কাঁঠাল দিয়ে তৈরি হবে দই, আইসক্রিম, চকলেট ও চিজ
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকার কাঁঠাল ব্যবসায়ী এরশাদুল ইসলাম। প্রতি বছর বাগান থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ করে জৈনা বাজারে পাইকারদের কাছে কাঁঠাল বিক্রি করেন তিনি। তবে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী এ ফলের অনেকগুলো একসঙ্গে পেকে গেলে তা সংরক্ষণ নিয়ে হয় নানা সমস্যা। বাজার মন্দার পাশাপাশি অনেক কাঁঠাল পেকে গেলে পাইকাররা নিতে চান না। ফলে অনেক কাঁঠাল গাছেই পেকে নষ্ট হয়। এছাড়া প্রক্রিয়াজাতের অভাবে ছয়ভাগের একভাগ কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই সেসব গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন বলে জানান এরশাদুল।
তার মতো অনেক চাষীই বলেন, ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় কাঁঠাল পেকে পচে নষ্ট হয় গাছেই। অনেক চাষী তিন ভাগের একভাগ দামে কাঁঠাল বিক্রি করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গেল মৌসুমে জেলায় ৯ হাজার তিনশ হেক্টরের বেশি জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে। এখান থেকে উৎপাদিত হয় দুই লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন কাঁঠাল। তবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ও কাঁঠাল সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এই ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা কাঁঠাল দিয়ে চিপস, আচার, কাটলেট, জ্যাম, জেলিসহ প্রায় ২০টি পণ্যের উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এছাড়া উদ্ভাবন করা হয়েছে কাঁঠালের পাল্প দিয়ে উন্নত মানের ও পুষ্টি সমৃদ্ধ দই, চকলেট, আইসক্রিম ও চিজ তৈরির উপকরণ ও প্রযুক্তি। এসব উদ্ভাবন কাঁঠাল সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
ইতোমধ্যে চিপস, আচার, কাটলেট, জ্যাম, জেলিসহ প্রায় ২০টি পণ্যের উপকরণ ও প্রযুক্তি তরুণ উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও সাড়া জাগিয়েছে। এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে অনেক উদ্যোক্তাই ইতোমধ্যে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। শুধু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাই নয়, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও এসব পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ বা দেশের বাইরে রপ্তানি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। তবে সম্প্রতি কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রসেসিং এন্ড মার্কেটিং অব জ্যাকফ্রুট প্রকল্পের মাধ্যমে কাঁঠালের পাল্প দিয়ে উন্নতমান, দারুণ স্বাদ ও অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ দই, চকলেট, আইসক্রিম ও চিজ তৈরির উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। পোস্টহারভেসট টেকনোলজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স ইউনিভারসিটির ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের চার ছাত্র এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তাকে সহায়তা করে।
বিএআরআই-এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত মোট কাঁঠালের ৪৩-৪৫ ভাগ শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায় । দেশের জাতীয় ফলের এ অপচয় রোধকল্পে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন হাতে নেয় পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রসেসিং অ্যান্ড মার্কেটিং অব জ্যাকফ্রুট নামে একটি গবেষণা প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের নানা উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে থাকে, যাতে উদ্যোক্তারা সারা বছরই বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে কাঁঠাল ব্যবহার করতে পারে। কাঁঠালের অপচয় রোধ, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, উদ্যোক্তা তৈরি, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাঁঠালের পণ্যের বড় ধরনের উৎপাদন কর্মের মাধ্যমে এটাকে শিল্পের মর্যাদা প্রদান, ব্যাপক কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা, সর্বোপরি কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা একের পর এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। তারা কাঁচা কাঁঠাল ও পাকা কাঁঠালের যেসব প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উদ্ভাবন করেছেন তা দেশের বড় বড় সুপার শপে বিক্রি হচ্ছে এবং ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
গত বছর ঢাকার কাওলার আছমা বেগম মিনা বাজারে ৩-৪ লক্ষ টাকার শুধু ফ্রেশ-কাট কাঁচা কাঁঠালই বিক্রয় করেন। কাঁঠালের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় এবার পাকা কাঁঠালের পাল্প দিয়ে মুখরোচক দই, পুষ্টিকর আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরির উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানিদের ধারণা, খুব স্বল্প মূলধন বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা এসব পণ্য নিয়ে কাজ করলে তারা সহজেই খুব বেশি লাভবান হতে পারবে এবং সারা বছরই তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বারির পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, "কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় এ বছর আমরা দই, পুষ্টিকর আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি । সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এগুলো তৈরি করতে দুধের সাথে শুধুমাত্র কাঁঠালের পাল্প প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যদি কোনো উদ্যোক্তা কাঁঠালের পাল্প সংরক্ষণ করেন, তবে সেগুলো দিয়ে সারা বছরই এসব পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন। কাঁঠাল যেহেতু নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি ফল, কাজেই পাল্প দিয়ে তৈরি করা পণ্যও সাধারণ বাজারের পণ্য থেকে অধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে। এখানে কোনো অতিরিক্ত কৃত্রিম রঙ বা ফ্লেভার ব্যবহার করা হয় না। পণ্যগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এবং দেখতেও খুবই সুন্দর। তিনি জানান, দই তৈরিতে শতকরা ৩-৫ ভাগ পাল্প ব্যবহার করা হয় । আইসক্রিম তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ৫-৮ ভাগ পাল্প। আর চিজ তৈরিতে ৫০-৬০ ভাগ পাল্প ব্যবহার করতে হয়। ফলে ক্ষুধা নিবারণ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব পণ্য নিঃসন্দেহে আদর্শ পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তৈরিকৃত খাদ্যগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরিও পাওয়া যাবে।"
"যে কেউ স্বল্প টাকা বিনিয়োগ করে এগুলি তৈরি করতে পারবেন। এসব তৈরি করতে তেমন বড় ধরনের কোনো যন্ত্রপাতির দরকার নেই। একটি ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর বা ছোটখাটো কিছু হোম মেড যন্ত্রপাতি দিয়ে এসব পণ্য খুব সহজেই তৈরি করা যাবে। যদি কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ৮০০ টাকার কাঁচামাল ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি খুব সহজেই ১৫০০ টাকার পণ্য তৈরি করতে পারবেন। অর্থাৎ বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ করতে পারবেন। আর দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি ব্যাপক পরিসরে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব পণ্য তৈরি করে, তাহলে দেশে এ সকল পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরি হবে। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে," বলেন তিনি।
ড. ফেরদৌস আরো বলেন, "কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর এর পাল্প দিয়ে সারা বছর ব্যবহার করা যায় এমন কী পণ্য উৎপন্ন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। যেহেতু প্রতি বছর পাকা কাঁঠালই বেশী নষ্ট হয়, কাজেই পাকা কাঁঠাল থেকে পাল্প সংগ্রহ করে তা সহজেই সারা বছর অতি সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। এ চিন্তা থেকেই দই, আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয় এবং সফলতাও আসে। ইতোমধ্যে আমাদের এখানে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স ইউনিভারসিটির ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের চারজন ছাত্র সমীক কর প্রান্ত, আবির হাসান রিজন, অভিক চাকমা ও আসম রাফসানজানি তাদের অ্যাকাডেমিক কোর্স শেষ করে ট্রেনিং করতে আসে। তাদের এ কাজে সম্পৃক্ত করি এবং সফলভাবে আমরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হই। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয়, কাজেই তারা যদি এসব প্রযুক্তি ঐ এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে সেখান থেকেও কাঁঠাল চাষী, উদ্যোক্তা বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।"
বিএআরআই এর পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান কৃষিবিদ মো. হাফিজুল হক খান বলেন, "প্রতি বছর আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল নষ্ট হয়। অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে কাঁঠালের বহুবিধ ব্যবহারের এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব। দই, আইসক্রিমসহ যে সব পণ্য উৎপন্ন করা হয়েছে, তা পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত ও লাভজনক হবে। আমরা যদি এ সেক্টরে প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরি করতে পারি, তাহলে এর ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হবে যা কাঁঠালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতেও বিরাট অবদান রাখবে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।"