আমেরিকান বাঘপ্রীতি: ভালোবাসার নামে অমানবিকতার গল্প
এশিয়ার অরণ্যে যত বাঘ টিকে আছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, তবে বন্দি দশায়। বাঘ ও ওদের শাবকদের সঙ্গে ছবি তোলার লালসা আমেরিকানদের মধ্যে বাড়ছে দিন দিন। আর সেই আকাঙ্ক্ষার বলি হয়ে হাজারও বাঘের জীবন কাটছে শিকলবন্দি অবস্থায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তে, রাস্তার পাশে গড়ে ওঠে বেসরকারি চিড়িয়াখানাগুলোতে চলছে বাঘ প্রদর্শন।
জন্মের পরপরই মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে, বোতলে দুধ খাইয়ে, মানুষের হাতে বড় করা হয় বাঘ শাবকগুলোকে। বয়স ৩ মাস হওয়ার আগ পর্যন্ত ওদের এভাবেই লালন করা হয়। তারপর ওরা সামলানোর পক্ষে যথেষ্ট বিপজ্জনক হওয়ার মতো বড় হয়ে যায়।
তবে ওদের কারও কারও হাড় ও অস্থি বিকাশে সমস্যা হয়। কেননা, একেবারেই অল্প বয়সে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ায় যথাযোগ্য পুষ্টি ওরা পায় না। একইসঙ্গে, মা বাঘিনীগুলো খাঁচায় ফিরে যায় আবারও ভবিষ্যৎ শাবক গর্ভধারণের জন্য।
'এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। আর এ খুবই অমানবিক ব্যাপার,' বলেন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার স্টিভ উইন্টার।
গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বাঘের এমন নিয়তির দিকে নজর রেখেছেন স্টিভ; আর ওগুলোর বন্দিদশা, অপব্যবহার ও নিপীড়িত হওয়ার দৃশ্য করেছেন ক্যামেরাবন্দি। সেগুলো থেকে কিছু দাপুটে ছবিকে বড় করে তোলা হবে এ সপ্তাহে। আগামী মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে 'ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার' অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হবেন তিনি, ওইসব বাঘের ছবি থেকে নির্বাচিত পোর্টফোলিওর জন্য।
গত সপ্তাহে ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'দ্য অবজারভার'কে স্টিভ বলেছেন, প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের কাছাকাছি গিয়ে ও শাবক জড়িয়ে ধরে ছবি তোলার জন্য রাস্তার পাশের চিড়িয়াখানাগুলোর কিছু দর্শণার্থী কয়েক শ ডলার পর্যন্ত হাসিমুখে খরচ করেন। তাদের কারও কারও আচার-আচরণ ওই প্রাণীগুলোর জন্য ক্ষতিকারক ও অবমাননাকর বলেও মন্তব্য করেন স্টিভ।
সংরক্ষিত প্রাণীর মর্যাদা ভুলুণ্ঠনের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, এইসব চিড়িয়াখানা "ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। ওই প্রাণীগুলোর মর্যাদাকে তোয়াক্কা করা হয় না। সেখানে গেলে তাই হয়তো একটা সুন্দর প্রাণীর (বাঘ) দেখা আপনি পাবেন, তবে সেটি বন্য প্রাণীর মতো আচরণ করবে না; 'বন্য' যে কী জিনিস- এই প্রাণী তো জানেই না!"
মধ্য-আমেরিকার দুয়েকটি সমস্যা সংকুল এলাকায়ই যে এ ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে, তা নয়। স্টিভের পোর্টফোলিওতে জায়গা পেয়েছে ইলিনয়, ওকলাহোমা, মন্টানা, ডেনভার, ওহিও ও সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্য থেকে তোলা ছবিও। 'যদিও বাঘ একটি বিপন্ন প্রজাতি; তবু দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) সবখানেই এগুলোর এভাবে প্রদর্শনী করা হচ্ছে।'
অন্যদিকে, নেটফ্লিক্স সিরিজ 'টাইগার কিং'-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে বলে ধারণা স্টিভের। 'ওই প্রোগ্রামের পর এ (চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘের সঙ্গে ছবি তোলার) ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ ব্যাপক বেড়ে গেছে। এখন কোভিড মহামারি না চললে, পরিস্থিতি সামলানো মুশকিল হতো।'
তার পোর্টফোলিওতে জায়গা পাওয়া ছয়টি ছবির মধ্যে রয়েছে দেখতে ক্ষীণকায় ও রোগা শাবকদের এক ছবি। অন্য ছবিগুলোর মধ্যে 'টাইগার সাফারি'তে তোলা ছবিতে বাঘকে সার্কাসের কৌশল দেখাতে এবং কিছু ছবিতে সুইমিংপুলে মানুষের সঙ্গে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়। 'দেশটির বেশিরভাগ রাজ্যেই বন্য প্রাণীর প্রদর্শন করাটা কোনো রেসকিউ সেন্টার থেকে কুকুর কিংবা বিড়াল দত্তক নেওয়ার চেয়েও সস্তা ও সহজ,' বলেন স্টিভ।
তিনি জানান, বাঘের সঙ্গে কী হচ্ছে- সেটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্যান্য দেশের মানুষেরও জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ। 'সারা পৃথিবীতেই বিগ ক্যাট প্রজনন ইন্ডাস্ট্রি বাড়ছে। যেমন ধরুন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঘের ফার্মগুলো এতই বেড়ে গেছে, দেশটি পৃথিবীতে জ্যান্ত বাঘ রপ্তানিতে এক নম্বরে রয়েছে। পূর্ব ইউরোপেও এ ধরনের কার্যক্রম চলছে।'
'এ ধরনের বহু সংস্থাই দাবি করে, বাঘ সংরক্ষণে সাহায্য করতে তারা টাকা দেয়। তা-ই যদি হয়, তারা হয়তো বছরে একবার মাত্র কয়েক শ ডলার দেয়; কিন্তু বিগ ক্যাট শোষণ করে দিনেই তারা কামিয়ে নেয় ৫০ হাজার ডলার- এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না।'
যুক্তরাষ্ট্রে একটি 'বিগ ক্যাট পাবলিক রেসকিউ অ্যাক্ট'-এর মাধ্যমে বাঘ প্রজনন ব্যবসার শেষ টানতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি এখনো কংগ্রেসে বিতর্কাধিন। সমর্থকরা বলছেন, এর ফলে ফটো প্রপ হিসেবে শাবকের ব্যবহার এবং বাঘ প্রজননের অমানবিক গতি থামানো যাবে। 'কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন যে রকম, তাতে এমনটা কখনো ঘটবে কি না, কে জানে,' হতাশ কণ্ঠে জানান স্টিভ।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান