অভিনেত্রী থেকে উদ্যোক্তা: নিজের পথ নিজেই গড়ে নিয়েছেন আলিশা প্রধান
ছোটবেলা থেকেই 'টমবয়' হিসেবে খ্যাতি ছিল অভিনেত্রী আলিশা প্রধানের। দুরন্তপনাই ছিল তার প্রধান বৈশিষ্ট্য । তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মেজ। তার দুই বছরের বড় বোন ফাইজা আবার উল্টো। শান্তশিষ্ট।
তবে এই টমবয় মেয়েটাই এখন বড় ব্যবসায়ী। বাবার সহযোগিতা আর নিজের চেষ্টা- দুটো দিয়েই সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে অবশ্য কিছুদিন মডেলিং ও অভিনয় করেছেন। এখন ব্যস্ত নারীদের কল্যাণে তার তৈরি করা করা অনলাইনভিত্তিক 'হার নেট' টিভি নিয়ে। পাশাপাশি করছেন অন্যান্য ব্যবসাও।
ক'দিন আগে তার গুলশানের অফিসে বসেছিলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিধির মুখোমুখি। কথা বলেছেন নিজের কাজ নিয়ে।
আলিশার জন্ম ঢাকার উত্তরায়। তবে শৈশব কেটেছে মালিবাগে। আট বছর বয়স থেকেই দুরন্তপনা করে বেড়াতেন পুরো এলাকা জুড়ে। ক্রিকেট খেলতেন এলাকার 'বড়ভাই'দের সঙ্গে। ভিডিও গেমের দোকানে গিয়ে খেলতেন মোস্তফা ও সামুরাই গেমগুলো।
শুরুতে স্কলাসটিকায় পড়লেও পরে ভর্তি হন উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে। বাসা পরিবর্তন করে পরিবারও চলে আসে তখন সেগুনবাগিচায়। কারণ তার বাবার বায়িং হাউসের অফিস পল্টন, আর তার স্কুল কাকরাইলে।
ছোটবেলা থেকেই বড় স্বপ্ন দেখতেন আলিশা। বলেন, 'আমার নিজের একটা অফিস থাকবে, একটা রুম থাকবে, সেখানে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করব- এ রকম একটা স্বপ্ন ছিল। সম্ভবত বাবাকে দেখেই এই রকম স্বপ্ন নিজের মনে বয়ে বেড়িয়েছি।'
তবে নিজের অফিসে যাওয়ার আগে, ক্লাস সেভেন পড়ার সময় বাবার অফিসে নিয়মিত যেতেন আলিশা প্রধান। এর একটা কারণও আছে। পুরোনো স্মৃতি মনে বললেন, "ড্যাড তখন পকেট মানি দিতেন ২৫ টাকা। কিন্তু সেটা দিয়ে আমার চলত না! টিফিনে ঠিকমতো খেতে পারতাম না। একদিন স্কুল ব্যাগ নিয়ে ড্যাডের অফিসে গেলাম। বললাম, 'আমার হাত খরচ বেশি লাগবে। তবে আমাকে এমনি দেওয়ার দরকার নেই। চাকরি দাও।' ড্যাড বললেন, 'তোমার তো সার্টিফিকেট নেই! তুমি পিওন বা ক্লার্ক হতে পার আমার অফিসে।' আমি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলাম। তারপর সপ্তাহে দুদিন অফিস করি। এটা-সেটা করি। কাগজপত্র প্রিন্ট করে এনে দিই, চা বানাই। বাবার সঙ্গে অনেকেই মিটিং করতে আসেন। তাদের আলাপ শুনি। বোঝার চেষ্টা করি। তারপর আস্তে ধীরে মার্চেন্ডাইজিং কাজটা শিখে ফেলি। কাজও শুরু করি। বাবা আমাকে মাসে বেতন দেন দেড় হাজার টাকা।"
তখন থেকেই কাজে নেমে পড়েন আলিশা। বাবার প্রতিষ্ঠানের হয়ে নানা জায়গায় প্রপোজাল জমা দেন। একটা লেগেও যায়! রিলায়েন্স গ্রুপ আলিশার পাঠানো প্রপোজালটা গ্রহণ করে। সেই এক অর্ডারে আলিশার লাভ হয় ২২ হাজার ডলার।
এভাবেই চলছিল। ২০০৮ সালে একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শোবিজে পা রাখেন আলিশা। শুরু করেছেন গ্লোবের ইউরো কোলার বিজ্ঞাপন দিয়ে। ভারতের রামুজি ফিল্ম সিটিতে ছিল ওটার শুটিং। সেখানে গিয়ে চমকে যান। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, অভিনেত্রী হবেন। দেশে ফিরে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। মায়ের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন প্রোডাকশন হাউসও। তিন বছর ছিলেন নাটক নিয়ে। এ সময়ে বেশ কিছু নাটক ও টেলিছবিতে অভিনয় করেন।
২০১৪ সালে চাষী নজরুল ইসলামের 'ভুল যদি হয়' ছবিতে অভিনয় করে সিনেমায় পা রাখেন আলিশা। এরপর একই পরিচালকের 'অন্তরঙ্গ' ছবিতে অভিনয় করেন। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি 'অজান্তে ভালোবাসা'।
কিন্তু চলচ্চিত্রের নানা 'রাজনীতি'র শিকার হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন, এমনটাই জানালেন আলিশা। তিনি আরও জানান, শুধু চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আগ্রহের কারণে তার প্রায় তিন কোটি টাকা 'নষ্ট' হয়। তারপরই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন। মাঝে পড়াশোনারও ব্যাঘাত ঘটে। তাই এবার সোজা চলে যান আমেরিকায়। আইটি বিষয়ে করেন ডিপ্লোমা। ২০১৫ সালে আইটি বিষয়ক সামিটে অংশও নেন। তারপর সেই পাঠ শেষে, ২০১৭ সালে দেশে ফেরেন।
আলিশা বলেন, 'এরপর আমি ভারত, দুবাই ও লন্ডন যাই। সেবা এক্সওয়াইজেড নামে সার্ভিস প্রোভাইডারট বাংলাদেশে লঞ্চ করব, এই পরিকল্পনায় নানা দেশ ঘুরে জরিপ করি, আলোচনা করি। সব আলাপ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু লঞ্চ করার ঠিক তিন সপ্তাহ আগে যেটার অ্যাফিলিয়েশন জন্য চার্জ ছিল ২৫ হাজার ডলার, সেটার জন্য ১০০ হাজার ডলার দাবি করা হয়। এ কারণে আমি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি।'
'এ সময়ে দেশে ফিরে আমি এক রকম বেকার হয়েই পড়ি। এরপর শুরু করি স্যোশাল চ্যারিটি। গুলশান এরিয়ার সব ধরনের মানুষকে যুক্ত করি চ্যারিটির সঙ্গে। এটাও একটা অর্জন। মাঝে ইন্ডিয়াতে যাই আরেকটা সামিটে অংশ নিতে। সেখানে গিয়েই মাথায় এলো, দেশের মেয়েদের জন্য কিছু করা যায় কি না। ইন্ডিয়া থাকাকালেই পুরো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। এটার জন্য টাকার দরকার,' যোগ করেন তিনি।
সেবার দেশে ফিরে নিজের বাবাকে নতুন ব্যবসার কথা জানান আলিশা। জবাবে তার বাবা জানান, টাকা নিতে হলে বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে ছয় মাস চাকরি করে দেখাতে হবে। তাছাড়া ভরসা নেই! আলিশা সিদ্ধান্ত নেন মেঘনা গ্রুপ বা গ্লোবে ঢুকবেন। যেহেতু গ্লোবের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন, তাই একটা সুসম্পর্ক রয়েছে।
আলিশা বলেন, 'সেখানে গিয়ে মালিক হারুন সাহেবের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। তিনিও একটা চ্যালেঞ্জ দেন।'
কী সেই চ্যালেঞ্জ? যদি আলিশা সাতদিন চাকরি করতে পারেন, তাহলে কনফার্ম চাকরি। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে রাজি হয়ে যান তিনি। শুরু করেন চাকরিজীবন। বলেন, "আমার ওই সময় মাসে হাত খরচ ছিল প্রায় দুই লাখ টাকা। আমি আমার ব্যাংকের যাবতীয় কার্ড জমা দিই আব্বুর কাছে। গাড়ির চাবি দিয়ে দিই। তারপর চাকরি শুরু করি। প্রতিদিন উবারে যাতায়াত করতাম। সবার সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে খেতাম। যে জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম না কখনো, সেটাই শুরু করি। আমার বেতন ধরা হয় ১২ হাজার টাকা। পোস্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার। সাড়ে পাঁচ মাস চাকরি করার পর আব্বু আমাকে টাকা দিতে রাজি হন। তিন কোটি টাকা নিয়ে শুরু করি 'হারনেট টিভি'।"
অনলাইনভিত্তিক টিভি চ্যানেল 'হারনেটে'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আলিশা প্রধান। 'হারনেট টিভি'র চেয়ারম্যান তার মা হোসনা প্রধান।
এশিয়ার প্রথম নারীভিত্তিক অনলাইন টেলিভিশন চ্যানেল এটি বলে জানান আলিশা। এতে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা, সফলতা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হবে। সামাজিক উন্নয়ন ও সচেতনতামূলক বিষয়গুলোও রাখা হবে এর সূচিতে। পাশাপাশি জেন্ডার ইকুয়েলিটি নিয়ে কাজ করছেন তারা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমি দেশের নারীদের কল্যাণে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিজনেস শুরু করেছি। এরমধ্যে ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই সামনে এগোতে চাই।'
এক সময়ের ব্যস্ত মডেল ও অভিনেত্রী আলিশা এখন 'হারনেট টিভি', 'হারনেট ফাউন্ডেশন', 'আসবেন টেক লিমিটেড' ও 'আসবেন ট্রাভেলস' নামে চারটি কোম্পানি পরিচালনা করেন।
এখন বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকেন আলিশা। সারাদিন মিটিং করতে হয়। ক্লায়েন্ট মিটিং, স্পন্সরদের সঙ্গে মিটিং থেকে শুরু করে নিজেদের স্টাফদের সঙ্গে মিটিং। 'চেষ্টা করছি দেশের মানুষের জন্য বিশেষ করে নারীদের জন্য কিছু করার। দেখা যাক কতটুকু কী করতে পারি,' যোগ করেন তিনি।