আজ থেকে ৬০ বছর আগেও হংকংয়ে ছিল বাঘের দৌরাত্ম্য!
১৯২৯ সালে হংকং এর গ্রামাঞ্চলে এক বৃটিশ পুলিশ অফিসার কৌতুহলবশত দুজন পথচারীকে দাঁড় করান, তারা একটি বাঘকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। আহত বাঘটিকে পুলিশ হংকং এর একটি পার্কে পাঠিয়ে দেয়, এবং সেখানেই বাঘটি মারা যায়। পরে এক পুলিশ সদস্য বাঘটির চামড়ার মালিকানা পায়। হংকং টেলিগ্রাফে সেবছর এই ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
হংকং এর বাঘ সম্বন্ধীয় একটি বইয়ের উপর গবেষণারত সাংবাদিক জন সায়কি বলেন, এই একটি ঘটনাই প্রশ্ন জাগায়, আমরা শুনিনি এমন আরও কতো অসংখ্য ঘটনা ছিল। এধরণের ঘটনার পুপরাবৃত্তি সত্ত্বেও বিংশ শতকের শুরুতে তৎকালীন প্রাণীবিদ্যা বিশারদ ও জনসাধারণ হংকং এ বাঘের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। ১৯২০-১৯৬০ সালের স্থানীয় সংবাদপত্রে শতাধিক বাঘের দেখা পাওয়া সম্বন্ধীয় খবর খুঁজে পান সায়কি।
১৯১৪ সালে প্রধান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম ডেভিসের বাড়ির সামনে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেলে একটি স্থানীয় সংবাদপত্র লিখে, 'তিনি সবসময় অত্র এলাকায় বাঘের পদচারণার ব্যাপারে সন্দেহপ্রবন হলেও, এই ঘটনার পর আর কোনো সন্দেহই থাকে না।'
হংকং এ বাঘের বসবাস না থাকলেও কিভাবে বাঘের দেখা মিলতো? এ প্রশ্নের উত্তরে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চীনের মূল ভূখণ্ডে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবস্বরূপ দক্ষিণ চীনা বাঘদের খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেইসময় প্রায় ২০ হাজারের মতো এই প্রজাতির বাঘ দক্ষিণ চীনের পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত৷ তখনই খাদ্যের সন্ধানে সীমান্ত পেরিয়ে হংকং এ চলে আসতো। গবাদি পশু আক্রমণ করতো, কখনো বা মানুষ শিকারও করতো।
দক্ষিন চীনা বাঘ
চীনা সংস্কৃতিতে বাঘ একটি প্রভাবশালী প্রতীক। চীনা রাশিচক্রে সাদা বাঘ ক্ষমতার প্রতীক।
তবে, বাস্তবিকতা বলে শতাব্দী ধরে এই প্রাণীটি চীনে মানুষ শিকার করেছে। ফুজিয়ান নরমাল ইউনিভার্সিটির প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহশালার সংরক্ষিত তথ্যানুযায়ী, ফুজিয়ান, জিয়াংজি, হুনান ও গুয়াংদং এই ৪টি প্রদেশের ১০ হাজারের বেশি মানুষ বাঘের কবলে পড়ে নিহত বা আহত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হ্যারি কাল্ডওয়েল নামের এক খ্রিস্টান মেথডিস্ট চীনে ধর্মপ্রচার করতে আসেন। তিনি গ্রামবাসীর মনজয় করতে তাদের বাঘ মারার পদ্ধতি শেখান। তিনি তার বন্দুক দিয়ে একটি বাঘ মেরে দেখান এবং এরপর প্রায় সম্পূর্ণ গ্রামবাসী ধর্মান্তরিত হয়। হ্যারি তার জীবনীগ্রন্থ 'ব্লু টাইগার' এ এসব ঘটনা লিখে যান। হ্যারি গর্বভরে তার ৫০টির মতো দক্ষিণ চীনা বাঘ হত্যার কথা প্রচার করতেন। উইলিয়াম লর্ড স্মিথের মতো বৃটিশ শিকারীরা এ অঞ্চলে শিকারে আসে। সেইসময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে বহু মানুষ গ্রামঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। জনসাধারণ ক্রমাগত বন্দুক দিয়ে বাঘ হত্যা করতে থাকে। ফলস্বরূপ, ১৯০৫ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যেই বাঘের সংখ্যা ২০ হাজার থেকে কমে ৪ হাজারে নেমে আসে।
১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়না। দক্ষিণ চীনে বাঘের মতো ফসল বিনষ্টকারী ও গবাদিপশুর জন্য হুমকিস্বরূপ প্রাণীর উপর কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতো। গুলি করে, ফাঁদে ফেলে বা বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হতো। ফলে বাঘেরা অন্যদিকে চলে যেতে শুরু করে। তখনই হংকং এ হঠাৎ করে বাঘের আনাগোনা বেড়ে যেতে থাকে।
হংকং এর বাঘ
হংকং এ বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো জায়গার তুলনায় বেশি গগনচুম্বী অট্টালিকা থাকলেও, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এটি কেবল ২৮০,০০০ জনসংখ্যার একটি কৃষিভূমি ছিল। এই জনপদে প্রচলিত বাঘের ঘটনাগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় দুটি ঘটনা এখনো লোকমুখে প্রচলিত। প্রথম ঘটনাটি ১৯১৫ সালে। বৃটিশ উপনিবেশিক আমলে হংকং এর একটি গ্রামের আশেপাশে একটি বাঘের যাতায়াতের ঘটনা পুলিশকে জানালে তারা তা উড়িয়ে দেয়। তবে পরে একজন গ্রামবাসীর মৃত্যুতে, আর্নেস্ট গুচার নামের ২১ বছর বয়সী বৃটিশ পুলিশ অফিসার ঘটনার তদন্ত শুরু করে। আর্নেস্ট গুচার ও তার সহকর্মী কন্সটেবল রতন সিং এর যৌথ অভিযানে বাঘটি আক্রমণ করে, রতন সিং তৎক্ষণাৎ মারা যায় ও আর্নেস্ট আহত হয়। পরে ডোনাল্ড বার্নিংহাম নামের আরেক পুলিশ অফিসার গুলি করে বাঘটিকে হত্যা করেন। মৃত বাঘটিকে হংকং এর সিটি হলে ঝুলিয়ে রাখা, দর্শনার্থীদের ভীড়ে উপচে পড়ার অবস্থা হয়। বর্তমানে ঐ বাঘটির স্টাফ করা মাথা শহরটির পুলিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
প্রচলিত অন্য বাঘটির চামড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে হংকং এর স্ট্যানলে'র তিন হাউ মন্দিরে।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে হংকং এ বাঘের দেখা পাওয়া ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। বিভিন্ন সময় বাঘের দেখা পাওয়ার খবর মিললেও খবরগুলো প্রমাণ ছিলনা। বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাপারটি বোধগম্য ছিল, ততোদিনে চীনের মূল ভূখণ্ডেই উল্লেখযোগ্য হারে বাঘের সংখ্যা হ্রাস পায়।
সায়কি বলেন, 'তারা ৫০ এর দশকে অসংখ্য বাঘ হত্যা করে। ৭০ এর দশকে তারা বুঝতে শুরু করে চীনের অন্যতম এই প্রজাতির বাঘ তারা হারিয়ে ফেলতে বসেছে।'
মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে চীনা সরকার আইন করা বাঘ হত্যা নিষিদ্ধ করে। এই প্রজাতির বাঘের অবস্থা নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়। এই প্রজাতির বাঘকে বিলুপ্ত প্রজাতি ঘোষণা করা হয়। ধারণা করা হয়, মাত্র ৩০- ৫০ টি বাঘ মুক্ত পরিবেশে বেঁচে আছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের তথ্যমতে গত ২৫ বছরে চীনের কোথাও এই প্রজাতির একটি বাঘও দেখতে পাওয়া যায়নি। চীনের চিড়িয়াখানা ও প্রজনন কেন্দ্রে ১০০টির মতো এই প্রজাতির বাঘ আছে। চিড়িয়াখানার আবদ্ধ পরিবেশে জন্মানো নতুন বাঘ গুলোর মধ্যে জিনগত বিকৃতি দেখা গেছে। চীনা সরকার এই প্রজাতির বাঘকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়ার চিন্তা করলেও বিশেষজ্ঞরা এব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
সূত্র: সিএনএন