যশোরের জামতলার সাদেকের মিষ্টি ৬ দশক পরেও সমান জনপ্রিয়
যশোরের শার্শার জামতলা বাজারে অবস্থিত সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডার। ছয় দশকের বেশি সময়েও কমেনি স্বাদে অতুলনীয় ঐহিত্যবাহী এ মিষ্টির কদর। বরং বর্তমানে মিষ্টির সুখ্যাতি এখন যশোরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। সকাল, দুপুর-কি-সন্ধ্যা; ক্রেতাদের জটলা লেগেই থাকে এ দোকানে। জেলা বা দেশের বাইরে থেকে যশোর বেড়াতে এলে জামতলার মিষ্টির স্বাদ নিতে ভোলেন না মিষ্টিপ্রেমীরা।
প্রায় ৬৭ বছর আগে মিষ্টির দোকানটির সূচনা করেছিলেন শেখ সাদেক আলী। সাদেকের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেছেন তার ছয় ছেলে। জামতলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে তাদের ৬টি আউটলেট রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এসব দোকান থেকে মিষ্টি কেনেন। দামে সাশ্রয়ী ও মানে ভালো হওয়ায় সন্তুষ্ট ক্রেতারাও।
সাদেক আলীর বড় ছেলে আনোয়ার হোসেন জানান, ১৯৫৫ সালে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে অবস্থিত জামতলা বাজারে চায়ের দোকানদার ছিলেন শেখ সাদেক আলী। প্রতিদিন গোয়ালারা তার দোকানে গরুর দুধ দিয়ে যেতেন। একদিন প্রয়োজনের তুলনায় দুধের পরিমাণ বেশি হলে সাদেক প্রথমে দুধ কিনতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
'তখন কুমিল্লার এক ব্যক্তি সাদেক আলীকে ওই দুধ রেখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনিই সে রাতে প্রথম মিষ্টি তৈরি করেন। তার থেকে শেখা পদ্ধতিতে এরপর সাদেক আলী মিষ্টি তৈরি করা শুরু করেন,' বলেন আনোয়ার।
প্রথমে সাদেক গোল্লা নামে পরিচিত হলেও পরে এটি উৎপত্তিস্থলের নামে জামতলার মিষ্টি হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাদেক নিজেই মিষ্টি তৈরি করেছিলেন।
সাদেকের মৃত্যুর পর তার ছয় ছেলে আনোয়ার, আলমগীর, শাহিনুর, শাহজাহান, জাহাঙ্গীর ও নূরুজ্জামান ব্যবসায়ের হাল ধরেন। জামতলায় এখন সাদেক গোল্লার ৩টি দোকান রয়েছে। বাকি ৩টি যশোরের নাভারন বাজারের সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ড, শহরের দড়াটানা ও নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থিত।
জামতলা বাসস্ট্যান্ডের বটতলায় অবস্থান সাদেক আলীর প্রতিষ্ঠিত আদি 'সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডার'। দোকানটিতে রসগোল্লা ছাড়াও প্রায় সব ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এখান থেকেই জামতলার মিষ্টি সরবরাহ করা হয়।
জামতলার মিষ্টির কারিগর বজলুর রহমান সাদেক আলীর কাছ থেকেই মিষ্টি বানানো শিখেছেন। তিনি জানালেন তাদের এ বিখ্যাত মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া। 'প্রথমেই দুধ জ্বালিয়ে ছানা তৈরি করি। এরপর ছানা থেকে পানি ঝরিয়ে শুকিয়ে তার সঙ্গে হালকা সুজি মিশিয়ে সেটাকে গোল গোল মণ্ড তৈরি করি।
'তারপর চিনির শিরাতে অল্প আঁচে এ ছানার বলগুলোকে বাদামী বর্ণ হওয়া পর্যন্ত সেদ্ধ করি। বাদামি রং ধরলেই সেগুলো হয়ে যায় সাদেক গোল্লা।'
সাদেক গোল্লা তিন আকারে চার প্রকার প্যাকেটে সরবরাহ করা হয়। পলিথিনের প্যাকেটে পাঁচ টাকা দামের ২০টি, ১০ টাকা দামের ১০টি, ২০ টাকা দামের ৫টি এবং সাদা রঙের ১২ টাকা দামের ১০টি করে মিষ্টি বিক্রি করা হয়।
ইসহাক হোসেন নামক এক ক্রেতা বলেন, 'বর্তমানে অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সাদেক গোল্লার বিশেষত্ব হলো এতে চিনির পরিমাণ কম। তাই যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তারা এ মিষ্টি খেতে পারেন।' কলেজশিক্ষক তৈয়ব হোসেন জানান, সাদেক মিষ্টির জনপ্রিয়তার কারণ, বাজারের অন্য মিষ্টির চেয়ে এটি স্বাদে ভিন্ন। দুধ খাঁটি আর মিষ্টির প্রক্রিয়াকরণ ভালো। তাই এ মিষ্টির চাহিদা ক্রেতাদের কাছে বেশি।
যশোরের দড়াটানায় অবস্থিত জামতলার সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী ও সাদেক আলীর ছেলে শাজাহান কবীর বলেন, 'বাবার মৃত্যুর পর আমরা ছয় ভাই ধাপে-ধাপে ৬টি আউটলেট নিয়ে যাত্রা শুরু করি। সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে আমরা বাজারের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছি।'
মিষ্টির স্বাদ বা গুণগত মান পরিবর্তন হতে পারে এমন কোনো উপকরণ তারা মেশান না বলে জানান তিনি। এছাড়া সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
'আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা অনুপ্রাণিত করব যাতে এ শিল্পকে তারা ধরে রাখে। সে সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সাদেক গোল্লাকে মিষ্টির ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই,' বলেন তিনি।