কৃত্রিম দুধ ও মাংসই কি ভবিষ্যতের খাবার হতে যাচ্ছে?
পেরুমাল গান্ধীর ফেনা তোলা কফির গ্লাসটি দেখলে আর দশটি সাধারণ দুধ কফির মতোই মনে হবে। তবে পার্থক্য এই যে, এই কফিতে গরুর দুধ ব্যবহার করা হয়নি। দুধটি ছত্রাকের সাহায্যে ল্যাবে তৈরি করা হয়েছে। শুনতে অদ্ভুত শুনালেও অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম দুধ ও মাংস আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
সহকর্মী বায়োইঞ্জিনিয়ার রায়ান পান্ডিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে পারফেক্ট ডে নামের নতুন স্টার্টআপ শুরু করেছেন পেরুমাল গান্ধী। দুধের বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি করতে গরুর জিনোম সিকুয়েন্সের সঙ্গে ফারমেন্টেশনের জন্য ছত্রাকের সাহায্য নিয়েছেন তারা।
বিশ্বের ১৪ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাসের সৃষ্টি হয় গবাদি পশু থেকে। অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণের এক-তৃতীয়াংশের জন্যই দায়ী খাদ্য উৎপাদন খাত। প্রতিদিন বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া সহজ বিষয় নয়। খাদ্য উৎপাদনের জন্য বন উজাড় থেকে শুরু করে পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং খাদ্য মজুদ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উচ্চ পরিমাণে কার্বন নিঃসৃত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়বে এই কার্বন নিঃসরণ। সেই সঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবেলাও কঠিন হয়ে পড়বে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে বেশ কিছু সময় ধরেই কৃত্রিম উপায়ে দুধ ও মাংস উৎপাদনের চেষ্টা করছেন গবেষকরা। ইতোমধ্যে এ ধরনের বেশ কিছু গবেষণা ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে।
পারফেক্ট ডের মাধ্যমে গান্ধী ও পান্ডিয়াও সেলুলার অ্যাগ্রিকালচার বা কোষনির্ভর কৃষির মাধ্যমে প্রাণীজাত খাদ্য উৎপাদনের বিকল্প উপায় অনুসন্ধান করছেন।
সরাসরি গরুর থেকে ডিএনএ সংগ্রহের পরিবর্তে মিল্ক প্রোটিনের জন্য ইতোমধ্যে আলাদা করা জিন ছত্রাকের ভেতর প্রবেশ করান তারা। পরবর্তীতে ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় ছত্রাক থেকে দুধ উৎপাদিত হয়।
গবাদি পশু পালন ছাড়াই মাংস ও দুধ উৎপাদন এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। কৃত্রিম উপায়ে মাংস ও দুধ উৎপাদন মানুষের প্রয়োজনীয় আমিষ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জলবায়ু সংকট মোকাবেলাতেও সহায়ক হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী নেট জিরো কার্বন নিঃসরণ নিশ্চিত করতে হলে জ্বালানি ও শিল্পখাতের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আনা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পারফেক্ট ডের মাধ্যমে গান্ধী এবং পান্ডিয়া জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রাখার স্বপ্ন দেখেন।
এরকমই আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো সিঙ্গাপুরের টারটলট্রি ল্যাব। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে প্রথম স্টেমসেল ব্যবহার করে দুধ উৎপাদনের চেষ্টা করে।
গবাদি পশু পালন কমিয়ে তারা মিথেন গ্যাস নিঃসরণও কমাতে চায়। গ্রিনহাউজ গ্যাস হিসেবে মিথেন গ্যাস প্রথম ১০০ বছরে কার্বন ডাই অক্সাইড অপেক্ষা ২৫ গুণ বেশি তাপ ধারণ করে। গবাদি পশু পরিপাক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নিঃসৃত হয় এই মিথেন গ্যাস। টারটলট্রি জানিয়েছে ভবিষ্যতে খামারের পরিবর্তে বায়োরিয়েক্টরে দুধ উৎপাদিত হবে।
একই উপায়ে পশুর সেল ব্যবহারের মাধ্যমে ল্যাবরেটরিতে মাংসও উৎপাদিত হয়। ২০১৩ সালে বিজ্ঞানী মার্ক পোস্ট প্রথম ল্যাবে উৎপাদিত গরুর মাংসের বার্গার সামনে আনেন। মার্কের প্রতিষ্ঠান মোসা মিট এখন মাত্র তিলের দানার পরিমাণ সেল থেকে ৮০ হাজার বার্গার তৈরি করতে পারে।
গরু ছাড়াও ভেড়া, শুকর, মাছ, মুরগি প্রায় সব ধরনের প্রাণী থেকেই সেলুলার মাংস উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিঙ্গাপুরে গত বছর এই কৃত্রিম মাংস বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে, সেলনির্ভর দুধ ও মাংস বাজারজাতকরণের কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। নতুন খাদ্যের ক্ষেত্রে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। একইসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে খাদ্য সরবরাহের জন্য ল্যাবের বাইরে বৃহৎ পরিসরে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে।
সেইসঙ্গে নতুন প্রযুক্তির জন্য বাড়বে উৎপাদন খরচ। তবে বড় পরিসরে উৎপাদন শুরু হলে কৃত্রিম দুধ ও মাংস উৎপাদন খরচ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত দুধ ও মাংসের পর্যায়ে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভিন্ন পদ্ধতির অনুসন্ধানও করছেন অনেকে। নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা গরু ও ভেড়ার জন্য এমন একটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করছেন যা তাদের উৎপাদিত মিথেন গ্যাসের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে।
তবে নতুন ধারার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরণ কমলেও এরসঙ্গে ভোক্তা আচরণেও পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্য শৃঙ্খলের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তনও অপরিহার্য হয়ে পড়বে।
- সূত্র: বিবিসি