কোটি বছর আগের সমুদ্র পারাপারের সফলতাই হয়তো মানব বিবর্তনকে সম্ভব করেছে
আফ্রিকা মহাদেশ আধুনিক মানুষের আদি নিবাস। শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও বানরের মতো আফ্রিকাতে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ। কিন্তু, আফ্রিকায় নিবাস গড়ার আগে, অন্য কোথাও বিবর্তিত হয়েছিল প্রাইমেটরা- এশিয়ায় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে সময়, আজ থেকে প্রায় ৫ কোটি বছর আগে বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ ছিল আফ্রিকা। মধ্যিখানে বিশাল সমুদ্র। তাহলে প্রাইমেটরা আফ্রিকায় পৌঁছালো কী করে?
এর অন্যতম ব্যখ্যা হচ্ছে কোনো ভূমি সংযোগ থাকা। তবে বর্তমান ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ আবার অন্য কথা বলছে। এর বদলে প্রায় ভিন্ন এক দৃশ্যপট সামনে এসেছে। প্রাথমিক দিকের প্রাইমেটরা হয়তো ভেজিটেশন (কোনো অঞ্চলের বিভিন্ন উদ্ভিদের আস্তরণের ভূখন্ডের অংশ) ও ভূতাত্ত্বিক বর্জ্যের মাধ্যমে সমুদ্রে ভেসে ভেসে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে আফ্রিকায় পৌঁছেছে।
সমুদ্রের মাধ্যমে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার এই ধারণা এক সময় অনেক বিজ্ঞানী অতি কল্পনা মনে করতেন। এখনো অনেক বিজ্ঞানী সেই ল্যান্ড ব্রিজ থিওরি বা ভূমি সংযোগের মাধ্যমে আফ্রিকায় পৌঁছানোর ধারণাকেই সমর্থন করে। এদের মধ্যে কেউ ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ নাকচ করেছেন। কেউবা বলছেন, বর্তমান ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী যে সময় মহাদেশগুলো আলাদা হয়ে যায় তার আগেই প্রাইমেট পূর্বপুরুষরা আফ্রিকায় পাড়ি জমান।
তবে, সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বেশ সাধারণ- এই ধারণার প্রতি আগের চেয়ে ঐক্যমত্য বেড়েছে বর্তমানে। বিভিন্ন উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, ইঁদুর জাতীয় প্রাণি ও প্রাইমেটদের এই উপায়ে দ্বীপে বসতি স্থাপন করতে দেখা গেছে। আজ থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বানরের দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানো এর অন্যতম উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল, তবে বিশাল সময়ের বিবেচনায় এ ধরনের ঘটনা অনিবার্যভাবে বিবর্তনকে প্রভাবিত করে। মানুষের উদ্ভবের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।
প্রাইমেটদের উৎপত্তি
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে আজ থেকে দুই লাখ থেকে ৩লাখ ৫০ হাজার বছর আগের সময়ের মধ্যে মানুষের আবির্ভাব হয়। এই অঞ্চলে আমাদের জিনগত বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এবং সেখানেই আদিম মানুষের সবচেয়ে বেশি ফসিলের সন্ধান পাওয়ায় আমরা জানি আফ্রিকা থেকেই আমাদের বিকাশ।
তবে, অতি সাম্প্রতিক কিছু ফসিল আবিষ্কারের পর দেখা গেছে, আফ্রিকা ছাড়াও একই সময়ে অন্য মহাদেশেও মানুষের বিকাশ ঘটেছে। সে অনুযায়ী, প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের বিবর্তন হয়েছে কিনা এ নিয়ে জোরালো অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
সে যাই হোক, বেবুন ও বানরের পাশাপাশি মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় গরিলা ও শিম্পাঞ্জিও আফ্রিকার স্থানীয় প্রজাতি।
তবে প্রাইমেটদের বর্তমানে জীবিত সবচেয়ে কাছের আত্মীয় উড়ন্ত লেমুর, ট্রিশ্রু ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণি এশিয়ার বাসিন্দা, ইঁদুর জাতীয় প্রাণি তো বিবর্তিতই হয়েছে এশিয়াতে। ফসিল কিছুটা সংঘাতপূর্ণ তথ্য দেয়, তবে ফসিল থেকেই জানা গেছে আফ্রিকার বাইরে প্রাইমেটদের উদ্ভব হয়েছে।
প্রাইমেটদের সবচেয়ে প্রাচীন আত্মীয়, পারগেটোরিয়াস পৃথিবীতে বাস করতো আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে। ডাইনোসররা বিলীন হওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়ে। তাদের বাস ছিল মন্টানায়।
আবার সবচেয়ে প্রাচীন প্রাইমেটের উৎপত্তিও আফ্রিকার বাইরে। বানর ও এপের সঙ্গে সম্পর্কিত টেইলহারডিনা এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে বাস করতো আজ থেকে প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে। এর আরও পরে আফ্রিকায় গিয়েছে প্রাইমেটরা। সেখানে লেমুরের মতো ফসিল তৈরি হয়েছে ৫ কোটি বছর আগে, বানরের মতো ফসিল ৪ কোটি বছর আগে।
কিন্তু, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিভক্ত হয়ে আফ্রিকা দ্বীপে পরিণত হয় ১০ কোটি বছর আগে। আর, এশিয়া মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাত্র ২ কোটি বছর আগে। এই হিসেবেই, মাঝখানের ৮ কোটি বছরের মধ্যে প্রাইমেটরা আফ্রিকায় বসতি স্থাপনের জন্য তাদের সমুদ্র পাড়ি দিতে হতো।
সমুদ্র পারাপার
বিবর্তন তত্ত্বের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনো প্রজাতির ছড়িয়ে পড়ার ধারণা। গ্যালাপাগোস দীপপুঞ্জে অনুসন্ধান চালিয়ে ডারউইন দেখেছিলেন, সেখানে শুধু ছোট অল্প কিছু কচ্ছপ, ইগুয়ানা, সাপ ও রাইস র্যাটের মতো ছোট একটি স্তন্যপায়ী প্রাণির মতো অল্প কিছু প্রাণির বাস। কিন্তু সমুদ্রের আরও দূরবর্তী অঞ্চলে, তাহিতির মতো দ্বীপগুলোতে শুধু টিকটিকি জাতীয় ছোট প্রাণি বাস করে।
এধরনের বিষয়গুলো ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না উল্লেখ করেন ডারউইন। একই ধরনের প্রজাতির সবখানে না থাকার কারণ হতে পারে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া। এক্ষেত্রে খুব কম প্রজাতিই দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে বসতি গড়তে পারবে।
ডারউইনের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কচ্ছপ কয়েক সপ্তাহ খাবার বা পানি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। এভাবেই হয়তো ভেসে ভেসে গ্যালাপাগোসে পৌঁছেছিল তারা। ১৯৯৫ সালে, হারিকেনে আক্রান্ত অঞ্চল থেকে প্রায় ৩০০ কি.মি ভেসে উপকূলে এসে পড়েছিল অনেক ইগুয়ানা। গ্যালাপাগোসে ইগুয়ানা এই উপায়েই গিয়েছিল এমন সম্ভাবনাই বেশি।
সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দূরবর্তী কোনো দ্বীপে বসতি গড়ার জন্য প্রয়োজন পাড়ি দেওয়ার মতো বিরাট ভেজিটেশন, পানি ও বাতাসের অনুকূল প্রবাহ, টেকসই জনগোষ্ঠী, সঠিক সময়ে কোনো ভূখণ্ডের সন্ধান পাওয়া- এ সবকিছুর সমন্বয়। উপকূলে পৌঁছানো অনেক প্রাণিই দ্বীপের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছানোর আগে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থা মারা গেছে।
বেশিরভাগই কখনো কোনো ভূখণ্ড পর্যন্তই পৌঁছাতে পারেনি। সমুদ্রেই বিলীন হয়ে গেছে, হাঙ্গরের পেটে গেছে। একারণেই সামুদ্রিক দ্বীপে, বিশেষত দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে কম সংখ্যক প্রজাতি বাস করে।
কোনো কিছুর সাহায্যে এভাবে পারাপার বা রাফটিংয়ের ঘটনাকে একসময় ইভোলিউশনারি নভেলটি ভাবা হতো। তবে, ভেজিটেশন, ভাসমান দ্বীপ, গাছের গুড়ি সমুদ্রে ভেসে পার হওয়ার বিষয়টির আসলেই বিশ্বজুড়ে প্রাণিদের বিস্তারের, সংখ্যাগত অবস্থানের বিষয়টি অনেকাংশে ব্যাখা করতে পারে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রাফটিং
বেশ কিছু প্রাইমেটের ভেসে পারাপারের ঘটনা সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে মাদাগাস্কারে বিচিত্র প্রজাতির লেমুরের বাস। আজ থেকে প্রায় ২ কোটি বছর আগে আফ্রিকা থেকে এসেছিল লেমুর। মাদাগাস্কার যেহেতু ডাইনোসরের সময়কাল থেকেই দ্বীপ ছিল, লেমুরদের প্রায় ৪০০ কি.মি. প্রশস্ত মোজাম্বিক চ্যানেল পাড়ি দিতে হয়েছিল। ফসিলের প্রমাণ অনুযায়ী, 'আঈ আঈ' লেমুর অন্যান্য লেমুরদের চেয়ে আলাদা হয়ে মাদাগাস্কারে পৌঁছেছিল।
দক্ষিণ আমেরিকায় বানরের অস্তিত্ব আরও বিস্ময়কর। হাওলার, স্পাইডার বানর ও মারমোসেট বানরের বাস এই অঞ্চলে। তাদেরকে আটলান্টিকের ১৫০০ কি.মি. প্রশস্ত পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও পাড়ি দিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে বানররা- উত্তর আমেরিকায়, ক্যারিবিয়ানে।
কিন্তু, এ সব কিছু হওয়ার আগে, এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে প্রাইমেটদের আফ্রিকায় পৌঁছাতে হবে। লেমুরের পূর্বপুরুষরা সেখানে পৌঁছেছিল, অন্য ঘটনায় বানর, এপ ও মানুষের পূর্বপুরুষও পৌঁছেছিল। এ বিষয়টি হয়তো এখনো অকল্পনীয় মনে হতে পারে, তারা কোথা থেকে আফ্রিকায় গিয়েছিল তাও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। কিন্তু আর কোনো দৃশ্যপট দিয়েই এখন পর্যন্ত বিদ্যমান ভূতাত্ত্বিক প্রমাণকে ব্যাখ্যা করা যায়নি।
ইঁদুর জাতীয় প্রাণিরা কীভাবে আফ্রিকা ও তারপর দক্ষিণ আমেরিকায় বসতি গড়েছিল তাও এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়। হাতি ও আর্ডভার্ড যে বর্গের প্রাণি সে আফ্রোথেরিয়াও এই পদ্ধতিতে আফ্রিকায় পৌঁছেছিল। উত্তর আমেরিকায় বিবর্তিত হওয়া মারসুপিয়ালস সম্ভবত এভাবেই দক্ষিণ আমেরিকা, তারপর অ্যান্টার্কটিকা ও সবশেষে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়। ইঁদুরের অস্ট্রেলিয়ায়, টেনরেস, মঙ্গুজ ও জলহস্তীর মাদাগাস্কারে যাওয়া এ ধরনের সমুদে পারাপারের উদাহরণ।
এ বিষয়টি বিবর্তনের ছোট কোনো অংশও নয়, বরং কেন্দ্রীয় একটি বিষয়। বানর, হাতি, ক্যাঙ্গারু, রোডেন্ট ও লেমুর এবং মানুষেরও বিবর্তনের ব্যাখ্যাও দেয় এটি। এটিই নির্দেশ করে, বিবর্তন সবসময় সাধারণ ঘটনা দ্বারা পরিচালিত হয় না, এধরনের বিচিত্র ও অভাবনীয় ঘটনা দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে।
ম্যাক্রো ইভোলিউশন
ছোটখাটো মিউটেশন, শিকার, প্রতিযোগিতা- এধরনের প্রাত্যহিক বিষয়গুলো সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে কোনো প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে এই ধারণা ডারউইনের অন্যতম অবদান।
পাশাপাশি মিলিয়ন, বিলিয়ন বছর সময়ের মধ্যে দুর্লভ, কম সম্ভাবনার 'ব্ল্যাক সোয়ান' ঘটনাও ঘটতে পারে। কালো হাঁস আবিষ্কারের পর এ ধরনের ঘটনা বোঝাতে 'ব্ল্যাক সোয়ান' রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়।
এরমধ্যে কিছু ঘটনা গ্রহাণুর প্রভাব, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, বরফ যুগ বা ভাইরাসের এক পোষক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে সংক্রমণ ছড়ানোর মতো ধ্বংসাত্মক। কিছু ঘটনা আবার জিনোম ডুপ্লিকেশন, বহুকোষী প্রাণিদের মধ্যে জিন স্থানান্তর ও রাফটিংয়ের মতো চমকপ্রদ।
রাফটিংয়ের ভূমিকা দেখলে বোঝা যায়, আমাদের বিবর্তনও কতোটা ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া বিষয় মাত্র। শুধু অল্প কিছু এদিক-সেদিক হলেই- আবহাওয়া খারাপ হলে, সাগর উত্তাল থাকলে, বা ভেসে ভেসে শূন্য কোনো ভূমিতে পৌঁছালে- কিংবা সেই উপকূলে ক্ষুধার্ত শিকারি প্রাণি অপেক্ষমান থাকলে বা ভেসে যাওয়া প্রাণিদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের কেউ না থাকলে, এভাবে বসতি গড়া সম্ভব হতো না। বানর, এপ, মানুষ- হয়তো কেউই থাকতো না।
অবস্থাদৃষ্ট দেখে বলাই যায়, আমাদের পূর্বপুরুষরা কোটিতে একটি লটারি জেতার মতোই প্রতিকূলতাকে জয় করেছিলেন। একটু এদিক সেদিক হলেই বিবর্তনের মোড় অন্যদিকে বাঁক নিতে পারতো। অন্তত, এসব বিষয় চিন্তা করার জন্য আমরা এখানে থাকতাম না- এমনটা তো হতেই পারতো।
- লেখক: নিকোলাস আর. লংগ্রিচ ইউনিভার্সিটি অব বাথের ইভোলিউশনারি বায়োলজি অ্যান্ড প্যালিওন্টোলজির সিনিয়র লেকচারার।
- ভাষান্তর: রাফিয়া তামান্না