কাল থেকে শুরু সাকরাইন: জোরেশোরে উদযাপনের প্রস্তুতি
রাজধানী ঢাকার ইতিহাস প্রায় চারশ বছরের; এ ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে পৌষ সংক্রান্তি। পঞ্জিকামতে, বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন উদযাপিত হয় পৌষ সংক্রান্তি। ঢাকাইয়া ভাষায় 'সাকরাইন' নামেই এটি অধিক পরিচিত। পৌষ সংক্রান্তি, সংক্রান্তি বা সাকরাইন যেভাবেই বলা হোক এ উৎসবের প্রস্তুতি চলে ঘটা করে।
সময়ের সাথে সর্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবে রূপ নেয়া এ উৎসব উদযাপনের ধরনে এসেছে পরিবর্তন । এছাড়া এ বছরের আয়োজনে করোনার প্রভাবও কিছুটা থাকছে। মহামারীর ভেতর জাঁকালো এই উৎসবের আয়োজন কেমন চলছে তা জানতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড হাজির হয় পুরান ঢাকায়।
আয়োজনের সাতসতেরো
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রথমবারের মতো সাকরাইন উৎসব উপভোগ করেন নাঈম ফয়সাল। অকপটে স্বীকার করে নেন, এর চাইতে প্রকান্ড উৎসব তখনো পর্যন্ত তিনি দেখেননি। উৎসবের আবহ মুগ্ধ করেছিল তাকে।
পুরনো ঢাকাবাসীর প্রাণের এই উৎসবের জন্য নতুন বছরের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে। সাকরাইনের আয়োজন থাকে দুইদিন ব্যাপী- ১৪ এবং ১৫ জানুয়ারি। সাধারণত ১৪ জানুয়ারিতেই সাকরাইন পালন করতে দেখা যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পঞ্জিকা অনুসারে পরদিন পালন করে থাকে। তবে ধর্মীয় দিকের চাইতে সাকরাইন আয়োজনে প্রাধান্য পায় মূলত এলাকার অবস্থান।
এলাকাভেদে দুইদিনের ভেতর যেকোন একদিন সাকরাইনের জন্য নির্ধারণ করা থাকে। পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, কলতাবাজার,শিংটোলা, কাগজীটোলা, সূত্রাপুর , লক্ষীবাজার, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, বানিয়ানগর, আইজি গেট, আরসিন গেট, গেন্ডারিয়া প্রভৃতি এলাকা সাকরাইনের দিনে যেন নতুন প্রাণ পায়।
সূত্রাপুর এলাকায় যেসব বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করা হয়, তন্মধ্যে একটি হলো 'কেটলি বাড়ি'। বাড়ির ছাদে সুদৃশ্য কেটলির নকশা থাকায় এমন নামকরণ। এ বাড়ির সাকরাইন উৎসব আয়োজকদের একজন মামুন রানা জানালেন সাকরাইন প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত।
"একটা ঘুড়ির দাম যদি সাধারণ সময়ে পাঁচ টাকা হয়, তবে সেটাই সাকরাইনের আগের দিন বেড়ে দাঁড়ায় ১০-১৫ টাকায়। ঘুড়ির মাঞ্জা (সুতা ধারালো করার জন্য যেসব উপাদান) ৫০ টাকায় বিক্রি হয়, সেটাই মূল দিনে ৩০০ টাকায় বিকোয়। ফলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই এসব সংগ্রহের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়", বললেন মামুন।
ঘুড়ি, নাটাই, আতশবাজি, ফানুস, মাইক্রোফোন সবকিছুই আলাদাভাবে এলাকার ছেলেপেলেরা জড়ো করতে থাকে। ছাদ ডেকোরেশনের পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই মূলত বাজেট নির্ধারিত হয়। কার ছাদ কত সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হলো তা নিয়ে চলতে থাকে প্রতিযোগিতা।
পরিকল্পনার পাশাপাশি চলে চাঁদা সংগ্রহ। আয়োজকদের মাঝেই নির্ধারণ করে দেয়া হয় কে কত টাকা চাঁদা দেবে; চাঁদা সংগ্রহ চলে বাসার 'বড়দের' মধ্য থেকেও। সাকরাইন উৎসব মানেই আনন্দ তাই কখনোই কারো কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়ার নজির নেই।
পুরনো ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসে সাকরাইন উৎসবে যোগ দেন। জ্যাম আর ভিড় ঠেলে পুরনো ঢাকার অলিগলিতে পা রাখার পর যদি মূল আয়োজনে সামিল না হতে পারেন তবে কিন্তু দিনটাই বৃথা! আয়োজকদের সাথে তাই আগে থেকেই যোগাযোগ করে রাখা ভাল।
নামমাত্র এন্ট্রি-ফী বা টিকিটের মাধ্যমে ছাদগুলোর আয়োজনে যুক্ত হতে পারবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনাহূত কেউ এসে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে সেজন্যেই আসলে আগত অতিথিদের এভাবে একটা গণনার ভেতর রাখা হয়। অনেক ছাদে থাকে টিশার্ট, ব্যাজ বা হ্যান্ডব্যান্ডের ব্যবস্থাও।
এক সময় ঘুড়ি, নাটাই আর মাঞ্জাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাকরাইনের পরিসর এখন ব্যাপক। দিনের প্রথম পর্বে চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা; গোত্তা খাওয়া ঘুড়ি এবং 'ভোকাট্টা' রবের সাথে সাউন্ড সিস্টেমের তালে তালে গানবাজনার মাধ্যমে আনন্দ-উল্লাস চলতে থাকে শীতের মিষ্টি বিকেল জুড়ে।
সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয়ে যায় চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। লেজার শো আর 'ডিস্কো লাইট' এর পাশাপাশি কেউ কেউ কেরোসিন মুখে মশালে ফুঁ দিয়ে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে; সন্ধ্যার আকাশে ঘুড়ির জায়গা নেয় রঙিন ফানুস । আলোর ঝলকানিতে ঢেকে যায় পুরনো ঢাকার সম্পূর্ণ আকাশ ।
মামুন বললেন, "প্রতিবছর আতশবাজির পেছনেই ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। স্পিকার এবং মিউজিক সিস্টেমের জন্য বরাদ্দ থাকে বাজেটের আরেকটি বড় অংশ। সাকরাইনে সব মিলিয়ে অন্তত ৩০-৪০ হাজারের বাজেট রাখতেই হয়।''
আতশবাজি কেনার সময় কিছুটা ঝুঁকি নিতে হয়। দাহ্য পদার্থ হওয়ায় বিভিন্ন সময় বাজি ও পটকার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কিনে আনার সময় কখনোবা ট্রাফিক সার্জেন্টরাও রাস্তাঘাটে আটকে রাখে। তবে এত বছরের আয়োজনের মাধ্যমে আতশবাজি সরবরাহকারীদের সাথে আয়োজকবৃন্দের এক প্রকার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফলে অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে দোকানে যেতেও হয় না; বিক্রেতা নিজেই বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে যায়, জানালেন মামুন।
এবারের সাকরাইনে করোনার প্রভাব নিয়ে কমবেশি সবাই চিন্তিত।
"যেহেতু আমরা থার্টিফার্স্ট নাইট এবার বিধিনিষেধ মেনে উদযাপন করতে পেরেছি, সাকরাইন পালনেও কোন অসুবিধা থাকবে বলে মনে হয় না। তবে মহামারীর জন্য উৎসাহ উদ্দীপনায় এবার কিছুটা ভাটা পড়েছে। পুরনো অনেক আয়োজকই ইতোমধ্যে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন", জানালেন মামুন।
সাকরাইন এবার পুরো ঢাকা জুড়ে
জুবায়ের, সোহান, ঝিলন, নাফিস- একঝাঁক কিশোরের সাথে দেখা শাঁখারিবাজারের ঘুড়ির দোকানে। সবাই সাকরাইনের জন্য ঘুড়ি আর নাটাই সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। করোনা মহামারীর ভেতরেও বিধিনিষেধ মেনে ছোট পরিসরে এলাকায় আয়োজন রাখছেন তাঁরা।
"সাকরাইন আমাদের কাছে আবেগের নাম। ছোটবেলা থেকে কখনো সাকরাইন পালন না করে থাকি নি আমরা। তবে এবার মহামারীর জন্য অনেকেই কিছুটা আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন", জানালেন জুবায়ের।
ঘুড়ি কিনতে আসা পোস্তগোলার বাসিন্দা অর্ণবও একই কথা বললেন।
"করোনার জন্য অনেক পরিবারে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। অনেকের মা বাবা তাই সাকরাইন উৎসব আয়োজনের বিপক্ষে। তাছাড়া এবার চাঁদা সংগ্রহের হারও অনেক কম। ব্যবসায় লোকসানের জন্য অনেকে আমাদের সাথে সাকরাইন উৎসবে যোগ দেবেন না বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন", বললেন অর্ণব।
৫০ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে শাঁখারিবাজারে ঘুড়ি বিক্রি করে আসছেন সমন নন্দী। শঙ্খ নিকেতন নামক প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এ প্রৌঢ় জানালেন, "বিক্রিবাট্টায় করোনার প্রভাব তেমন নেই। মহামারী চললেও শিশু কিশোরদের সাকরাইন উৎসব পালন বন্ধ নেই। বরং মেয়র সাহেবের উদ্যোগে এবার সাকরাইন হবে আরও বড় পরিসরে। ঢাকাইয়াদের এই উৎসবকে এবার আরও গৌরবান্বিত করে প্রচার করা হবে"।
আগের এবং এখনকার সাকরাইনের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে সমন নন্দী বলেন, " এখন সাকরাইনে আধুনিকতার ছোঁয়া। আগে সীমিত আকারে পালিত হতো, এখন তো পুরো ঢাকা জুড়ে এ উৎসবের ছাপ চোখে পড়ে"।
প্রসঙ্গত, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের(ডিএসসিসি) উদ্যোগে এবার ৭৫টি ওয়ার্ডে একসঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হবে। 'এসো ওড়াই ঘুড়ি, ঐতিহ্য লালন করি' স্লোগানে এ উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে কাউন্সিলরদের কাছে ১০০ করে মোট ১০ হাজার ঘুড়ি সরবরাহ করা হবে। বেলা দুইটা থেকে শুরু হয়ে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে এ আয়োজন।