছে ইতিহাসের দিনগুলোকে। হ্যাঁ, প্রজেক্টরের আলোর প্রক্ষেপণ ঘটছে সামনের মিনারে। প্রতিবছর ইরানি বিপ্লব দিবসের আগের রাতে এমনটি দেখা যায় তেহরানের আজাদি চত্বরে।
বাংলাদেশের ৫০তম বার্ষিকী, সুবর্ণ জয়ন্তী পালন হয়েছে ঘটা করে। পালন হয়েছে মুজিববর্ষ। রক্ত-পাথার সাঁতরে একটি জাতির স্বাধীনতা বন্দরে পৌঁছানোর বছরটির স্মরণে ত্রুটি ছিল না। অতীত ঘটনাগুলোইকে বর্তমানে 'ইতিহাস' হিসেবে তুলে ধরার গুণে ইতিহাসকে অনেক সময়ই 'বর্তমান' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইতিহাসের উপাদানগুলো উসকে দিয়ে বছরটাকে হয়ত আরো হৃদয়স্পর্শী করা যেত। ইতিহাসের বয়ানের মধ্য দিয়ে মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করার অমূল্য অবকাশ তৈরি হতো।
অন্যদিকে, গত বছরের ৩০ জুন একশ' বছরে পা রাখল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে বহুল উচ্চারিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। এ গৌরবোজ্জ্বল দিবসগুলো পালন আরো সমৃদ্ধতর হতো শব্দ-আলোয় বিধৃত ইতিহাস তুলে ধরার মাধ্যমে। তুলে ধরা হতে পারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। এ কথাও সবাই জানেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন দিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব গণআন্দোলন ও সংগ্রামের সূতিকাগার হয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবি ধারাবাহিক ভাবে পালন করেছে গৌরবময় ভূমিকা।
সাম্প্রতিক ঘটনাও বিধৃত হতে পারে। করোনাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন চিকিৎসা পেশার অনেকেই। ডাক্তার নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসা পেশায় জড়িতদের স্বার্থহীন সেবার মাধ্যমে করোনা জোয়ারকে প্রতিহত করা গেছে। তাদের কথাও এভাবে তুলে ধরে তাদের প্রতি জাতীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যেতে পারে। এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইতিহাস কেবল স্মৃতির কিছু কাগজের পাতা নয় বরং আত্মার আলোকসজ্জা হয়ে উঠতে পারে।
লেজার আলোর মাধ্যমে ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিদের ফুটিয়ে তোলা এবং তার সাথে তাল রেখে গান-কবিতা আর ধারা ভাষ্যে তুলে ধরার কথাই বলছি। বাংলাদেশে এখনো এর চল দেখা যায়নি। আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বল দিনগুলো, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ সুখের দিনগুলোকে জীবন্ত করে তোলা সম্ভব। একইভাবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অন্তহীন কান্না ও বেদনাকেও তুলে ধরা সম্ভব।
ইরানে প্রতি বছর বিপ্লবের আগের রাতে আজাদি মিনারকে ঘিরে আলো ও শব্দে কাহিনি বলার মেলা বসে। ফার্সি দিনপঞ্জির হিসেবে বিপ্লবের দিন বিশতো দো বাহমান (২২ বাহমান (বা ১১ ফেব্রুয়ারি) তবে ইরানি দিনপঞ্জির মলবর্ষ সাপেক্ষে ইংরেজি মাসের তারিখ বদলে ১০ ফেব্রুয়ারি হতে পারে) তার আগের রাতে অর্থাৎ ২১ বাহমান বা ১০ ফেব্রুয়ারি, আলো আর শব্দে বর্ণনা করা হয় বিপ্লবের কাহিনী। এখানে করোনার আগে তোলা কয়েকটি ছবি দেওয়া হলো।
এ জন্য বিশাল আয়োজনের প্রয়োজন নেই। শক্তিশালী কয়েকটি প্রজেক্টর থেকে ভিডিও বা স্থিরচিত্রের প্রক্ষেপণ ঘটবে। অন্যদিকে তার সাথে সঙ্গতি রেখে শব্দধ্বনি উচ্চারিত হবে।
এ আয়োজন তেমন খরুচে নয়। মিনারের দেওয়ালে ফুটে ওঠে ছবি তার সাথে মিল রেখে বর্ণনা বা সঙ্গীত চলতে থাকে। আলো ও শব্দের এ মেলা সাধারণ ভাবে আধা ঘণ্টার বেশি চলে না। তবে একাধিকবার শুরু থেকে শেষ দেখানো হতে থাকে। আজাদি মিনারে দেখেছি এ কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তিনটা শক্তিশালী প্রজেক্টর। সাথে রয়েছে দুর্দান্ত শব্দ ব্যবস্থা। ২০১৯ সালে এ মেলার সময়ে হালকা চালে তুষারপাত হচ্ছিল। তাতে মেলার কার্যক্রমের কোনও অসুবিধাই হয় নি।
গোটা বাংলাদেশে হতে পারে এমন আয়োজন। স্মৃতির মিনার বা বড় দালানের পাশে করা যাবে আয়োজন। এ হিসেবে প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে জাতীয় সংসদ ভবনের কথা।
রাজধানী ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন এমন কাজের জন্য সবচেয়ে সেরা। আলোকসজ্জার গুণে লুই কানের সৃষ্টির অহংকারদীপ্ত গৌরবময় এ ভবন জাতীয় বিশেষ দিনগুলোতে অসাধারণ উজ্জ্বল রূপে ফুটে ওঠে আমাদের কাছে। এখানে মেলা বসলে ভাবগাম্ভীর্যই হবে আলাদা। এ মেলা দেখার জন্য ভবনের নিরাপত্তা এলাকায় জনগণকে ঢুকতে হবে না। রাস্তা থেকেই প্রত্যক্ষ করা যাবে। এ ছাড়া, জাতীয় শহিদ মিনারেই করা যাবে এমন আয়োজন।
তবে আয়োজনের জন্য শহিদ মিনারে পর্দা ঝুলিয়ে নিতে হবে। কারণটা সহজ, শহিদ মিনারের দেওয়ালগুলো নিরেট না হওয়ায় সেখানে আলোর কাজ ফুটিয়ে তোলা যাবে না। শহিদ মিনারে পর্দা ঝোলান হয়। তাই এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে শহিদ মিনারের রক্তিম সূর্য এ ভাবেই তৈরি করা হয়। সে কথা সবাই জানেন। সেখানে একটা সাদা বড় পর্দা এমন কঠিন কিছু বিষয় হবে না।
এছাড়া, সাভারের বিজয় মিনারে স্বাধীনতা দিবসের রাতে শব্দ-আলোর মেলা বসতে পারে। তুলে ধরা যায় বাংলাদেশের ইতিহাস। এমন মেলা বসতে পারে অপরাজেয় বাংলাতেও। তবে এ সব স্থানে পর্দার প্রয়োজন পড়বে না। এখানে ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যাবে যে, মূল স্থাপনার গায়েই ফুটিয়ে তোলা যাবে আলোর কারুকাজ। কয়েকটা বড় মাপের শক্তিশালী স্পিকার লাগসই ভাবে বসিয়ে নিলেই প্রাণবন্ত শব্দ শোনা যাবে।
আলো ও শব্দের এ মেলার জন্য কোনো প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আনতে হবে না। বাংলাদেশে প্রযুক্তির সব উপকরণ মওজুদ আছে, যতটুকু জানি। দরকার উদ্যোগ। পরিকল্পনা। আর সমন্বয়।