উপসর্গহীন শিশু ও তরুণেরা আক্রান্ত হওয়ার তিন সপ্তাহ পরও সংক্রমণ ছড়ায়
করোনাভাইরাস নিয়ে খুবই সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার ফলাফল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গবেষণাগুলি এমন সময় প্রকাশ করা হয়, যখন বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ-বিরতির পর স্কুল- কলেজ খোলা হয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশেও তা করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
কিন্তু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিশু-কিশোর ও তরুণদের মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। নবীনেরা যে উপসর্গহীন করোনার ছড়ানোর বাহক হতে পারে- এমন প্রমাণ তারা দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অবস্থিত জাতীয় শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা দেখেন যে, সার্স কোভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার দীর্ঘ সময় পর পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। নিজেদের অজান্তেই তারা আশেপাশের ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। গবেষণার সবচেয়ে নতুন অনুসন্ধানটি হলো; এখানে বলা হচ্ছে, খুব সামান্য উপসর্গ দেখা যায় বা আক্রান্ত হওয়ার সম্পূর্ণ লক্ষ্মণবিহীন শিশুরাও এটি ছড়াতে পারে।
এর আগে বোস্টনের একদল গবেষক শিশু এবং তরুণদের দেহে বিস্ময়কর মাত্রায় ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন।
উপসর্গহীন শিশুরা কীভাবে ভাইরাস ছড়ায়?:
গত ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন শিশু হাসপাতালের গবেষণাটি প্রকাশিত হয় শিশু চিকিৎসার শীর্ষ বৈজ্ঞানিক জার্নাল জামা পেডিয়াট্রিক্স-এ। রবের্টা এল.ডিবিয়াসি এবং মেগ্যান ডিলানি নামের দুই গবেষক দক্ষিণ কোরিয়ার ২২ টি হাসপাতালের ৯১ শিশুকে পর্যবেক্ষণের ফলাফল সেখানে প্রকাশ করেছেন।
ডিবিয়াসি জানান, ''মার্কিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপরীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হলে, সম্পূর্ণ সেরে ওঠার আগপর্যন্ত- আক্রান্তকে হাসপাতালেই অবস্থান করতে হয়।''
অর্থাৎ, শিশুদের সকলেই সার্স কোভ-২ আক্রান্ত ছিল। কিন্তু, তাদের ২২ শতাংশের দেহে সম্পূর্ণ সংক্রমণকালে বা তারা যতদিন আক্রান্ত ছিল- ওই সময়ে কোনো প্রকার উপসর্গ দেখা দেয়নি। আরো ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংক্রমিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে তারা উপসর্গহীন ছিল। তবে পরবর্তীকালে তাদের দেহে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। বাকি ৫৮ শতাংশ ছিল স্পষ্ট উপসর্গযুক্ত।
আক্রান্ত হওয়ার পর তিনদিন থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায় শিশুদের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় লেগে যাওয়ার বিষয়টিই মূলত উদ্বিগ্ন করেছে স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টদের।
তাছাড়া, উদ্বেগের কারণ আরো আছে। আক্রান্ত হওয়া শিশুদের মধ্যে যারা উপসর্গহীন- তাদের এক-পঞ্চমাংশ এবং উপসর্গযুক্ত শিশুদের প্রায় অর্ধেককে সংক্রমিত হওয়ার তিন সপ্তাহ পর পর্যন্ত দ্রুত ভাইরাসের বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। অবশ্য এটি শিশুদের নিজেদের ক্ষেত্রে অতি-মাত্রায় ভাইরাস সংক্রামক হওয়ার বিষয়টি নির্দেশ করে না। করোনাভাইরাস বিস্তারে তরুণ এবং শিশুদের ভূমিকা জানতে, এখনও বিস্তর অনুসন্ধান দরকার বলে স্বীকার করেছেন গবেষকরা। সাম্প্রতিকতম অনুসন্ধানের ফলাফল তাই নতুন করে বিতর্ক উস্কে দেবে বিশেষজ্ঞ মহলে।
বয়সের তুলনায় অধিক সংখ্যক ভাইরাস থাকতে পারে শিশুর দেহে:
বোস্টনের গবেষকরা বলছেন, তরুণ এবং শিশুদের মধ্যে অতি উচ্চ-মাত্রার ভাইরাস উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন তারা। এ গবেষণার আওতায় তারা ৪৯ জন- শিশু এবং ২১ বছরের কম বয়সীর নাক ও গলা থেকে সোয়াবের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করেন।
বিশ্লেষণের পর দেখা যায়, নবীনদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় ভাইরাসের উপস্থিতি থাকা স্বত্বেও তারা সাবলীল আছে। অথচ তাদের চাইতে অনেক কম পরিমাণে ভাইরাস সংক্রমণের শিকার- প্রবীণদের গুরুতর অসুস্থতার কারণে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
বোস্টনের গবেষণাটি চলতি মাসের শুরুতে বা পহেলা আগস্ট প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত নিবন্ধ সূত্রে জানা গেছে, শরীরের কোষে সার্স কোভ-২ ভাইরাস যুক্ত হওয়ার এস২ রিসেপ্টর ছোট শিশুদের মধ্যে বয়স্ক বা তরুণদের তুলনায় খুবই কম সংখ্যায় থাকে।
তবে শিশুরা কী ক্ষুদে সংক্রমণ বাহক?:
করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ যেদিন ধরা পরে, সেদিক থেকেই শিশু এবং তরুণরা সংক্রমণ ছড়াতে কী ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। একটা বিষয় পরিষ্কার; শিশু এবং তরুণেরা অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। তাছাড়া, আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে সংক্রমণের কোনো লক্ষ্মণ নাও দেখা যেতে পারে, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো সেই বিষয়টি প্রমাণ করেছে। আরো প্রমাণ করেছে যে, করোনার সংস্পর্শে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে তরুণ ও শিশুরা।
অবশ্য এর মানে এই নয় যে, শিশু-কিশোর ও তরুণেরা ভাইরাস সংক্রমণের মারাত্মক উৎস। এটাও মনে করাটাও ভুল হবে যে, তাদের মাধ্যমেই আশেপাশের সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু, তারপরও এটা সত্য যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পাঠদানে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বা খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে শিশু ও তরুণেরা অনেক বেশি সামাজিক সংস্পর্শে আসে বড়দের তুলনায়।
বিগত কয়েক মাসে বড়দের মতোই ছোটদের সামাজিক দূরত্ব এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিধি অবজ্ঞা করতেও দেখা গেছে। এতে প্রমাণিত হয়, বয়স মুখ্য বিষয় নয়, বরং বাধ্য করার চাপ না থাকলে বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করে যে কেউ নিজ এবং আশেপাশের মানুষের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
জার্মানিতে বিধিনিষেধ শিথিলের পর মানুষের উৎসবে বা পার্টিতে যোগ দেওয়ার মাত্রা যেভাবে বাড়ে- তাতে গত এপ্রিলের পর এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কোভিড সংক্রমণ লক্ষ্য করছে ইউরোপের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্রটি।
- সূত্র: ডয়েচে ভেলে