আলাউদ্দিন সুইটস: যে গল্পের শুরু দেড়শ বছর আগে
১৫৬ বছরের পুরনো এই দোকানটি আজকের দিন পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী।
উনিশ শতকের কথা, যখন প্রযুক্তির কোনো ব্যবহার ছিলনা জনজীবনে, তখন হালখাতা ছিল ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক হিসেব-নিকেশ টুকে রাখার মুল সম্বল। হালখাতা হচ্ছে হাতেলেখা ঐতিহ্যবাহী এক হিসেবের দলিল, যেখানে ব্যবসায়ীরা নিজেরদের লাভ ক্ষতির হিসাবের সব তথ্য লিখে রাখতো।
তখনকার বাজার আজকের মতো এতো বিস্তৃত ছিল না, তবে ব্যবসায়ীরা সবসবমই থাকতো ব্যবসা প্রসারের সুযোগের অপেক্ষায়, তাদের মাঝেই একজন আলাউদ্দিন হালওয়াই, ভারতের লাখনৌ এর একজন সফল মিষ্টি প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ী।
ঠিক কখন ব্রিটিশ ভারতে মিষ্টির ব্যবসা শুরু হয় এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য না থাকলেও আলাউদ্দিন সুইটসের সাথে বাংলা অঞ্চলের সম্পর্কটা বেশ পুরনো, যার শুরুটা ব্রিটিশ শাসন আমলেই।
১৮৬০ সালের দিকে ভারতের লখনৌতে সাফল্যের সাথে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করার পর আলাউদ্দিন হালওয়াই সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা প্রসার করার। যার ফলশ্রুতিতে সে ঘুরতে থাকেন ভারতের মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চল গুলোয় এবং শেষমেশ বাংলাকে বেছে নেন তার ব্যবসার নতুন কেন্দ্র হিসেবে।
এর চার বছর পর তিনি ঢাকার চকবাজারে তার মিষ্টির দোকান শুরু করেন।
আলাউদ্দিন সুইটসের বর্তমান স্বত্বাধিকারী এবং আলাউদ্দিন হালওয়াই পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের সদস্য মারুফ আহমেদ বলেন, "১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আলাউদ্দিন সুইটস এর ঠিকানা ঢাকার চকবাজারে। এই এলাকায় আমার প্রপিতামহ-শ্বশুর লাখনৌ'র পর প্রথম শাখা খুলেছিলেন। ১৮৬৪ সাল থেকে ঢাকায় আলাউদ্দিন হালওয়াই এর কার্যক্রম চলছে, যেখানে প্রথমদিকে পাওয়া যেত রসগোল্লা, গোলাপ জাম, সন্দেশ।"
ইতিহাসের সাক্ষী
মারুফ তাদের সাফল্যের রহস্য উন্মোচন করে বলেন-- ধারাবাহিকভাবে ভাল মানের পণ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্য- এই দুটোই আলাউদ্দিন সুইটসকে গ্রাহকদের মাঝে দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলে। যদিও, লাখনৌর দোকান কখনো বন্ধ হয়নি এবং তা এখনো চালু আছে। মারুফ বলেন, "লাখনৌয়ের মূল দোকানটি আলাউদ্দিন হালওয়াইয়ের পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন। আলাউদ্দিন খুব মেধাবী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি জানতেন ঠিক কি করতে চান। দুটি দোকানের কাজ চলেছে একে অপরের থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে, তবু সফলভাবে ব্যবসা রপরিচালিত হয়েছে। দিনকে দিন জনপ্রিয়তা বেড়েছে আলাউদ্দিনের মিষ্টির।
বাংলায় আলাউদ্দিনের ব্যবসা দ্রুত প্রসারিত হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ বাংলার মানুষ মিষ্টি ভালবাসে। ১৮৯৪ সালে আলাউদ্দিনের ব্যবসাকে এখানকার মানুষের সঙ্গে আরও একাত্ম করতে নাম পরিবর্তন করে "আলাউদ্দিন সুইটমিট" রাখা হয়।
কিন্তু গল্পটার শেষ এখানেই নয়। বরং এটা কেবল শুরু ।
১৫৬ বছরের পুরনো এই দোকানটি আজকের দিন পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী।
মারুফ টিবিএস প্রতিনিধিকে বলনে "আলাউদ্দিন হালওয়াই ব্রিটিশ শাসনামলেই মারা যান, এরপর তার ব্যবসার সিলসিলা তার পুত্র কাঁধে তুলে নেন সফলভাবে। এই মিষ্টির দোকান মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন দেখেছে, যা ব্রিটিশদের হটানোতে ভূমিকা রাখে এবং সাক্ষী হয়েছে ১৯৪৭ সালের সেই দাঙ্গার যা ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙ্গে জন্মদিয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের।"
ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর ঢাকা ও লখনৌ এর মাঝে প্রথম স্থাপিত হয় সীমানার কাঁটাতার, কিন্তু তা আলাউদ্দদিন সুইটস-এর ব্যবসার জন্য তেমন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
মারুফ বলেন, "চকবাজারের দোকানটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী। তিনি আরো বলেন, অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র নেতা-কর্মী নিয়মিত দোকানে আসতো সকালের নাস্তা বা জলখাবারের জন্য ।
প্রতিকূল দিনগুলো পাড়ি দেওয়া
তবে এমন নয় যে আলাউদ্দিন সুইটসের সময় চিরকালই আনন্দে কেটেছে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত হয়েছে আলাউদ্দিন সুইটস'ও।
১৯৭১ সালে আলাউদ্দিন সুইটস ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, আলাউদ্দিন সুইটস শেষ হয়ে যায়নি ওই ঘটনায়, সেই বিপর্যয় থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হয়, স্বাধীনতার পর আলাউদ্দিন সুইটস লাভজনক ব্যবসার সীমানা অতিক্রম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে সহায়তা করাকেও প্রধান প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বর্তমানে আলাউদ্দিন সুইটস সাভার ও গাজীপুরে দুটি এতিমখানা ও মাদ্রাসা পরিচালনা করে। কিছু স্কুল এবং মসজিদ এখনও পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে।
যুদ্ধের ১২ বছর পর, ১৯৮৩ সালে, ব্র্যান্ডকে আরও অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটি লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রসার, যার ফলশ্রুতিতে লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে শাখা খোলা হয় প্রতিষ্ঠানটির, যা আজও সেখানে সুনাম অর্জন করে ব্যবসা চালু রেখেছে।
সেই সময় আলাউদ্দিন সুইটস লাচ্ছা সেমাইকে ঈদের সময় প্রতিটি বাঙ্গালী পরিবারের জন্য একটি অপরিহার্য মিষ্টান্ন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতসহ আরও বেশ কিছু দেশে রপ্তানি করা শুরু করে লাচ্ছা সেমাই।
তবে ১৯৯৯ সালে চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদত্যাগ করার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা কমতে শুরু করে। প্রায় ১১ বছর সংগ্রাম করার পর ২০১০ সালে মারুফ আহমেদ দায়িত্ব নিলে আলাউদ্দিন সুইটস আবার বিকশিত হতে শুরু করে নতুনভাবে।
২০১০ সাল থেকে মারুফ আহমেদ চকবাজার শাখার দেখাশোনা করছেন। কথোপকথনের সময়, তিনি ব্যবসা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক কথা জানান।
মহামারী সৃষ্ট স্থবিরতা
মারুফ জানান, এই মহামারী ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছে আমাদের।
তিনি আরও জানান, "প্রতিবছর রমজান মাসে আমরা ইফতার পার্টি গুলোতে লাগাতার ক্যাটারিং এর অর্ডার পেতাম, ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ও সরকারী অনুষ্ঠানগুলো থেকেও অর্ডার আসতো। কিন্তু এই বছর মহামারীর কারণে আমাদের কাছে কোনো অর্ডার আসেনি।"
"তারপররেও এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে আমরা বেশীরভাগ কর্মী ধরে রেখেছি"। তিনি বলেন, "আমাদের এমনও দিন গেছে যখন আমরা কিছুই বিক্রি করতে পারিনি, তবুও আমরা এখনো আমাদের কোন কর্মচারীকে ছাটাই করিনি,"
৮০ বছর বয়স্ক করিম গত ৬০ বছর ধরে আলাউদ্দিন সুইট মিটের সাথে কাজ করছেন। তিনি বলেন যে তিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে বরিশাল থেকে ঢাকা শহরে চলে আসেন এবং চকবাজারের দোকানে চাকরি নেন।
তিনি হাসিমুখে জানান, "আমি কখনওই এই দোকান ছাড়তে পারবো না"।
উজ্জল অতীতের মশালবাহক
এই দোকানে এখনও অতীতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ছোট দোকানে ঢোকার পর, আপনি ডান দিকে একটি কাউন্টার দেখতে পাবেন, যা এখনও ম্যানুয়ালি পরিচালিত হয়। বামে অনন্য নাম এবং রঙের বিভিন্ন মিষ্টির একটি বড় প্রদর্শনী আছে। শেষ প্রান্তে একটি টেবিল এবং চারটি চেয়ার আছে যেন দোকানে আসা মানুষ ভিতরে বসে খেতে পারেন।
অন্যান্য অনেক সুসজ্জিত মিষ্টির দোকানের মত, আলাউদ্দিন মিষ্টির সাজসজ্জা তেমন নেই। ঝলমলে চাকচিক্যের কোনো বাহুল্য নেই। তাই আলাউদ্দিন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে কিভাবে প্রতিযোগিতা করছেন? সে বিষয়ে জানতে চাইলে মারুফ বলেন, "আমরা উচ্চ মানের পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখি এবং এটাই আমাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।"
মেনুতে মিষ্টির পাশাপাশি টোস্ট বিস্কুট এবং চানাচুর সহ বৈচিত্র্যময় কিছু আইটেম রয়েছে। বর্তমানে আলাউদ্দিন লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট বিস্কুট, চানাচুর এবং ঘি রপ্তানি করছেন।
মারুফ বলেন, "আমাদের সারা ঢাকা জুড়ে সাতটি দোকান আছে এবং আমরা নিশ্চিত করি যে আপনি প্রতিটি দোকানে একই মানের মিষ্টি পাবেন।"
এটা নিশ্চিত করতে আমরা সব রকমই ব্যবস্থাই নেই, শ্রমিকরা বাই রোটেশনে কাজ করে। তাতে কর্মীরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার মান তুলনা করতে পারে, এরফলে কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে তা সহজেই ঠিক করা যায়।
মারুফ বলেন, "আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং খাদ্য পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি এবং আমাদের সকল কর্মচারীকে এর জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।" তিনি আরও বলেন যে আলাউদ্দিনের প্রতিটি আইটেম প্রতিদিন সকালে কারখানার শোরুমে সরবরাহ করা হয় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভ্যানে করে।
পণ্যের বৈচিত্র
বর্তমানে আলাউদ্দিন তাদের আগের পণ্যের সঙ্গে যোগ করেছে: বিভিন্ন ধরনের বরফি, মতিচুর লাড্ডু, মাওয়া লাড্ডু এবং এমনকি কাপকেক উৎপাদনেও বিস্তৃত হয়েছে তাদের উৎপাদন। উৎসবের জন্যও উপহার বাক্স চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মারুফ বলেন, "আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন মানের মিষ্টি এবং গ্রাহকদের সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা।" তিনি বিশ্বাস করেন যে এই পদ্ধতি তাদের গ্রাহকদের কাছে উন্নত মান নিশ্চিত করবে এবং বাজার কার্যক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বজায় রাখবে।
আলাউদ্দিনের উত্তরাধিকার একটি বিশ্বস্ত সিলসিলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর ফলে, এটি আন্তর্জাতিক চাহিদার একটির নির্ভরশীল অংশে পরিণত হয়েছে। আলাউদ্দিন সুইটমিটের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এখন বিদ্যমান কারখানাগুলিকে আধুনিকীকরণ এবং সম্ভব হলে আরও সম্প্রসারণ করা।
আলাউদ্দিন সুইটস ফুডপান্ডা এবং পাঠাও সহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করেছে, কিন্তু তারা এখনো তাদের ফেসবুক পাতার মাধ্যমে অর্ডার নেওয়া শুরু করতে পারেনি। তবে এখন ফোন কলের মাধ্যমে অর্ডার করা যায়।
পুরনো ঢাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির সফল কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় মারুফ আশা করছেন যে, তার ব্যবসা "নতুন" ঢাকায় আরও সম্প্রসারিত হবে এবং তিনি বিদেশেও দোকান খুলবেন। তিনি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করতে চান এবং জানান সেক্ষেত্রে সরকারী সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।