একটি মারণযন্ত্রের মৃত্যু
স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় রবার্ট কাপার বিখ্যাত ছবিটির কথা ভাবতে পারেন। এটি ঠিক সেই মুহূর্তে তোলা যখন একটি মাত্র গুলিতে থেমে যান অগ্রসরমান এক সেনা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া লোকটি যখন পেছনে পড়ে যাচ্ছিলেন, তখনো তার ছড়ানো দুই হাতের মধ্যে ডানটিতে ছিল এনফিল্ড .৩০৩ রাইফেল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাটেল অব দ্য সোমের সময়কার একটি ছবির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। পরিখার উপর উঠে বেয়নেটযুক্ত .৩০৩ এনফিল্ড রাইফেল দিয়ে জার্মান বাহিনীকে আক্রমণে উদ্যত ছিল ব্রিটিশ পদাতিক সেনারা। কিন্তু জার্মান সেনারা তাদের গতিরোধ করে।
এর বাইরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত ছবিটির কথা ভাবা যেতে পারে। ফ্রেমবন্দি তিন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যাদের একজন দাঁড়িয়ে ও অপর দুজন মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তাদের .৩০৩ রাইফেলগুলো তাক করে ছিলেন।
১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এনফিল্ড .৩০৩ রাইফেলের ব্যবহার শুরু করে। এটি সেই অস্ত্র যা দিয়ে বিশ্বের অন্য যে কোনো মারণাস্ত্রের চেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়েছে এবং এটি সবচেয়ে বেশি শত্রু খতম করেছে। একাত্তরে সম্ভবত এ রাইফেল দিয়ে গুলি করেই পাকিস্তানি সেনারা আমার আপন ভাইকে হত্যা করেছে।
সেদিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, যেদিন ঢাকার ইন্দিরা রোডে আমাদের বাড়ির সামনে কয়েকটি .৩০৩ রাইফেল আমার বাবা ও ভাইয়ের দিকে তাক করা হয়েছিল। আবারও একাত্তর, ট্রিগার না ছুড়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিদায়ের আগ পর্যন্ত বন্দুকের নলগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় মনে হচ্ছিল।
কাঠের শক্ত হাতলওয়ালা, ভারী ও নির্ভরযোগ্য এ রাইফেল খুব দ্রুতই ব্যবহার শুরু করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো। এটি দূরপাল্লার। কেউ কেউ বলেন, এ দিয়ে দেড় মাইল দূর থেকে কাউকে নিশানায় পরিণত করা যায়। তবে বাস্তবে এটা অসম্ভব। কারণ এ বন্দুকগুলো এতটাই লাফায় যে, ট্রিগার চাপার পর গুলি নিশ্চিতভাবেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপর শৈশবে এ ধরনের একটি বন্দুক দিয়ে একবার গুলি চালিয়েছিলাম। হাতেনাতে বুঝতে পারলাম, আমার কাঁধে যেন কোনো ঘোড়া লাথি মারছে; কাঁধটাকে শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আর আমার পুরো শরীর নড়ে উঠছে। সৌভাগ্যবশত গুলিটি কারো গায়ে লাগেনি।
কিন্তু এমন বাস্তবতার পরও এ অস্ত্রটিই ব্যবহার করতে হয়েছিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানকে। ৭০ বছরের বেশি ব্যবহারের পর সেই অস্ত্রটিকেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশেও .৩০৩ প্রায় ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এটি চলে গেছে পুলিশের কাছে। বর্তমানে বিখ্যাত অস্ত্রটির অল্প কিছু ব্যবহার করছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা।
তবে বন্দুকের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী এবং গোলমাল পাকানো। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ লড়াই করেছে একবারে একটি গুলি বের হওয়া, বোল্ট অ্যাকশন এ রাইফেল দিয়ে। একটা করে গুলি বের হওয়ার পর বোল্ট ধরে ফের টানতে হয়। রাইফেলের ছোট্ট ম্যাগাজিনে গুলি থাকে ১০টি।
প্রায় ৫ কেজি ওজনের অতি ভারী এ অস্ত্রটিই দারুণ কাজে লেগেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। কারণ এটি ছিল একই সঙ্গে শক্ত সামর্থ ও যে কোনো পরিস্থিতির উপযোগী।
বাংলাদেশে ভারী বর্ষণের মৌসুমেও কাদায় বন্দুকটির নল ঢেকে যেত না। এটাই ছিল মোক্ষম সময় যখন পাকিস্তানি সেনাদের জন্য ওত পেতে থাকতেন মুক্তিযোদ্ধারা।
.৩০৩ রাইফেল তৈরি হয়েছিল লন্ডনের উত্তরাঞ্চলীয় এনফিল্ডে। সোভিয়েত আমলের একে-৪৭ ও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এম১৬-এর পর .৩০৩কে সর্বকালের তৃতীয় সর্বোত্তম রাইফেল আখ্যায়িত করে ডিসকোভারি চ্যানেল।
এটি সেই রাইফেল যা দিয়ে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ওপর গুলি চালাতে অধীনস্থদের নির্দেশ দিয়েছিলেন পাঞ্জাবের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার। গুলিতে এক হাজারের মতো মানুষ মারা যায়, যারা রাওলাত আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছিলেন। গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা ওই আইনের মাধ্যমে বিনা বিচারে যে কাউকে আটক রাখা যেত।
এই অস্ত্র ব্যবহার করেই দু’টি বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজিত করেছিল ব্রিটিশরা। .৩০৩ রাইফেলের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ওমর শরিফ আকাবার দখল নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ে তালেবানের কাছে হাজারো .৩০৩ পাঠিয়েছিল। বর্তমানে এই বন্দুকটিই ব্যবহৃত হচ্ছে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে।
ভারতে জন্ম নেওয়া ইংরেজ কবি ও সাহিত্যিক রাডিয়ার্ড কিপলিং এই বন্দুককে কবিতায় রূপ দেন। তৎকালীন বার্মায় ব্রিটিশ এক সেনার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া এক ভারতীয় সেনাকে নিয়ে লেখা তার কবিতার শিরোনাম "দ্য গ্রেভ অব দ্য হান্ড্রেড হেড" (শত খুলির সমাধি)। তার কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল-
"জঙ্গল থেকে গুলি ছুঁড়ল এক স্নাইডার,
কেউ একজন হাসল, পালাল,
প্রথম শিকারিদের দলের লোকজন
তাদের মৃত সাবঅল্টার্নদের তুলে নিল,
তার কপালে ছিল বড় ক্ষত চিহ্ন,
আর মাথা থেকে গায়ের পেছনটা উড়ে গিয়েছিল।"
স্নাইডার, যার পুরো নাম জ্যাক স্নাইডার, বিখ্যাত .৩০৩ রাইফেল বানিয়েছেন। এত লোকের প্রাণ হরণ করা একটি মেশিনের উদ্ভাবক দিন শেষে কেমন বোধ করেছেন, তা জানা নেই আমাদের। তবে আমি নিশ্চিত, এর সমাপ্তিতে বেদনাহত হবেন ব্যবহারকারীরা।